ছেউড়িয়ায় কয়েক বছর থাকার পর লালন তাঁর শিষ্যদের ডেকে বললেন, আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি তোমরা আমার সাধন কক্ষটার দেখাশুনা করো। সপ্তাহ তিনেক পর তিনি একটি অল্পবয়স্কা সুশ্রি যুবতিকে নিয়ে ফিরলেন। মতিজান ফকিরানী জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটি কে বাবা?
-তোমাদের গুরুমা।
একথা শোনার পর আঁখরাবাড়ির সকলেই গুরুমাকে ভক্তি করলেন। বিশখা নামের এই মেয়েটি সারাজীবন লালনের সাথে ছিলেন। লালনের মৃতর তিনমাস পর সেও মারা যায়। বিশখা ফকিরানী প্রায় একশো বছর ধরে ছেউড়িয়ায় ছিলেন কিন্তু তাঁর প্রকৃত নাম পরিচয় জানা যায়নি। এমনকি মৃতর পরও তাঁর কোন আত্মীয় বা পরিচিতজনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অচিন মানুষ ফকির লালনের মতোই বিশখা ফকিরানী আজো এক অচিন নারী।
ফকির লালন একদিন তাঁর সাধন ঘরে একা একা বসেছিলেন। এমন সময় খোকসা থানার কমলাপুর গ্রামের দুইজন ভক্ত এসে জানালেন যে তাঁদের গ্রামে কলেরা লেগেছে, সেখানকার ভক্ত ফকির রহিম শাহ্ তাঁর নাবালক পুত্র এবং স্ত্রীকে রেখে কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সব শুনে লালন খুব মর্মাহত হলেন। ফকির রহিম শাহের নাবালক পুত্র শীতলকে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন। বিশখা ও লালন তাঁকে পুত্র স্নেহে লালন পালন করতে লাগলেন। অন্যদিকে বেশ কয়েক বছর পর ফকির শুকুর শাহ্ তাঁর মাতৃহারা কন্যাকে লালনের কাছে নিয়ে আসেন, লালন সস্নেহে তাঁকে কোলে তুলে নিলেন এবং বিশখাকে বললেন- আজ থেকে এই শিশুটিও তোমার কন্যা। পরীর মতো সুন্দর এই মেয়েটিকে লালন পরী না বলে প্যারিনেছা বলে ডাকতেন। ভোলাই শাহ্ লালনের একান্ত শিষ্যদের অন্যতম, বাল্যকাল থেকেই সে আর শীতল একই ঘরে থাকতেন। ভোলাই শাহ্ বড় হয়ে কোন এক দোল পূর্ণিমার রাতে প্যারিনেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
ফকির লালনকে নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। একবার লালন তাঁর শিষ্যদের নিয়ে গঙ্গানদী পার হয়ে নবদ্বীপ গৌরাঙ্গ মহা প্রভুর ধামে পৌঁছেলেন। মন্দিরের লোকজন আগন্তকদের অদ্ভুত বেশভূষা দেখে তাঁদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো, লালনশিষ্য শীতল শাহ্ বললো আমরা কুষ্টিয়া থেকে এসেছি, সকলেই ফকির মতবাদের সাধক। তখন মহাপ্রভুর কাছে গিয়ে বলা হলো যে কুষ্টিয়া থেকে কিছু সাধক ফকির এসেছে যাদের বেশীরভাগ মুসলমান। মহাপ্রভু সবশুনে তাঁদের বসার ব্যবস্থা করতে বললেন। আঙিনার একপাশে বড় নিমগাছের তলায় তাঁদের জায়গা করে দেয়া হলো। সারারাতের অনুষ্ঠান শেষে সাধুগুরু এবং বস্টোমিদের সেবা দেওয়ার পর তাঁদের পালা এলো। যুবকের পিতলের থালাই করে শোয়াসের চুন নিয়ে এলো এবং সবাইকে বললো হাত পাতুন, মহাপ্রভুর প্রসাদ গ্রহণ করুন। চুনে মুখ পুড়ে যাবে এই ভয়ে শিষ্যরা কেউ হাত পাতলোনা বরং একযোগে ক্ষমা চাইলো।
যুবকেরা বললো আপনারা কেমন সাধু! চুনে মুখ পুড়ে যাবার ভয়ে কেউ হাত পাতলেন না। প্রকৃত সাধুদের তো মুখ পোড়ার কথা নয়!
লালন এক কোণায় বসেছিলেন, যুবকদের এই কথা শুনে বললো -
তোমরা কি চাও?
- তোমরা কেমন সাধু হয়েছো তা দেখতে চাই।
লালন যুবকদের কলার পাতা এবং একটি চাড়ি আনতে বললো। অতঃপর তিনি খানিক চুন কলা পাতায় রেখে বাকি চুন চাড়ি ভর্তি পানিতে গুলিয়ে দিলেন। এবার তিনি নিজেই কলাপাতার চুনগুলো খেয়ে ফেললেন এবং শিষ্যদের চাড়ি থেকে গ্লাসে করে চুনগোলানো শরবত খাওয়ালেন। তাঁরা সকলেই শরবত পানের তৃপ্তি লাভ করেন। এই শরবত পান চুনসেবা নামে পরিচিত।
লালন ঘোড়ায় চড়তেন, মাঝে মাঝে গভীর রাতে চাঁদের আলোতে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন, কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন তা তাঁর শিষ্যরা কেউ বলতে পারতোনা।