বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালন ফকিরের সাধনা - মুচকুন্দ দুবে
লালন ফকিরের সাধনা - মুচকুন্দ দুবে

বাউলরা গান লিখে রাখায় বিশ্বাসী নয়। ঘূরে বেড়াতে বেড়াতে তারা গান সাধে আর অপার্থিব অনুভূতি লাভ করে।

বাউল শব্দটি ‘বাউরা’ বা ‘বাউলা’ শব্দের বাংলা অপভ্রংশ। উত্তর ভারতে ‘বাউলা’ শব্দটি দিয়ে পাগলশ্রেণীর লোকদের বোঝানো হয়। ভোজপুরি আঞ্চলিক ভাষায় পাগলামি শব্দটির ক্রিয়াবাচক পদ হোল ‘বাউরানা’। সমকালীণ ঐতিহ্যের মানদণ্ডের বাউলরা ছিল বিরুদ্ধবাদী এ কারনেই তারা বাউল বা ছিটগ্রস্থ বলে পরিচিত লাভ করে।

১০ বছর ধরে লালন অব্যাহতভাবে তাঁর গান রচনা করে গিয়েছিলেন। সেগুলো শোধরানোর জন্য আর ফিরে তাকাননি। কেউ সেগুলো লিপিবদ্ধও করেনি। তাঁর জীবদ্দশায় কিছুই ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়নি। লালনের মৃত্যুর পর শুরু হয় তাঁর সংগ্রহের কাজ। এখন পর্যন্ত তার অনেক গান প্রকাশিত হয়নি এবং আরও অনেক অনেক গান সম্ভবত চিরতরে হারিয়ে গেছে। লালনের গানের কোন নির্ভরযোগ্য পাণ্ডূলিপি আজও পাওয়া যায়নি। যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলো হয় প্রতিলিপি নতুবা প্রতিলিপির প্রতিলিপি। বাংলা সাহিত্যের সুখ্যাত লেখক শ্রীঅন্নদাশঙ্কর রায় বাউল-সাধনার বিভিন্ন উৎসধারার অনুসন্ধান করে দেখিয়েছেন- ইসলামী সূফীবাদ, হিন্দু বৈষ্ণববাদ আর বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনা এই তিন স্রোত এসে বাউলধারায় মিশেছে। লালনের গানে রসূল (সঃ), নবী, আল্লাহ্‌ এবং নিরাকার পরমের উল্লেখ সূফিপ্রভাবের প্রতিফলন।

পারে কে যাবি, নবীর নৌকাতে আয়


কিংবা

কি কবো পড়শীর কথা
ও তার হস্ত পদ স্কন্দ মাথা নাই রে



লালনের গানে বৈষ্ণবধারার প্রভাব লক্ষ করা যায় গোরা অর্থাৎ চৈতন্য মহাপ্রভু এবং কৃষ্ণের উল্লেখে। ‘কৃষ্ণ’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘কালা’ তাঁর গানে ঘুরে ফিরে উল্লেখিত হয়েছে। নিচের গানটি লালনের সবচেয়ে সুললিত এবং সংবেদশীল গানগুলোর একটিঃ-

আর আমারে মারিস নে মা
বলি মা তোমায় চরন ধরে
ননি চুরি আর করবো না



লালনের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী এই তিন ধর্মীয় মতধারার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ধারাটি হল সহজিয়া পথ; মানুষের মধ্যেই পরমকে দেখার, অনুধাবন করার পথ। লালন কখনো সেই পরমকে বলেছেন “মনের মানুষ” কখনো বলেছেন ‘অচিনপাখি’, কখনো “অজানা মানুষ”, কখনো বা অধরা চাঁদ। সহজিয়া মতাদর্শ অনু্যায়ী মানুষ নিজেকে অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরকে জানতে পারে। সামগ্রীকভাবে মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। এই বিশ্বাস চণ্ডীদাসের মতো এমন চমৎকার ভাবে আর কে-ই বা ঘোষনা করতে পেরেছেঃ-

শূন্য মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই



মানুষ আর ঈশ্বরের এই সম্পর্কের বিষয়টি লালনের চিরঞ্জীব গানের চরণে প্রকীর্ণ হয়ে আছেঃ-

মিলন হবে কতো দিনে
আমার মনের মানুষের সনে



কিংবা,

ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার



কিংবা,

আপনারে আপনি রে মন না জানো



অথবা এই গানটিতে –

এই মানুষে সে মানুষ আছে
কতো যোগী ঋষি চার যুগ ধরে রে
তারে বেড়াচ্ছে খুঁজে



সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রেও বাউলদের বিরাট ভূমিকা ছিল। শ্রীঅন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেনঃ-

তার সাধনা ধর্মীয় নয়, মানবিক। সাধকরা পরমাত্মার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক চান, কিন্তু পরলোক সম্বন্ধে উদাসীন। স্বর্গে যাবার জন্য তাদের ব্যাকুলতা নেই, নরকে যাবার ভয়ে তাঁরা ভীত নন। এই দেহ আর এই জীবন আর এই মাতভুমি নিয়েই তাদের গানের জগৎ।

তিনি আর লিখেছেন, ভারতে শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে যে সময় একটি রেনেসাঁর উদ্ভব হচ্ছে, ঠিক তখনই পল্লীর জনগনের প্রানের মধ্যে আরেকটি আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় রেনেসাঁর এই দুই ধারার সম্পর্কটির দিকে ইতিহাস মননিবেশ করেনি। ইতিহাসের এ অলিখিত অংশটি যেদিন লিপিবদ্ধ হবে, লালনকে সেদিন যথাযথ পরিপেক্ষিতে দেখার অবকাশ মিলবে।

অন্নদাশঙ্কর রায় আরো বলেছেন, বাংলার মানুষে অন্তরে লালনের এ রেনেসাঁর প্রভাব রাজা রামমোহন রায়ের প্রভাবের চেয়ে কম নয়।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.