বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালন ফকিরের সাধনা - মুচকুন্দ দুবে
লালন ফকিরের সাধনা - মুচকুন্দ দুবে

লালন ও অন্যান্য বাউলরা ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মের নামে শোষণের নিন্দা করেছেন। তাঁর বর্ণবাদ আর ধর্মীয় ভেদাভেদের বিরুদ্ধে গান গেয়েছেন। হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে সেতু নির্মাণকে তাঁরা নিজেদের আরাধ্য করেছেন। ভারতীয় সমাজের ঐক্যসাধনে লালন ও অন্য বাউলদের মতো এত বড় অবদান খুব কম লোকই রাখতে পেরেছে। নিচে লালনের গানের কিছু অবিস্মরণীয় চরন তুলে তুলে দেয়া হলোঃ-

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কিরুপ দেখলাম না এই নজরে



কিংবা,

সবাই বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন
লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান



কিংবা,

জাত গেল জাত গেল বলে
এ কি আজব কারখানা



সাধক বা সত্যসদ্ধ হওয়ার পাশাপাশী লালন ছিলেন খুবই বড় মাপের কবি। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ তাঁর সম্বন্ধে এমন চমৎকার প্রশংসার বাণী শোনাতে পারেনিঃ-

ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না, তাতে যেমন গানের তত্ত্ব তেমনি কাব্যরচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোকসাহিত্য এমন অপূর্ববার্তা আর কোথাও পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করেনি।

বিশেষভাবে লালনের নাম উল্লেখ না করলেও রবীন্দ্রনাথের নানা লেখায় বাউলদের প্রসঙ্গে এসেছে। অথচ বাউল গানের উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হরহামেশাই লালনের গান থেকে থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে। অক্সফোর্ড এর বক্তৃতায়, পরে যা “The religion of man” শিরোনামে প্রকাশিত হয়, রবিন্দ্রনাথ লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানটির উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাউলগানের সাহিত্যমূল্যের প্রতি শিক্ষিত বাঙালিদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। বাউলগান সংগ্রহের একটি প্রচেষ্টাও তিনি হাতে নিয়েছিলেন। আবার তিনিই প্রথম প্রবাসী পত্রিকাই লালনের ২০টি গান সংশোধন ও সম্পাদনা করে ছেপেছিলেন।

বাউলগানের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি দিয়েছেন গুলোর মধ্যে ঔপনিষদিক দর্শনের প্রতিফলন আবিষ্কার করে। “The religion of man” প্রবন্ধের এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ

উপনিষদের যে ঋষিরা বলেছেন, অজানা সত্তাকে বুঝতে গিয়ে আমাদের মন বিহম্বল হয়ে ফিরে আসে, তাদের সঙ্গে এই পল্লীকবির বক্তব্যর মিল সুস্পষ্ট কিন্তু তাই বলে প্রাচীন সেই ঋষির মতো এই কবি তার অনন্তের পেছনে ছুটে চলার ক্লান্তি দেয় না, আর এ ভাবে বুঝিয়ে দেয় যে অনন্তকে অনুধাবনের পথ উন্মুক্ত।

মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের ‘হারামণির’ প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ-

আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদাহ অঞ্চলের এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিলঃ-

কোথায় পাবো তারে
আমার মনের মানুষ যে রে?
হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশে
দেশে-বিদেশে বেড়াই ঘুরে ।



কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এই কথাটি উপনিষদের ভাষাই শোনা গিয়েছে, “পুং বেদ্যাং পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণ-বেদনা’’। অপণ্ডিতের মুখে এ কথাটিই শুনলুম, তার গেয়ো সুর সহজ ভাষায় যাকে সকলের চেয়ে জানবার তাঁকেই সকলের চেয়ে না জানবার বেদনা- অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু তারই কান্নার সুর- তাঁর কণ্ঠে বেজে উঠেছে।

শ্রীঅন্নদাশঙ্কর রায় এই সিধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর বাউলগানের মধ্যে কিছু অভিন্ন স্বভাব থাকলেও রবীন্দ্রনাথের কবিতাই বাউলদের এবং সেই সুত্রে লালনের প্রভাব ছিল সীমিত। বাউল গানগুলোর স্বভাব গূঢ়ার্থভিত্তিক। সেগুলোর প্রকৃত অর্থ সাধারণ লোকের কাছে সহজে বোধগম্য হয় না। কেবল বাউলবিশ্বাসে দীক্ষিতদের পক্ষেই সেগুলোর অর্থ বোঝা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের কবিতা এর ঠিক বিপরীত।

বাউলদের মতো রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাস করতেন মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের বাস। ‘দ্য রিলিজন অব ম্যান’ প্রবন্ধে তিনি মানুষের দেবত্ব আর ঈশ্বরের মানবত্বের কথা বলেছেন। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে তিনি বলেছেনঃ-

রুপসাগরে ডুব দিয়েছি
অরুপ রতন আশা করি।



রবীন্দ্রকাব্য আর বাউলগানে মরমীবাদ একটি অভিন্ন উপাদান হিসেবে থাকলেও এ ক্ষেত্রে বাউলরা রবীন্দ্রনাথের ওপর প্রভাব ফেলেননি। বরং উভয়ে তাঁদের কবিতা ও গানের মরমীবাদের উপাদান সংগ্রহ করেছেন ইসলাম, হিন্দু আর বৌদ্ধ ধর্মের অভিন্ন উত্তরাধিকার থেকে।

