বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

আধ্যাত্মিক সাধক হযরত আবুল হোসেন শাহ (রঃ) সত্য প্রচারে এক উজ্জল নক্ষত্র
আধ্যাত্মিক সাধক হযরত আবুল হোসেন শাহ (রঃ) সত্য প্রচারে এক উজ্জল নক্ষত্র

বাংলাদেশের অনেক আউলিয়াগণের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও সূফী সাধক হযরত মাওলানা আবুল হোসেন শাহ (রঃ) মানব কল্যাণে ও সত্য প্রচারে এক উজ্জল নক্ষত্র। যিনি মহান স্রষ্টার বাণী প্রচার, রাসূল (সাঃ)এঁর আদর্শ-গুণাবলী ধারণ করাসহ ওলি-আউলিয়াগণের সত্য পথ অবলম্বনে মানব মুক্তির পথে আমরণ কাজ করে গেছেন। একজন কামেল মুর্শিদ, ঈমাম ও আল্লাহর ওলী হিসেবে পরিচিত এই মহান আধ্যাত্মিক সাধক আরবী, ফারসী, উর্দু, হিন্দী ও বাংলা এই পাঁচটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। মানব কুলে তিনি দীর্ঘ ১০২ বছরের বেশী জীবনকাল অতিবাহিত করেছেন। এই মনীষী সারা জীবন ইবাদত ও ধ্যানের মধ্যে দিয়ে সর্বদা মানবতার সত্য ধর্ম প্রচারে ব্রত ছিলেন।

স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টি কুলের মঙ্গলার্থে জগতে যতদিন আল্লাহর ওলী-আওলিয়াগণ পাঠাবেন ততদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকে থাকবে। আহলে বায়েত (আঃ)-পাক পাঞ্চাতন তথা অল্লাহর আউলীয়াগণের মহব্বতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে-গোপনে অবস্থান করা মনীষী ও সাধকদের মত তিনিও ধর্মের সত্য ও নিগুর রহস্যের কথা প্রচার করে গেছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনের ধ্যান-সাধনার অমিয় সুধা, বিনয়, নম্রতা ও কোমল ছোঁয়ায় বহু দিশাহীন মানুষ খুঁজে পেয়েছেন প্রশান্তির পথ।

আল্লাহর প্রেরিত এই মহামানব তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত বর্ষ তথা পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পশ্চিমাবঙ্গের অন্তরর্গত বর্ধমান বিভাগের হুগলী জেলার ভাদলপুর নামক গ্রামে ১১ই এপ্রিল, ১৯১৭ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন ও মাতা মহিয়সী জান্নাতুল ফেরদৌস। শিশুকালের ৩ বছর বয়সে মা ও ১২ বছর বয়সে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। এরপর ভাষা পন্ডিত তাঁর স্বীয় চাচা মৌলভী (মাওলানা সৈয়দ কুতুব উদ্দিন ) এঁর কাছে বড় হন। প্রথম জীবনে ধর্মীয় ব্যবহারের বিভিন্ন জিনিসপত্রাদী খুচরা ও পাইকারী ব্যবসার মধ্য দিয়ে জীবিকার পথ খুঁজে নেন। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি ভারত রাজ্যের ধর্মীয় বিভিন্ন স্মৃতিমূলক স্থান ভ্রমণ ও মানব মুক্তির শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিশু ও যুবক কালে আপন পিতা ও মৌলভী চাচার নিকট থেকে পবিত্র কুরআন শিক্ষার মর্মার্থ ও বিভিন্ন ভাষার উপর দক্ষতা তাঁর ধর্মীয় গবেষণার কাজকে আরো এগিয়ে দেয় । তারপর ধর্মের সত্যতা প্রচারে ভারত থেকে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া শহরের দেশওয়ালীপাড়া (মিলপাড়া) আসেন। এখানে প্রায় দীর্ঘকাল যাবৎ তিনি এশিয়ার বৃহত্তম কাপড়ের মিল কুষ্টিয়া মোহিনীমিলের মেশিন অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি কুষ্টিয়ায় চাকুরীর পাশাপাশি নিজ এলাকাতে (দেশওয়ালীপাড়া-মিলপাড়া) একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন ও প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সেখানে বিনা পারিশ্রমীকে ঈমামতিও করেন। এরপর উক্তস্থানে হঠাৎ একদিন তৎকালীন অবিভক্ত ভারত হতে আগত তথা সেই সময়ের ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মনিরামপুর মাচাইন গ্রামে বসবাসরত কামেল মুর্শিদ ও চিশতীয়ার নিজামিয়া গোড়-এঁর পীর মাওলানা সোলেমান আলী শাহ (রঃ)এঁর আগমন ঘটে। মাওলানা সোলেমান আলী শাহ (রঃ) ছিলেন তথা ঢাকা মানিকগঞ্জ ঝিটকা শরীফ কলাহাটা আস্তানার কামেল মুর্শিদ দেওয়ান আহম্মদ কওছার আলী শাহ (রঃ) এঁর দেওয়া মনোনীত ও প্রধান খলিফা । উল্লেখ্য, দেওয়ান আহম্মদ কওছার আলী শাহ (রঃ) ভারতের বেলেঘাটা খোদাগঞ্জ রোডে মাজার শরীফ আওলিয়া হযরত সাফাতুল্লাহ শাহ (রঃ) এঁর প্রধান খলিফা ও জামাতা ছিলেন। অতঃপর অখন্ড ভারত বর্ষ থেকে কুষ্টিয়া শহরের দেশওয়ালীপাড়ায় (মিলপাড়া) এসে অবস্থান কালে হযরত মাওলানা আবুল হোসেন শাহ (রঃ) তাঁর মুর্শিদের নিকট বইয়াত গ্রহণ করেন। এরপর তিনি স্বীয় ওস্তাদ মাওলানা সোলেমান আলী শাহ (রঃ)এঁর নিকট খেকে তাসওয়াফ ও প্রেমের পরশে আধ্যাত্মিক শক্তি, বাতেনী ইলম অতঃপর তাঁর মুর্শিদের সবচেয়ে অতি আপন ও নিকটতম সাথী হিসেবে ইলমে মারিফতের উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হন। আল্লাহর ওলির গুণকীর্তি, জ্ঞান-ধ্যান, আমল, কেরামতির পরিধি লিখে কখনো শেষ করা যায় না। কারণ তাদের প্রতি সবসময় মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত থাকে।

