লালনের জীবন-কথা জানা সহজ না হইলেও অসম্ভব নয়। কারণ এখনও বহু বৃদ্ধ জীবিত আছেন যাঁহারা লালনের সন্মন্ধে অনেক খবরই রাখেন।
এদেশের অন্যান্য সাধু পুরুষদিগের জীবন অপেক্ষা লালনের জীবন-কথা জানা আরও সহজ এই জন্য যে, তাহাঁদের জীবনে যেমন নানারূপ অসম্বভ অলৌকিক কাহিনী দ্বারা পরিপূর্ণ, লালনের জীবন-কথা তেমন নহে। তাঁর শিষ্যেরা যদিও তাহাঁকে খুব ভক্তি করে কিন্তু তাহাঁকে খোদা বলিয়া জানে না। তাই লালনের জন্মস্থান বাপ-মা বাড়ি-ঘর তাহাঁদের ভক্তির উচ্ছাসে দ্বিতীয় নবদ্বীপ হইয়া উঠে নাই। এমনকি #লালন কোন জাতির ছেলে - কোথায় তাঁর বাড়ি-ঘর ইহাও তাঁহারা ভালো করিয়া বলিতে পারে না। তাঁহারা পাইয়াছে লালনের অসংখ্য গান সুখে দুঃখে একতারার সুরে সুরে সুর মিশাইয়া তাই লইয়া তাঁহারা সারাটি জীবন কাটাইয়া দেয়।
লালনের মৃতর পর কুমারখালির হিতকরি প্রত্রিকায় লালনের সন্মন্ধে একটি প্রবন্ধ বাহির হইয়াছিল। তাহাঁতে লালনের পূর্ব বৃত্তান্ত এইরুপঃ-
“সাধারণে প্রকাশ লালন ফকীর জাতিতে কায়স্থ। কুষ্টিয়ার অধীন চাপড়া ভৌমিক বংশীয়েরা ইহাদের জাতি। ইহার কোন আত্নীয় জীবিত নাই। ইনি নাকি তীর্থ গমন কালে পথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইয়া সঙ্গীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েন। পথে মুমূষ অবস্থায় একটি মুসলমানের দয়া ও আশ্রয়ে জীবন লাভ করিয়া ফকীর হন। ইহার মুখে বসন্তের দাগ বিদ্যমান ছিল।”
সম্প্রতি গত শ্রাবণ মাসে ‘প্রবাসী’তে বাবু বসন্তকুমার পাল মহোদয় তাঁর সন্মন্ধে যে সুন্দর প্রবন্ধ লিখিয়াছেন, তাহাঁতে এই বৃত্তান্তের অনুসরণ করা হইয়াছে। এমনকি তিনি লালনের পিতা-মাতা ও আত্নীয়-স্বজনের পরিচয় দিতেও কুন্ঠিত হন নাই। আমরা কিন্তু লালনের গ্রামের কাহারও কাছে এরূপ বৃত্তান্ত শুনি নাই। তাঁহার বাড়ীর পূর্ব-পার্শ্বের এক বৃদ্ধ তাঁতির কাছে আমরা লালনের জন্ম-বিবরণ এইরূপ শুনিয়াছিঃ-
তিনি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তাঁর মা তাঁকে সঙ্গে লইয়া তীর্থ করিতে নবদ্বীপে যান। সেখানে লালন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইলে অভাগিনী জননী তাঁকে নদীর ধারে ফেলিয়া আসেন। নদীর ঠাণ্ডা হাওায়ায় যখন শিশুর চৈতন্য ফিরিয়া আসিল তখন প্রভাত হইয়াছে। একটি মুসলমান মেয়ে জল আনিতে নদীতে যাইয়া অতটুকু ছেলেকে তখন পড়িয়া থাকতে দেখিয়া তাহাঁকে তুলিয়া বাড়ীতে লইয়া আসেন। তাঁহারই সেবাই যত্নে এই শিশু দিনের পর দিন বাড়িয়া উঠেন। উক্ত স্ত্রীলোকটির গুরু ছিলেন তৎকালিন যশোরের উলুবেড়িয়া গ্রামের সিরাজ সাঁই। শিশুটি একটু বড় হইলে সিরাজ সাঁই তাঁহাকে চাহিয়া লন এবং তাঁহারই শিক্ষার গুণে লালনের লেখাপড়া ও ধর্মজীবনের সুত্রপাত হয়; এবং কালক্রমে লালন মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হন।
