দুর্বিন শাহ (জন্ম: ২ নভেম্বর ১৯২০, মৃত্যু: ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭) বাংলাদেশের একজন মরমী গীতিকবি, বাংলা লোকসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার এবং বাউলসাধক। তাঁর গান ও রচনায় সুফি ভাবধারা, মরমিবাদ, আধ্যাত্মিকতা এবং সামাজিক ও মানবিক বার্তা সমন্বিত। তিনি বাংলা লোকসাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য স্থাপনা হিসেবে পরিচিত।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
দুর্বিন শাহ জন্মগ্রহণ করেন ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১৫ কার্তিক (১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২ নভেম্বর) ছাতকের সুরমা নদীর উত্তর পারে নোয়ারাই গ্রামের তারামনি টিলায়। এই টিলাটি পরে ‘দুর্বীন টিলা’ নামে পরিচিত হয়। তাঁর পিতা সফাত আলি শাহ ছিলেন একজন সুফি সাধক এবং মা হাসিনা বানু ছিলেন একজন পিরানী। তাই তিনি সঙ্গীতচর্চার একটি পারিবারিক ঐতিহ্যে বড় হন।
মাত্র সাত বছর বয়সে বাবা হারান। ১৯৪৬ সালে তিনি সুরফা বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
সঙ্গীত ও সাহিত্য কর্ম
দুর্বিন শাহের গানগুলোতে মূলত সুফি ও মরমি ভাব ফুটে ওঠে, তবে তিনি বিভিন্ন মেজাজের গানও রচনা করেছেন। তাঁর গানের শ্রেণীবিন্যাস করা যায় যেমন:
- বাউল গান
- আঞ্চলিক গান
- গণসংগীত
- মালজোড়া
- জারি ও সারি
- ভাটিয়ালি
- গোষ্ঠ ও মিলন
- রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী
- হামদ-নাত
- মারফতি, পির-মুর্শিদ স্মরণ
- নবি স্মরণ, ওলি স্মরণ, ভক্তিগীতি
- মনঃশিক্ষা, সুফিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, পারঘাটাতত্ত্ব
- দেশের গান
এই ভিন্নধর্মী রচনাগুলো বাংলা লোকসাহিত্যের বৈচিত্র্যকে বহুগুণে সমৃদ্ধ করেছে।
উল্লেখযোগ্য গান
দুর্বিন শাহের কিছু জনপ্রিয় গান হলো:
- পরদেশীরে দূর বিদেশে ঘর
- নব যৌবন আষাঢ় মাসে
- তোমার মতো দরদী কেউ নাই
- বন্ধু যদি হইতো নদীর জল
- বেলা গেল সন্ধ্যা হল আর কি বাকি আছে বল
- আমি জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারই চরণে রে
- নির্জন যমুনার কূলে বসিয়া কদম্বতলে
- আমার অন্তরায় আমার কলিজায়
- সুখের নিশি প্রভাত হলো উদয় দিনমণি
- শমন লইয়া পিয়ন খাড়া আর কত দিন দেরি
- ছাড়িয়া যাইও না বন্ধু রে
- কৃপাসিন্ধু দীনবন্ধু নামটি তোমার সংসারে
১৯৭৪ সালে কলকাতার চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক তাঁর চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন দুর্বিন শাহের লেখা ‘নমাজ আমার হইল না আদায়’ গানটি।
প্রবাস সফর ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯৬৭ সালে তিনি প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড যান। তাঁর সঙ্গে সফরকারী ছিলেন বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম। সেখানকার সঙ্গীতপ্রেমীরা তাঁকে ‘জ্ঞানের সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
গ্রন্থ ও সমগ্র সংকলন
দুর্বিন শাহের রচিত গ্রন্থ ও সংকলনগুলো হলো:
- প্রেমসাগর পল্লীগীতি প্রথম খণ্ড (১৯৫০)
- প্রেমসাগর পল্লীগীতি দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৫০)
- প্রেমসাগর পল্লীগীতি তৃতীয় খণ্ড (১৯৬৮)
- প্রেমসাগর পল্লীগীতি চতুর্থ খণ্ড (১৯৬৮)
- পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি (১৯৭০)
- প্রেমসাগর পল্লীগীতি পঞ্চম খণ্ড (১৯৭৩)
- দুর্বিন শাহ সমগ্র (সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত) (২০১০)
ঢাকার উৎস প্রকাশন থেকে ‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’ বইয়ে তাঁর সমস্ত রচনাসম্ভার সংরক্ষিত।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
দুর্বিন শাহ ৫৭ বছর বয়সে, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ৩ ফাল্গুন (১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি) নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর গান ও রচনা বাংলা লোকসঙ্গীতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
দুর্বিন শাহ ছিলেন শুধুমাত্র একজন গীতিকবি বা বাউলসাধক নয়; তিনি ছিলেন বাংলার মরমি সংস্কৃতি ও সুফিবাদের এক জীবন্ত প্রতীক। তাঁর রচনা, গান ও দর্শন আজও নতুন প্রজন্মকে মানবতা, প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার পথে অনুপ্রাণিত করে।