আধ্যাত্মিক সাধক মাওলানা আবুল হোসেন শাহ (রঃ)তাঁর লেখনীতে ব্যক্ত করেছেন-

অন্ধকারে ছিলাম আমি, (জীবনের শুরুতেই প্রত্যেক মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পাই না )
আলোতে নিয়েছো তুমি। (আল্লাহ তাঁর বন্ধুদের মাধ্যমে হেদায়েত করেন)
দেখিতে পাই সবই যে এখন ( তখনই মানুষ প্রকৃত সত্য ও আত্মতত্ত্ব বুঝতে পারে)
ওয়ালিয়্যাম মুর্শিদা বাণী (আল-কোরআন: ১৮ : ১৭)
কহিয়াছেন পাক রব্বানী, ( তাই প্রত্যেক মানুষের একজন পথ প্রদর্শক থাকা )
সেই কালামের বুঝ হইলো এখন, ও মুর্শিদ ধন। (আল্লাহর কুদরতী এবং সৃষ্টি ও মুক্তির রহস্য জানা)
আর বলেছেন আল্লাহ-গণী,
কুরআনের পবিত্র বাণী।
সুরা ফাতাহ দশম আয়াতে (আল-কোরআন: ৪৮ : ১০)
তোমার হাতে হাত যে দিলো (আল্লাহর রাসূল (সাঃ)এঁর হাত মানে আল্লাহর হাত বলে মেনে নেওয়া )
আমার হাতে হাত সে দিলো, (নবুয়তের রাসূল সাঃ ও বেলায়েতের ওলির সাথে দাখিল হওয়া)
তোমার হাতে আমার হাত যখন, ও মুর্শিদ ধন। ( বেলায়েতের এই যুগে ওলি-আউলিয়াগণের নিকট বায়েত গ্রহণ করা)

তাঁর লেখা ডায়েরীতে আরো উল্লেখ ছিল, আউলিয়াগণ তাওহীদের সাগরে নিমজ্জিত থেকে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি আসক্ত হয়ে তাঁর ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন। তাইতো আল্লাহর ওলির আনুগত্য করা ওয়াজিব। ওলি-আওলিয়াগণের সংস্পর্শে থেকে জ্ঞানের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে প্রত্যেক মানুষকে ইহকালে নিজেকে মহৎ ও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। তবেই মানুষ পরকালের মুক্তির স্বাদ খুঁজে পাই। সৃষ্টিকর্তাকে খুশী করা ও উপলব্ধির মধ্যেই আমলের সার্থকতা কারণ মুমিনগণের মধ্যে আল্লাহ অস্তিত্ব ও রহস্য রহিয়াছে। আর যারা যতক্ষণ কামেল মূর্শিদের খেদমতে থাকেন না ওরা সবাই পথভ্রষ্ট। তেমনি স্বীয় মুর্শিদের অতিপ্রিয় ও অর্জিত খলীফা মননীত না হয়ে এবং জীবনকালে ওস্তাদের উপস্থিতির পরশে খলিফা না পেয়ে যারা নিজেকে পীর দাবী করে এরা সবাইও পথভ্রষ্ট, এজিদ বা ফেরাউনের বন্ধু। বংশ ও চেহারার মধ্যে নয় আশেকের সঠিক আমল এবং রুহানী ফায়েজের মধ্যেই নৈকট্য লাভ হয়। একজন কামেল মুর্শেদের হাতে পবিত্র কোরআন মোতাবেক বায়েত গ্রহণ এবং মুক্তির জন্য আল্লাহর আউলিয়ার সানিধ্যে থেকে মহৎ আদর্শ-গুণাবলীতে জীবন যাপন করায় মানবের মূল মুক্তি।