বড় হইয়া তিনি নাকি তাঁর ব্রাহ্মণ মায়ের সাথে দেখা করেন। সমাজের ভয়ে দুঃখিনী মাতা চোখের জল মুছিতে মুছিতে তাঁকে বলেন, “বাছা তুই যখন মুসলমান হয়েছিস তখন সেইখানেই থাক। কেবল মাঝে মাঝে আমাকে দেখা দিস।” সেই মাতা যতদিন জীবিত ছিলেন লালন তাঁহাকে দেখিয়া আসিতেন। লালনের শিষ্য ভোলাই শাহ্র নিকট আমরা দুইটি ঘটনা বলিলে, তিনি বলিলেন, “অনেকে তাঁর সন্মন্ধে অনেক কথাই বলে বটে কেউ প্রকৃত ঘটনা জানে না।” যাহা হউক, আর কিছুদিন পরে লালন সন্মন্ধে কিছু জানা বিশেষ কষ্টকর হইবে জানিয়াই আমরা উপরোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করিলাম। কারণ, যেসব বৃদ্ধ আজও লালনের সন্মন্ধে কিছু কিছু জানেন তাঁহারা বেশিদিন বাঁচিয়া থাকবেন না। এই ঘটনাটি বিশ্বাস করিবার একটি কারণ আছে এই যে, লালনের সমস্ত গান পড়িয়া দেখিলে তাহাঁতে হিন্দু প্রভাব হইতে মুসলমান ধর্মের প্রভাব বেশী পাওয়া যায়। সম্প্রতি আমরা লালনের স্বহস্তলিখিত একখানা হাকিমী বই এবং মুসলমানি দোয়াকালাম লেখা একখানা খাতা পাইয়াছি। তাহা পড়িয়া মনে হয় লালন ফারসি কিংবা আরবি জানিতেন। তাঁর কোনো কোনো গানে কোরআন শরীফের অনেক আয়াতের অংশবিশেষ পাওয়া যায়। ইহাতে মনে হয় তিনি কোরআন শরীফ পড়িতে পারিতেন। এখন লালন যদি পরিণত বয়সে মুসলমান হইয়া থাকেন, তবে যেসব অশিক্ষিত সমাজের মধ্যে থাকিতেন, তাহাঁতে অত বয়সে মুসলমান শাস্ত্র এতটা যে তিনি কিরুপে আয়ত্ত করিয়া লইলেন সেটা ভাবিবার বিষয়। আর প্রবাসীর লেখক মহোদয় বলিয়াছেন, লালনের হিন্দু স্ত্রী তাঁহার অনুগামী হইতে নিতান্ত উৎসুক ছিলেন, কিন্তু আত্নীয়স্বজন তাঁহার সে ইচ্ছা পূর্ণ হইতে দেন নাই। আমরা লালনের শিষ্য ভোলাইর নিকট শুনিয়াছি লালন প্রসিদ্ধ খোনকার বংশে বিবাহ করেন। কিন্তু তাঁহার পূর্বধর্মের স্ত্রীর কথা তাঁরা কিছুই জানেন না।
লালন যখন তাঁর গানে ও জীবনের মহিমায় চারিদিকে বেশ নাম করিয়া তুলিলেন তখন কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামের অনেকেই তাঁর ভক্ত হইয়া পড়িল। একবার এখানে এখানকার তাঁতিরা তাঁকে গ্রামের মধ্যে একখানা ছোট ঘর বাঁধিয়া দিল এবং সেইখানেই তিনি বাস করিতে লাগিলেন। পরে তৎকালীন যশোরের উলুবেড়িয়ার অন্তর্গত হরিশপুর গ্রামের জমির খোনকারের কন্যা বিশোকার সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। ছেউড়িয়া গ্রামের একটি বৃদ্ধের কাছে শুনিয়াছি লালনের দুই স্ত্রী ছিলেন। কিন্তু ভোলাই শাহ্য়ের মতে লালনের এক স্ত্রী এবং লালনের কবরের পাশেই তাঁর কবর দেওয়া হইয়াছে। বিশোকা অতি বিনয়ী ছিলেন এবং লালনের ভক্তদের তিনি অতি যত্ন করিতেন।