দিনের বেলা হোক বা পূর্ণিমার রাত একেক সময় তাজমহলের সৌন্দর্য্য একেক রকম। আগ্রার এই প্রাচীন স্মৃতিসৌধের নির্মাতা মুঘল সম্রাট শাহজাহান স্বয়ং। তাঁর নির্দেশেই প্রয়াত স্ত্রী মুমতাজের স্মৃতিতে এই সৌধ নির্মিত হয়। কেউ বলেন স্ত্রীর প্রতি সম্রাটের ভালোবাসার নিদর্শন এই মহল। কারও মতে অত্যাচারিত স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনুশোচনার জেরে এই মহল নির্মাণ করেন সম্রাট। এসব নিয়ে নানা মুনির নানা মত। শ্বেত পাথরের তৈরি এই স্মৃতি সৌধের আনাচ কানাচে লুকিয়ে রয়েছে নানা তথ্য, নানা রহস্য, নানা অজানা ইতিহাসের কথা।
পূর্ণিমার রাতে তাজমহলের সৌন্দর্য্য ভাষায প্রকাশ করা যায় না। এক বিন্দু নয়নের জল কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল।
তাজমহলের সৌন্দর্য্য বর্ণনা করতে গিয়ে এমন উপমাই দিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে সত্যি কথা বলতে কী, যতই বর্ণনা শুনু না কেন তাজমহল প্রকৃতপক্ষে কতটা সুন্দর তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। বিশ্বের এই সপ্তমাশ্চর্যকে একবার চোখের দেখা দেখতে হাজার হাজার বিদেশি এদেশে আসেন। দেশিয়রাও তাজ দেখার লোভ সামলাতে পারেন না। দিনের বেলা হোক বা পূর্ণিমার রাত একেক সময় তাজের সৌন্দর্য্য একেক রকম। সেই সেকাল থেকে শুরু করে একাল তাজমহলের সামনে গিয়ে ছবি তোলার লোভ পর্যটকরা সামলাতে পারেন না।
আগ্রার এই প্রাচীন স্মৃতিসৌধের নির্মাতা মুঘল সম্রাট শাহজাহান স্বয়ং। তাঁর নির্দেশেই প্রয়াত স্ত্রী মুমতাজের স্মৃতিতে এই সৌধ নির্মিত হয়। কেউ বলেন স্ত্রীর প্রতি সম্রাটের ভালোবাসার নিদর্শন এই মহল। কারও মতে অত্যাচারিত স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনুশোচনার জেরে এই মহল নির্মাণ করেন সম্রাট। এসব নিয়ে নানা মুনির নানা মত। শ্বেত পাথরের তৈরি এই স্মৃতি সৌধের আনাচ কানাচে লুকিয়ে রয়েছে নানা তথ্য, নানা রহস্য, নানা অজানা ইতিহাসের কথা
একাধিক বেগমের বাদশাহ শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী মুমতাজ বেগমের সঙ্গে সম্রাটের বিবাহিত জীবন ছিল ১৯ বছরের। অথচ মাত্র ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনে মুমতাজ শাহজাহানের ১৪টি সন্তান প্রসব করেন। বলাবাহুল্য এই কারণেই তিনি ছিলেন শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। শারীরিক ধকল সহ্য করতে না পেরে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে প্রাণ হারান মুমতাজ বেগম।
এই তৃতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পরেই তাঁর স্মৃতিতে ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাজমহল তৈরি শুরু করেছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে তাজ নির্মাণ যুক্ত ছিলেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। মহল তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর। তাজমহল বানানোর কাজ শেষ হয় ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। যদিও এরপরে ছোটখাটো কাজ সম্পন্ন করতে আরও দুই বছর সময় লাগে। এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা।
সৌধ জুড়ে আল্লাহ-র নাম
