কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় সাঙ্গ হলো বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র ১২৯তম তিরোধান দিবস অনুষ্ঠান। “বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে” বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র এই আধ্যাত্মিক বানীর শ্লোগানে ১২৯তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে কুষ্টিয়ার কুমারখালী ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়াবাড়ীতে চলা তিনদিন ব্যাপী লালন স্বরনোৎসব শেষ হয়েছে।
শুক্রবার রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশাল এই উৎসবের সমাপ্তি ঘোষনা করেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো: লোকমান হোসেন মিয়া। এ উপলক্ষ্যে লালন একাডেমির মূল মঞ্চে রাতের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য তিনি বলেন, জন্মহোক যথাতথা, কর্ম হোক ভালো। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের কর্ম ভালো থাকায় সারা বিশ্বের মানুষ তাকে আজ স্বরন করছে। আমি-আপনি বা আপনারা যে কাজই করি, সেই কাজটি ভালো হলে সমাজের মানুষ আপনাকে-আমাকে মনে রাখবে। সে লক্ষ্যে পৃথিবীতে যতদিন বাঁচতে হবে নিজের কর্মটাকে প্রাধ্যান্য দিয়ে মাদক মুক্ত সমাজ গড়তে হবে। সাঁইজি কখনো কাউকে নেশা করতে বলতেন না, যারা লালন ভক্ত তাদেরও নেশা করা ঠিক না। আসুন সকলে মিলে একটি মাদক মুক্ত সমাজ গড়ি, মাদককে না বলি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি বঙ্গকণ্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আজ তারই নেতৃত্বে দেশ উন্নত সমৃদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আজকের এই অনুষ্ঠানে চারিদিকে যে সব আলোর ঝলকানি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সবটুকু অবদান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি মো:আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে এসময় প্রধান আলোচক ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো: হারুন-উর-রশিদ- আসকারী। তিনি বলেন, পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত বিস্ময়মানব লালন ছিলেন বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী। ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ্, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তাঁকে মরমি সাধক এবং বাউল সম্রাট ফকিরও বলা হয়ে থাকে। একাধারে তিনি একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। পরে একজন মুসলমানের দয়া ও আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর তিনি সাধক ফকির হন। লালন মুখে মুখেই গানের পদ রচনা করতেন। তাঁর মনে নতুন গান উদয় হলে তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন- “পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে”। লালন গেয়ে শোনাতেন, ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ সেই বাধা গান লিখে নিতেন। লালনের জীবদ্দশাতেই তাঁর গান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বিশেষ অতিথি হিসাবে অংশ গ্রহন করেন, কুষ্টিয়া স্থানীয় সরকার উপসচিব উপপরিচালক মৃনাল কান্তি দে, কুষ্টিয়া বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লুৎফুন নাহার, বিজ্ঞ জিপি এ্যাড. আক্তারুজ্জামান মাসুম, জেলা জাসদ সভাপতি আলহাজ্ব গোলাম মহসিন প্রমূখ। বক্তারা বলেন, লালনের শিষ্যদের ধারণা তাঁর গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এত বিপুলসংখ্যক গান পাওয়া যায় না। শোনা যায়, লালনের কোনো কোনো শিষ্যের মৃত্যুর পর গানের খাতা তাদের কবরে পুঁতে দেয়া হয়। এ ছাড়াও অনেক ভক্ত গানের খাতা নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি। লালন সাঁই সমাজের সকল শ্রেণি ও ধর্মের মানুষকে আমৃত্যু এক করে দেখেছেন।
আলোচনা শেষে মূল মঞ্চে লালন একাডেমির শিল্পীরা লালন ফকিরের আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করেন। এদিকে উৎসব ছেড়ে অধিকাংশ সাধু গুরুরা ফিরে গেছেন তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে।
উল্লেখ্য, ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র মৃত্যুর পর থেকে তার স্বরণে লালন একাডেমী ও জেলা প্রশাসন এই লালন স্মরণোৎসব চালিয়ে আসছে। এবারও পথ প্রদর্শক লালনকে স্মরণ ও অবাধ্য মনকে শুদ্ধ করতে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার লালন অনুসারী, ভক্ত অনুরাগী আর দর্শনার্থীরা এই আখড়াবাড়িতে অবস্থান নিয়েছিল। লালনের রীতি অনুযায়ী বুধবার সন্ধ্যায় অধিবাস, পরদিন সকালে বাল্য ও দুপুরে পূর্ণ সেবার মধ্যদিয়ে সাধু সঙ্গ শেষ করে অনুসারীরা আখড়াবাড়ী ছাড়তে শুরু করে। যেখানে লালন অনুসারীরা খন্ড খন্ড ভাবে বসে সাধু সঙ্গে অংশ নেন অডিটোরিয়ামের নিচে সেই জায়গা আজকে প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। তবে আখড়াবাড়ীর বাইরে কালি নদীর তীরে বাউল মেলা আজ রাত অবদি চলবে। ঐতিহাসিক এই উৎসবকে নির্বিগ্ন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয় কয়েকস্তরের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।