সূফী সাধক হযরত মাওলানা আবুল হোসেন শাহ (রঃ) হলেন রাসূল (সাঃ) তরিকায় হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমেরী (রঃ) সেলসেলার ও হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া দিল্লী (রঃ) গোরোর একজন মহান ওলি। তিনিও তরীকতের বায়েত গ্রহণের মাধ্যমে জাহেরী ইলমের পাশাপাশি তিনি বাতেনী ইলমও অর্জন করেন। আত্মশুদ্ধীতে তাঁর মুর্শিদের সবচেয়ে নিকটতম সাথী হিসেবে কঠোর মুজাহাদা ও রিয়াযতের মাধ্যমে ইলমে মারিফতের উচ্চ শিখরে পৌঁছান। আর কামালাত অর্জনের পর স্বীয় মুর্শিদ তাঁকে সকলের স্বাক্ষী-উপস্থিতিতে খেলাফত ও শ্রেষ্ঠত্ব ইযাজত প্রদান করেন। তিনি তাঁর মুর্শিদের সাথে আরবী ও উর্দু ভাষায় বেশী তালিম ও তাসওয়াফ বয়ান করতেন, যা অন্যান্য ভক্তদের বুঝতে বোধগম্য হতো না। হযরত আবুল হোসেন শাহ (রঃ) ও তাঁর মুর্শিদ হযরত সোলেমান আলী শাহ (রঃ) এই দুই গুরু শিষ্য উভয়ই ভারত বর্ষ থেকে আগত হওয়ায় তাঁদের দুজনেরই ভাষা, চেহারা ও ব্যবহার-আদব অনেকটাই এতই মিল ছিল যা দেখে অনেকে আশ্চর্য হতেন। ওস্তাদের হুকুমে হযরত আবুল হোসেন শাহ (রঃ) তাঁর মুর্শেদের প্রধান হিসেবে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার মাচাইন শরীফ অতঃপর স্বীয় পীর হযরত মাওলানা সোলেমান আলী শাহ (রঃ)এঁর জানাজা নিজেই সম্পন্ন করেন। এরপর থেকে মুর্শেদের আদেশে সেজরা, ফাতেহা ও সকল অনুষ্ঠানের কার্যাবলীর প্রধান হিসেবে তিনিই দায়িত্ব পলন করতেন। আজও বিভিন্ন জায়গায় সকলের মুখে তাঁর কেরাত-কিয়ামের এবং তরিকতের আদব শিক্ষার প্রসংসা করতে গিয়ে তাঁর বন্ধু ও সাথীরা ভালবাসার শিহরণে কেঁদে ওঠেন । সবাইকে নিয়ে এই মহান ওলীর নেতৃত্বে মানিকগঞ্জ মাচাইন গ্রামে তিনিই তাঁর মুর্শেদের দরবার (মাচাইন শরীফ) স্থাপন করেন। এছাড়া তাঁর নিদের্শনা ও তৈরীকৃত নকশা অংকনের উপর ভিত্তি করে আপন মুর্শিদের মাজারের কাজ সম্পন্ন করা হয়।

মহান আল্লাহ নির্দিষ্ট সময়ে ওলী-আউলিয়াগণের যেমন এই দুনিয়াতে পাঠান মানব কল্যাণ ও মুক্তির পথ প্রদর্শনের জন্য, তেমনি আবার পৃথিবী থেকে তাঁর বন্ধুদের অতি উত্তম মাস ও বরকতময় দিনে সন্মানের সহিতে ইহলোক থেকে আড়াল করে নেন। আধ্যাত্মিক সাধক হযরত মাওলানা আবুল হোসেন শাহ (রঃ) আল্লাহর মনোনীতদের মধ্যে ছিলেন একজন। তাই তিনি নিজের দায়িত্বরত কর্ম সম্পন্ন করে সবচেয়ে উত্তম ও পবিত্র রমজান মাসে ( ১১ রমজান, ১৪৪০ হিজরী ) এবং শ্রেষ্ঠ পবিত্র জুম্মাদিন শুক্রবার সকাল ১০টার সময় ইহলোক ত্যাগ করেন। বর্তমানে এই মহান আল্লাহর ওলী কুষ্টিয়া শহরের বাড়াদী এলাকায় স্বীয় বাসভবনের পাশে তাঁর নিজের মনোনীত স্থানে নূরের পর্দার আড়ালে শায়িত আছেন।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
আমরা কুকিজ ব্যবহার করি
আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে কুকিজ ব্যবহার করি। তাদের মধ্যে কিছু সাইট পরিচালনার জন্য অপরিহার্য, অন্যরা আমাদের এই সাইট এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সাহায্য করে (কুকিজ ট্র্যাক করা)। আপনি কুকিজকে অনুমতি দিতে চান কিনা তা আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দয়া করে মনে রাখবেন যে আপনি যদি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেন তবে আপনি সাইটের সমস্ত কার্যকারিতা ব্যবহার করতে পারবেন না।