তাজমহলের দেওয়ালে যে সকল হস্তলিপির ব্যবহার করা হয়েছিল তা বেশিরভাগই মুসলিম ধর্ম গ্রন্থ কোরাণ শরিফ থেকে নেওয়া হয়েছিল। তাজমহলের দেওয়াল ছাড়াও মুমতাজ মহল এবং সম্রাট শাহজাহানের সমাধিতে এইরূপ শ্লোকগুলি খোদাই করা হয়েছিল। তাজমহলের বিভিন্ন স্থানে ক্যালিগ্রাফি শিলালিপি হিসেবে আল্লাহ-র ৯৯টি ভিন্ন নাম খোদাই করা রয়েছে।
২০০৭ সালে ইউনেস্কো (UNESCO) ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তাজমহলকে বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যের তালিকাভুক্ত করে। ১০ কোটি ভোটের মাধ্যমে এই স্থান দখল করে তাজমহল। ভারতের সবচেয়ে দর্শনীয় এবং সুন্দর স্মৃতিস্তম্ভগুলির মধ্যে থাকা তাজমহল দেখতে প্রতি বছর প্রায় ৪০ থেকে ৮০ লক্ষ দর্শনার্থী ভারতে আসেন। বিশেষ বিশেষ সময়ে দিনে ৪০ থেকে ৫০ হাজারেরও বেশি দর্শনার্থী এই স্মৃতিসৌধ দর্শন করে থাকেন।
তাজমহল নির্মাণ
তাজমহল নির্মাণ করার জন্য যেসকল সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলি প্রধাণত ভারত এবং সমগ্র এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই সকল নির্মাণসামগ্রী পরিবহণের জন্য নাকি ১০০০-এরও বেশি হাতির ব্যবহার করা হয়েছিল। তাজমহল নির্মাণ করার জন্য যেসকল মার্বেল পাথরের প্রয়োজন হয়েছিল তা প্রধানত বিভিন্ন দেশ এবং ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে কেনা হয়েছিল।
এর মধ্যে স্বচ্ছ সাদা মার্বেলটি রাজস্থানের মাকরানা নামক স্থান থেকে কেনা হয়েছিল। জেট এবং স্ফটিক কেনা হয়েছিল চিন থেকে। পঞ্জাব থেকে কেনা হয়েছিল জেম্পার। আফগানিস্তান থেকে ল্যাপিস লাজুলি। আরব থেকে কার্নেলিয়া। এবং তিব্বত থেকে কেনা হযেছিল ফিরোজা নামক মার্বেল পাথর।
গোরস্থান রহস্য
শুধুমাত্র মুমতাজ-ই নন, তাজমহলে সমাহিত করা হযেছিল শাহজাহানের অন্যান্য স্ত্রী এবং প্রিয় চাকরদের। তবে সেগুলি রয়েছে তাজমহলের বাইরের অংশে। তাজমহলের প্রায় সমস্ত স্থান প্রতিসম হলেও কবরস্থানটি প্রতিসম নয়। ইসলামিক ঐতিহ্য অনুযায়ী কবরকে কখনও সাজানো উচিত নয়। সম্ভবত এই কারণেই শাহজাহান এবং মুমতাজকে তাজমহলের অভ্যন্তরীণ কক্ষে নীচে একটি সমতল সমাধিগৃহে সমাহিত করা হয়েছিল।
তাজমহলে অভ্যন্তরে একটি প্রদীপে লর্ড কার্জনের নাম খোদাই করা আছে। সেই পাথরের ওজন প্রায় ৬০ কেজি এবং এটি তাজমহলের মূল দরজার একদম সামনে রাখা আছে। যাতে দর্শনার্থীরা তাজমহলের প্রবেশ করেই এটা দেখতে পান।
তাজমহলের চারটি স্তম্ভ বা মিনার সোজা হয়ে না দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে একটু কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম তৈরির পিছনে প্রধান কারণ হল ভূমিকম্পের মতো কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন এর কোনোরকম ক্ষতি না করতে পারে
যুদ্ধের সময় লুকিয়ে ছিল তাজ
অনেকেই মনে করে যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় কিছুসংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য সমাধির দেওয়াল থেকে মূল্যবান পাথর গুলি নিয়ে নিয়েছিল।
যাতে ধ্বংস করা না হয় তার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তরফে তাজমহলকে বাঁশের খাঁচা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হযেছিল। উপর থেকে একে দেখতে লাগছিল বাঁশের মজুদের মতো। একই রকম ভাবে তাজকে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়।
