সমকাল ও উত্তরকালে লালন সম্পর্কে ইতি ও নেতিবাচক দুই ধরনের সামাজিক প্রতিক্রিয়াই প্রবল হয়েছিল। যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছিলেন তিনি। লৌকিক বাংলার এই অসাধারন মনীষী-ব্যক্তিত্ব তাঁর সমকালেই সুধীসমাজের মনোযোগ ও শ্রদ্ধা আকর্ষণে সক্ষম হন। তাঁর প্রতি ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের সানুরাগ কৌতূহল তাঁর পরিচয়ের ভূগোলকে আরো প্রসারিত করে। লালনের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ অনুরাগী ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
লালনের জীবৎকালেই তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া সূচনা হয়। বাউল বা লালন বিরোধী আন্দোলনের তথ্য-খতিয়ান সংগ্রহ করলে এই প্রতিক্রিয়ার যথার্থ স্বরূপ উপলব্দধি করা যাবে।
জন্মলগ্ন থেকেই বাউল সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা নিন্দা নিগ্রহ বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কিংবা ‘রাগাত্নিকা পদে’ ইঙ্গিত আছে বাউল সম্প্রদায়ের প্রতি সেকালের মানুষের অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা কতো তীব্র ছিল। প্রকৃতপক্ষে শাস্ত্রাচারী হিন্দু আর শরীয়তপন্থী মুসলমান উভয়ের নিকট থেকেই বাউল অসহিঞ্জু আচরণ আর অবিচার অর্জন করেছে। উনিশ শতকে বাউল মতবাদ যেমন উৎকর্ষের শিখর স্পর্শ করে, আবার তেমনি পাশাপাশি এর অবক্ষয়ও আরম্ভ হয় এই সময় থেকেই। ওহাবি, ফারায়জি, আহলে হাদিস প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে এঁদের প্রতি অত্যাচার নিগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব অনেকাংশে বিপন্ন হয়ে পড়ে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮০-১৯৪৯), তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১), কারামত আলী জৌনপুরী (১৮০০-১৮৭৩), দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২), মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭), সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস রুমী (১৮৬৭-১৯২৩), প্রমুখ ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারকের উদ্যেগ-প্রচেষ্টায় বাউলমতের প্রভাব-প্রসার খর্ব-ক্ষুণ্ণ হয়। অনেকক্ষেত্রেই বাউলদের প্রতি আলেম সমাজের একটি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বাউল বা নাড়ার ফকির সম্পর্কে মুন্সী মেহেরুল্লাহর ধারণা ছিল, ‘বানাইল পশু তাঁরা বহুতর নরে’ (‘মেহেরুল ইসলাম’)। এই সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে মীর মশারফ হোসেনও বাউলদের সম্পর্কে আক্লেশে বলেছেন, ‘এরা আসল সয়তান, কাফের, বেঈমান/ তা কি তোমরা জান না’ (‘সঙ্গীত লহরী’)। কবি জোনাব আলি প্রচণ্ড আক্রোশে সরাসরি বলেছেন, ‘লাঠি মার মাথে দাগাবাজ ফকিরের’ (‘কাব্য মালঞ্চ’)। এ ছাড়া বাউল ফকিরদের বিরুদ্ধে রচিত হয়েছে নানা বই, প্রদত্ত হয়েছে নানা বিঁধান আর ফতোয়া।