কবিতার নয়, বরং গানে রবীন্দ্রনাথ বাউলদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। হারামণি মুখবন্ধে লিখেছেনঃ-

আমার অনেক গানেই আমি বাউল সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগীনির সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোনো এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিলে গেছে।

বাংলার লোকসঙ্গীতের মধ্যে লালনগীতি সুললিত। এ গানগুলো প্রকৃতপ্রস্তাবেই আত্মাভিসারী। শ্রোতাদের তা পরমেশ্বরের পানে দিয়ে যায়। গানগুলো সহজ, সরল, নিরলঙ্কার এবং মাটি থেকে উঠে আসা। গানগুলো গভীর ও ঋদ্ধ দার্শনিক উপাদানের কারণে অন্নদাশঙ্কর রায়সহ অনেক গবেষক সেগুলোকে পুরোদমে লোকসঙ্গীত গণ্য করতে রাজি নন। তাঁরা এগুলোকে সাধনাগীতের পর্যায়ে ফেলেন। তবে দার্শনিকতা যায় থাক না কেন এটা তর্কাতীত যে, গানগুলতে লোকায়ত উপমা, শব্দ, দৃশ্যকল্প ও শৈলী প্রয়োগ করা হয়েছে। লোকায়ত উৎস এবং লোকায়িতক স্বভাবই এ গানগুলোর প্রাণ। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ এগুলোকে লোকসঙ্গীত বলে অভিহিত করেছেন। তবে গানগুলোকে একই সঙ্গে ‘লোকসঙ্গীত’ এবং ‘সাধনাগীত’-এর পর্যায়ভুক্ত করলে বিষয়টা স্ববিরোধী হয় না। কেননা লোকায়ত উপমাই এ গানগুলোকে সাধনার যোগ্য মাধ্যম করে তুলছে।

রবীন্দ্রসঙ্গীত বা নজরুলগীতির মতো বাউলগানের কোনো নির্ভেজাল, মুলানুগ আকার নেই। বাউলরা তাঁদের গানের কথাগুলো লিখে রাখারই বিরোধী ছিলেন। এসব গানের স্বরলিপির তো প্রশ্নই আসে না। গানগুলো শুনে গাওয়া হয়, আর লালনের শিষ্য থেকে শিষ্যান্তরে মুখে প্রবাহিত হয় এসব গান। এই প্রক্রিয়ায় গানগুলোতে ইতিমধ্যে অনেক ইতরবিশেষ ঘটেছে। পরবর্তী সময়ের গায়কেরা গানগুলোতে তাঁদের নিজেদের অলঙ্কার সন্নিবেশ করেছে। আধুনিক মানুষের কানে সেগুলকে শ্রুতিমধুর করার জন্য সুরের নানান পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে, এমনকি লালনের জীবদ্দশাতেই নাকি তাঁর গানগুলো নানা সুরে গাওয়া হতো। যারা আখড়ায় থাকত তারা গাইত এক সুরে, আর যারা সংসারধর্ম পালন করত তারা গাইত আরেক সুরে।

বাংলার বাউল আন্দোলন কোনো বিচ্ছিন্ন সামাজিক বা আধ্যাত্মিক আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল ভারতের আরো কয়েক জায়গায় সংঘটিত একই রকম আরো কিছু আন্দোলনের অংশ। বাউল আন্দোলনে সুফিবাদ, বৈষ্ণব ও সহজিয়া মতবাদের প্রভাবের কথা তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বাউলরা কবির, নামক ও দাদুর মতো উত্তর ভারতের সাধককবিদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ছিল। উপমা, শৈলী এবং অন্তনিহিত ভাবের দিক থেকে বাউলগান আর উত্তর ভারতের সাধক কবিদের কবিতাই অনেক মিল। পাশাপাশি আবার মজার কিছু তফাৎ আছে। এই সুত্রে লালন আর কবিদের মধ্যে তুলনা করে দেখা যেতে পারে।

লালন এবং কবির উভয়ের জন্ম ও ধর্ম রহস্যাবৃত। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী উভয়েই তারা হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করে মুসলমান পরিবারে লালিত পালিত হয়েছেন। তাদের দুজনার কবিতাই পরমকে খোঁজার এবং সমাজসংস্কারের হাতিয়ার। তাঁরা দুজ্যনই জোরের সাথে মানুষের ঐক্যের কথা বলেছেন,বলেছেন মানুষ আর ইশ্বরের অবিচ্ছেদ্যতার কথা। প্রসঙ্গে লালনের বেশকিছু গানের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। এবার কবির থেকে উদাহরণ দেয়া যাকঃ-

লালি মেরে লালকি, জিত দেখো তিত লাল
লালি দেখান ম্যায় গায়ি ভি হো গায়ি লাল
(প্রিয়ার আত্তা- যখনই তাকাই দ্যুতিময়
তার আভা দেখতে গিয়ে আমিও হয়ে গেলাম দ্যুতিময়।)
Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.