শতকের পর শতক ধরে, ভালোবাসার এই স্মৃতিস্তম্ভটি অবহেলা বা অবনতির সম্মুখীন হয়েছে। ইন্দো ইসলামিক স্থাপত্য গুলির মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ স্থাপত্য হল তাজমহল। এর নির্মাণ এতটাই নিখুঁত ও সৌন্দর্যময় যা সব স্থাপত্য থেকে এটিকে আলাদা করে। রয়েছে পৌরানিক কাহিনির ঘনঘটা। এই বিশ্ববিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য রয়েছে, যা সকলের জানা দরকার। সেগুলি দেখে নিন একঝলকেঃ-
# তাজমহল নির্মাণ ১৬৩২ সালে শুরু হয়েছিল এবং ১৬৫৩সালে শেষ হয়েছিল। এই স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে মোট ২২ বছর সময় লেগেছিল।
# তাজমহলের স্থাপত্য হল ভারতীয়, ফরাসি এবং ইসলামিক শৈলীর স্থাপত্যের সংমিশ্রণ।
# তাজমহলের স্থপতির নাম আহমেদ লাহৌরি।
# তাজমহল নির্মাণ সম্পূর্ণ করার জন্য প্রায় ২০ হাজার মানুষ বাইশ বছর ধরে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন।
# তাজমহল নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ৩২০ মিলিয়ন রুপি।
# রাজস্থান, তিব্বত, আফগানিস্তান এবং চিন থেকে সেরা মানের মার্বেল ব্যবহার করে তাজমহল নির্মিত হয়েছিল।
# দিনের বিভিন্ন সময়ে তাজমহলকে ভিন্ন রঙে দেখা যায়। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে এই পরিবর্তিত রংগুলি একজন মহিলার পরিবর্তনশীল মেজাজকে চিত্রিত করে।
# তাজমহল বিশ্বের বিস্ময়গুলির মধ্যে একটি এবং এটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে চিহ্নিত।
# একটি জনপ্রিয় মিথ ছিল যে শাহজাহান যমুনার ওপারে একটি কালো তাজমহল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন, এটি সত্য নই।
# তাজমহলকে ঘিরে আরেকটি জনপ্রিয় কল্পকাহিনি রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল, তাজমহল নির্মাণের পর শাহজাহান সমস্ত শ্রমিকের হাত কেটে ফেলেন যাতে এই ধরনের স্থাপনা আর তৈরি না হয়। ভাগ্যক্রমে, এটি সত্য নই।
# তাজমহলের প্রাঙ্গনে একটি মসজিদ রয়েছে, যে কারণে তাজমহল শুক্রবারে বন্ধ থাকে এবং শুধুমাত্র প্রথাগত প্রার্থনার জন্য যাওয়া ব্যক্তিদের তাজমহলের ভিতরে অনুমতি দেওয়া হয়।
# ১৯ শতকের শেষের দিকে, তাজমহলটি ব্রিটিশ সৈন্যদের দ্বারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। স্মৃতিস্তম্ভের দেয়াল থেকে মূল্যবান পাথর বের করা হয়েছিল। ১৯ শতকের শেষের দিকে, ব্রিটিশ ভাইসরয়, লর্ড কার্জন স্মৃতিস্তম্ভটি পুনরুদ্ধারের আদেশ দেন এবং তাজমহলের অভ্যন্তরীণ কক্ষে ঝুলানো একটি বড় বাতিও উপহার দেন।
# ২০০০ সালে, একজন ভারতীয় লেখক পি.এন. ওক দাবি করেছিলেন যে তাজমহল আসলে একটি শিবমন্দির ছিল এবং প্রমাণের জন্য তাজের স্থান খনন করার জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেছিলেন। তার আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
# ২০০১ সালে, ইউনেস্কো তাজমহলে দুই মিলিয়নেরও বেশি দর্শকের নথিভুক্ত করেছে।
# ভারতের নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাজমহলকে “কালের গালে অশ্রুবিন্দু” হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
# মমতাজের সমাধিতে ক্যালিগ্রাফি করে তাকে চিহ্নিত করে এবং প্রশংসা করে।
# তাজমহলের চারটি মিনার একটু বাইরে তৈরি করা হয়েছে যাতে মিনারগুলি পড়ে গেলে মূল কাঠামোর উপর না পড়ে দূরে পড়ে যায়।
# মৃত্যুর পর, শাহজাহানকে তার স্ত্রী মমতাজের সমাধির পাশাপাশি তাজমহলে শায়িত করা হয়েছিল।