প্রচলিত শাস্ত্রধর্মের বিরোধী ও মানবমিলনের প্রয়াসী লালনের জীবৎকালেই লালন বিরোধী আন্দোলনের সুত্রপাত্র। তাঁর মতবাদ ও সাধনা হিন্দু মুসলাম উভয় সম্প্রদায়ের শাস্ত্রবাদী ধর্মগুরু ও রক্ষণশীল সমাজপতিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে;- বারংবার তিনি হয়েছেন লাঞ্ছিত-অপমানিত-সমালোচিত। কিন্তু লালন ধীর, স্থির, লক্ষ্যগামী। কোনো অন্তরায়, প্রতিবন্ধকতায় তাঁকে নিরুৎসাহিত বা নিরুদ্ধ করতে পারেনি। সব বিরোধিতাকে তুচ্ছ করে তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়েছেন সত্যাভিমুখে-পরম প্রত্যাশিত মনের মানুষকে পাওয়ার আশায়। লালন গূঢ়-শুহ্য দেহবাদী সাধনার তত্ত্বজ্ঞ সাধক। তাই এসব দুঃখ-আঘাত-বেদনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তাঁর গানে সরাসরি প্রতিফলিত হয় নি।
কাঙ্গাল হরিনাথের সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকায়’ (ভাদ্র ১ম ১২৭৯/আগস্ট ১৮৭২) ‘জাতি’ শীর্ষক আলোচনায় লালন ফকির সন্মন্ধে প্রসঙ্গেক্রমে আলোকপাত করা হয়। হিন্দুসম্প্রদায়ের ‘জাতি’ বিপন্নতার জন্য লালন ও তাঁর সম্প্রদায়কে এখানে দায়ী করা হয়েছে। লালন জাতিভেদহীন হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনার যে অভিনব প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন হিন্দু সমাজনেতারা তা অনুমোদন করনে নি। ‘গ্রামবার্তা’র নিবন্ধকার মন্তব্য করেছেনঃ
১৯০০ সালে প্রকাশিত মৌলভী আবদুল ওয়ালীর On Curious Tenets and Practices of a certain Class of Faqirs in Bengal প্রবন্ধে লালন সম্পর্কে সামান্য ইঙ্গিত ও মন্তব্য আছে। এই প্রবন্ধে একস্থানে মুসলমান বাউল ফকিরদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
বাউল ফকিরদের সম্পর্কে সেকালে এই ছিল প্রায় সর্বজনীন ধারণা। বলাবাহুল্য বাউলশ্রেষ্ঠ লালনও এই ধারণার আওতামুক্ত ছিলেন না।
মুন্সী এমদাদ আলী (১৮৮১-১৯৪১) প্রনীত ‘রদ্দে নাড়া’ (অপ্রকাশিতঃ ২৪ আষাঢ় ১২২৪) পুথিতে বাউল বা ‘নাড়ার ফকির’দের বিশদ পরিচয় দিয়ে তাঁদের তীব্র নিন্দা-সমালোচনা করা হয়েছে। লেখক প্রসঙ্গক্রমে পুথির ভুমিকায় লালন শাহের নামোল্লেখ করে বলেছেনঃ
লেখক এরপর বাউল বা নাড়াধর্ম সম্পর্কে উল্লেখ করেছেনঃ
রংপুর জেলার বাঙ্গালীপুর নিবাসী মওলানা রেয়াজউদ্দিন আহমদ ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’ অর্থাৎ ‘বাউলমত ধ্বংস বা রদকারী ফৎওয়া’ প্রণয়ন ও প্রচার করেন। বাংলা ১৩৩২ সালে এই ‘ফৎওয়া’র দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বাংলার প্রখ্যাত ওলামা ও নেতৃবৃন্দ এই ফতোয়া সমর্থন ও অনুমোদন করেছিলেন। ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’র ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৩৩ সালে। ২য় খণ্ডের প্রধান উল্লেখ্য বিষয় হলো লালন সাঁই সম্পর্কে মন্তব্যসহ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রকাশ। এতে লালন সম্পর্কে মুসলিম সমাজ ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মনোভাব ও দৃষ্টি ভঙ্গির যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ফৎওয়া’র এই ২য় খন্ডে বসন্তকুমার পালের ‘ফকির লালন শাহ্’ (‘প্রবাসী’, শ্রাবণ ১৩৩২) প্রবন্ধটি উদ্ধত করে মন্তব্য করে হয়েছেঃ
‘লালন সাহার পরিচয় ত ইহাই দাঁড়াইল কিন্তু বাউল, ন্যাড়ার ফকিরগন লালন শাহ্ সন্মন্ধে কোনই পরিচয় না জানিয়া হুজুগে মাতিয়া হিন্দু বৈষ্ণবগনের দেখাদিখি লালন সার পদে গা ঢালিয়া দিয়া মোছলমান সমাজের কলঙ্কস্বরূপ হইয়াছে ইহা অতিশয় পরিতাপের বিষয় তাহাঁদের ধাঁধা এখন ঘুচিবে কে ?’
চলিবে ...