Select your language

পি আর পদ্ধতি কী: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
পি আর পদ্ধতি কী: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
  • Sub Title: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যে ভোট জনগণ দেয়, তা কি সংসদে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়? বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে পদ্ধতি অনুসৃত হয়, তা হলো ‘একক সদস্যভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতি’ (First Past The Post - FPTP)

এই পদ্ধতিতে প্রতিটি আসনে যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পায়, সে-ই বিজয়ী হয়। ফলত অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোনো প্রার্থী মোট ভোটের অর্ধেকেরও কম ভোট পেয়ে সংসদে নির্বাচিত হচ্ছেন, আর বাকি ভোটগুলোর কোনো বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে না।

এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও গণতান্ত্রিক চর্চায় বিকল্প হিসেবে এসেছে পি আর (Proportional Representation) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি

পি আর পদ্ধতি কী

পি আর বা Proportional Representation হলো এমন এক ভোটব্যবস্থা, যেখানে সংসদ বা প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থায় আসন বণ্টন হয় প্রতিটি দলের প্রাপ্ত মোট ভোটের আনুপাতিক হারে। অর্থাৎ, একটি দল জাতীয়ভাবে মোট ভোটের ৪০% পেলে সংসদেও তারা আনুমানিক ৪০% আসন পাবে।

উদাহরণ:

ধরা যাক, কোনো দেশে সংসদের মোট আসন ৩০০টি।

নির্বাচনে ভোটের ফলাফল হলো—

  • দল ‘ক’ পেয়েছে ৪৫% ভোট
  • দল ‘খ’ পেয়েছে ৩৫% ভোট
  • দল ‘গ’ পেয়েছে ১৫% ভোট
  • স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ৫% ভোট

পি আর পদ্ধতিতে আসন বণ্টন হবে এভাবে:

  • দল ‘ক’ → ৩০০-এর ৪৫% = ১৩৫টি আসন
  • দল ‘খ’ → ৩০০-এর ৩৫% = ১০৫টি আসন
  • দল ‘গ’ → ৩০০-এর ১৫% = ৪৫টি আসন
  • অন্যান্য → ১৫টি আসন

এভাবে জনগণের প্রতিটি ভোট সংসদে প্রতিফলিত হয়। কোনো ভোট ‘নষ্ট’ হয় না, এবং ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রবেশের সুযোগ থাকে।

পি আর পদ্ধতির ধরন

বিশ্বজুড়ে পি আর পদ্ধতির কয়েকটি ভিন্ন রূপ চালু আছে। প্রধান কয়েকটি হলো—

  1. লিস্ট সিস্টেম (List System)
    • এখানে প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের প্রার্থীদের একটি তালিকা দেয়।
    • ভোটার দলকে ভোট দেয়, ব্যক্তিকে নয়।
    • দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে তালিকা অনুযায়ী প্রার্থীরা নির্বাচিত হন।
    • উদাহরণ: নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইসরায়েল।
  2. মিক্সড মেম্বার প্রোপোরশনাল (MMP) সিস্টেম
    • এখানে সংসদের একটি অংশ নির্বাচিত হয় FPTP অনুযায়ী, আর বাকিটা হয় পি আর আনুপাতিক হারে।
    • জার্মানি, নিউজিল্যান্ড এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
  3. সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট (STV)
    • ভোটার পছন্দক্রমে প্রার্থী নির্বাচন করে।
    • ভোট স্থানান্তরযোগ্য, অর্থাৎ প্রথম পছন্দ বাদ পড়লে দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থী ভোট পায়।
    • এটি তুলনামূলক জটিল, কিন্তু ভোটার-ইচ্ছার প্রতিফলন বেশি দেয়।
    • উদাহরণ: আয়ারল্যান্ড, মাল্টা।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে পি আর পদ্ধতি

বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৮০টিরও বেশি দেশ কোনো না কোনোভাবে পি আর পদ্ধতি ব্যবহার করে।

  • ইউরোপের অধিকাংশ দেশ যেমন সুইডেন, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস — আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে বিশ্বাসী।
  • দক্ষিণ আফ্রিকা পি আর পদ্ধতি চালু করার পর সেখানে বিভিন্ন জাতিগত ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • নিউজিল্যান্ড ১৯৯৬ সালে FPTP থেকে মিক্সড পি আর পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়, যার ফলে সংসদে নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে বর্তমানে সংবিধান অনুযায়ী (ধারা ৬৫), সংসদে ৩০০টি সাধারণ আসন সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়, অর্থাৎ FPTP পদ্ধতিতে

এই ব্যবস্থার কিছু সীমাবদ্ধতা হলো—

  1. কোনো দল সামগ্রিকভাবে কম ভোট পেয়ে সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে।
  2. ছোট দলগুলোর সংসদে প্রতিনিধিত্ব প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
  3. আঞ্চলিক ভোটের বিভাজন জাতীয় প্রতিফলন নষ্ট করে দেয়।

উদাহরণ:

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল মোট ভোটের প্রায় ৪৮.০৪%, কিন্তু আসন পেয়েছিল ২৬৩টি (৮৭.৬৬%)। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.২০% ভোট, কিন্তু আসন পেয়েছিল মাত্র ৩০টি (১০%)।

এই বিশাল ব্যবধান ভোট ও আসনের অনুপাতের অসমতার দিকটি স্পষ্ট করে।

সূত্র: বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (EC, 2008)।

পি আর পদ্ধতি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে পি আর পদ্ধতি চালু করলে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হতে পারে—

  1. ভোটের যথাযথ প্রতিফলন: জনগণের প্রতিটি ভোট সংসদে প্রভাব ফেলবে। এতে গণতন্ত্রের ভিত্তি আরও মজবুত হবে।
  2. ছোট দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি: ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হলে রাজনৈতিক মতের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাবে।
  3. রাজনৈতিক সহাবস্থান বৃদ্ধি: জোট সরকার গঠনের প্রবণতা বাড়বে, যা পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা বাড়াতে পারে।

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

তবে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বাস্তবতায় পি আর পদ্ধতি চালু করতে কিছু জটিলতাও আছে—

  1. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: জোট সরকারে নীতিগত ভিন্নতা থাকায় স্থিতিশীলতা কমে যেতে পারে।
  2. প্রশাসনিক জটিলতা: নতুন ভোটগণনা ও আসন বণ্টন প্রক্রিয়া চালু করতে সাংবিধানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।
  3. আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের ঘাটতি: পি আর পদ্ধতিতে ভোট জাতীয় পর্যায়ে গণনা হলে স্থানীয় ইস্যুগুলোর প্রতিনিধিত্ব কমে যেতে পারে।

নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নুরুল আমিন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) মনে করেন,

“বাংলাদেশের মতো বহুদলীয় গণতন্ত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালু করা হলে সংসদে বৈচিত্র্য আসবে, তবে তা বাস্তবায়নের আগে প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি।”

অন্যদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD) –এর এক বিশ্লেষণ রিপোর্টে বলা হয়,

“বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে আংশিক আনুপাতিক (Mixed) পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে প্রবর্তন করা যেতে পারে।”

সূত্র:

    • Bangladesh Election Commission Reports, 2008–2024
    • CPD Working Paper on Electoral Reform, 2022
    • IDEA Handbook of Electoral Systems, 2021

পি আর পদ্ধতি কোনো জাদুকরি সমাধান নয়, তবে এটি এমন এক ব্যবস্থার প্রতিফলন যেখানে প্রতিটি ভোটের সমান মূল্য থাকে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই পদ্ধতির প্রয়োগ এখনো দূরবর্তী, কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতে নীতিনির্ধারকরা এটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন।

গণতন্ত্রের প্রকৃত সার্থকতা তখনই আসবে, যখন ভোটের প্রতিটি কণ্ঠ সংসদে প্রতিধ্বনিত হবে—এটাই পি আর পদ্ধতির মূল দর্শন।

📎 সূত্রসমূহ:

      1. Bangladesh Election Commission, Official Results Archive (2008–2024)
      2. CPD Working Paper on Electoral Reform (2022)
      3. IDEA: International Institute for Democracy and Electoral Assistance (2021)
      4. Dr. Nurul Amin, “Electoral Reform in Bangladesh: Challenges and Choices,” Dhaka University Journal, 2023
      5. New Zealand Electoral Commission (2020): Mixed Member Proportional System Overview

প্রযুক্তি এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন