বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

বাউল ও সুফিবাদের আলোয় লালন-দর্শন
বাউল ও সুফিবাদের আলোয় লালন-দর্শন

লালন একজন ফকির-দরবেশ, একজন সুফি-সন্ত, লালন বৈষ্ণব, তান্ত্রিক কিম্বা তত্বজ্ঞ কবি, লালন হিন্দু না মুসলমান – তিনি যে প্রকৃতপক্ষে কে এবং কি, এ ব্যাপারে দ্বিধা দ্বন্দের শেষ নেই। এই প্রবন্ধের মুখবন্ধ হিসেবে আপাতত আমরা যদি বলি লালন একজন বাউল, একজন তাত্বিক বাউল ছিলেন তাহলেই যথেষ্ট হবে। ক্রমশঃ আমরা লালনের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনের চেষ্টা করবো।

লালন তো বাউল অবশ্যই ছিলেন। বাউল-শ্রেষ্ঠ ছিলেন বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাউল সঙ্গীত বাংলার লোকসংস্কৃতির এবং লোকগাঁথার এক বিশেষ অঙ্গ। বাংলার জলবায়ূতেই তার পরিপুষ্টি। অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত তথাকথিত অসংস্কৃত একশ্রেণীর গ্রাম্য লোকদের মুখে মুখে রচিত হত বাউল গান। ধর্মীয় বা লোকাচারের মোড়কে গ্রাম্যমানুষকে নীতি কথা শেখানোর জন্য বাউলশ্রেণীর উদ্ভব হয় নি, যেমনটি দেখা যায় অন্যান্য কিছু লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে গম্ভীরা, ভাদু, টুসু, মুর্শিদী ইত্যাদি। বাউল গান যদিও গ্রামীণ কথ্য ভাষায় গীত হত, কিন্তু এর পরতে পরতে যে গভীর তত্ত্বজ্ঞান লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে বেশী সময় লাগে না। লালন ফকিরের বাউল গান এর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ‘তত্ত্বকথা শ্রবণ, তত্ত্বসার গ্রহণ এবং তত্ত্ববিষয়ক চিন্তাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। দীর্ঘ আধ্যাত্ম সাধনায় তাঁর হৃদয়ে যে জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছিল, তা প্রকাশ করার জন্য তিনি সুর ও ছন্দ অবলম্বন করেন। একারণেই তাঁকে তাত্ত্বিক কবি বলা হয়েছে’। এক কথায় বলা চলে লালন ছিলেন ‘মিষ্টিক’, যে অর্থে বৈষ্ণববাদ এ সুফিবাদ ‘মিষ্টিক’, সেই একই অর্থে লালনের ধ্যান-ধারণা ‘মিষ্টিক’। ‘মিষ্টিসিজম’ অল্পবিস্তর সব বাউলগানেই প্রচ্ছন্ন, কিন্তু লালন-গীতিতে তা এক অন্যরূপ, ভিন্নতর মাত্রায় জাজ্বল্যমান।

বাউল সঙ্গীত ও তার ইতিহাসকে বাদ দিয়ে লালনের তত্ত্বজ্ঞান ও দার্শনিকতার সঠিক মূল্যায়ন হতে পারে না। লালনের জীবন ও কর্মের ধারাটিকে সঠিক ধরতে গেলে বাউল সঙ্গীতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একবার দেখে নিতে হবে। কেউ-ই সঠিক জানেন না বাউল সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা কে বা কারা। এটুকু বলা যায় বাউল ফকির বা গুরুরা কোন এক বিশেষ ধর্মের অনুগামী ছিলেন না। মুসলিম এবং হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের লোকই বাউল সম্প্রদায়ভু্ক্ত ছিলেন- আগে এবং এখনও। কয়েকজন বিখ্যাত ফকির গুরুর নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে যেমন হরিগুরু, বনচারী, অখিল চাঁদ কিম্বা পাগল নাথ, সাহেব ধনি প্রমূখ। একটি ব্যাপার বিশেষ উল্লেখ্য এই ব্যাপারে যে এই সব ফকির বা গুরুরা সবাই নদীয়া জেলার অধিবাসী ছিলেন এবং প্রায় সবাই ষোড়শ শতাব্দীর পরের দিককার। অনেক গবেষক এই কারণেই মনে করেন বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল এই নদীয়াতেই। নদীয়া অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে বাংলায় মুসলিম শাসন চালু হয়। সুফি প্রভাব তখন বাংলার সর্বত্র।

সুফিচিন্তা ও ভাববাদের মধ্যে গ্রামবাংলার অত্যাচারিত ও দিকভ্রান্ত মানুষ দিশা খুঁজে পেতেন। এমনকি অনেক গবেষক মনে করেন চৈতন্যদেবের ভাবধারাতেও সুফিপ্রভাব ছিল। ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এর লেখক জয়ানন্দ বলেছেন সেই সময় অনেক ব্রাক্ষণ জালাল উদ্দীন রুমির ‘মাথানবী’ পড়তেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য-চরিতামৃত’ গ্রন্থে চৈতন্যর সঙ্গে পীর-দরবেশের সাক্ষাৎকারের কথা আছে। চৈতন্য ভাগবত-এ আছে মহাপ্রভুর যখন ভাবদশার উদয় হত তখন –‘মুঞি সেই মুঞি- সেই কহি কহি হাসে’। যা কিনা সুফি চিন্তা ‘আনা’ল হক’-এর সমার্থক (ভাবার্থ I am the real)। প্রখ্যাত সমালোচক প্রমথ চৌধুরীর কথায়- ‘চৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরে ভারতবর্ষের মধ্যযুগের এই নব বৈষ্ণব ধর্ম ও সনাতন হিন্দু ধর্মের একটি নবশাখা মাত্র। তবে এই নবত্বের কারণ মুসলমান ধর্মের প্রভাব। মুসলমান ধর্ম যে প্রধানতঃ ঐকান্তিক ভক্তির ধর্ম, একথা কে না জানে? ভারতবর্ষের মধ্যযুগের বৈষ্ণবধর্ম যে মুসলমান ধর্মের এতটা গা-ঘেঁষা, তার কারণ পাঁচশ বছর ধরে হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম পাশাপাশি বাস করে আসছিল’।

নববৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে যে পৌত্তলিকতা বর্জিত একশ্বরবাদী চিন্তার ধারণা আছে সুফি চিন্তাধারার সঙ্গে তার অনেকটাই মিল। ষোড়শ শতাব্দীতে গিয়ে যখন বাউল সাধকদের উল্লেখ দেখা যায় নদীয়ার আশেপাশে, তাতে স্বভাবতঃই মনে করা যেতে পারে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষ্ণব চিন্তা ও সুফি ভাবধারার ছাপ আছে। বাউলতত্বে বারবার বলা হয় নিজেকে জানার কথা- খানিকটা যেন ঊপনিষদের ‘আত্মানং বিদ্ধি’ বা গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর চিন্তার প্রতিফলন – ‘know thyself’। বৈষ্ণবরা কৃষ-প্রেমের মধ্য দিয়ে যেখানে পৌঁছোতে চায়, সুফিতত্ত্ব যে ‘এক এবং অদ্বিতীয়’-কে জানতে চায়, তত্ত্বজ্ঞ বাউল তার কোন নামকরণ বা চিহ্নিতকরণ করতে পারেন নি। তাই তাকে ‘মনের মানুষ’ বা কখনো শুধু ‘মন’ বা কখনো আবার ‘অচিন পাখি’ ডেকেছেন। এই অধরা অজানাকে জানার রহস্যভেদ করার আকুলতাই বাউল গানের ছত্রে ছত্রে ধ্বনিত হয়।

‘আলেখ দুনিয়ার বীজে আলেখে সাঁই বিরাজে
আলেখে খবর নিছে, আলেখে কয় কথা।
আলেখ মানুষের রসে সনাতন সদা ভাসে
বাউলে তোর লাগল দিশে যেতে নারবি সেথা’।

এক্ষেত্রে আলেখ সাঁই শব্দটি হয়তো অলক্ষ্য স্বামীর অপভ্রংশ। সুফিসন্তদের মত বাউল সেই অজানাকে জানা ও চেনার দুর্জ্ঞেয় রহস্য ভেদ করতে চান প্রেমের মাধ্যমে যা মনের গভীরে তুষের আগুনের মত সর্বদাই জ্বলছে। এই প্রেমানলে সুফি দরবেশ যেমন পাগল, বাউলও হন বাতুল বা উন্মাদ। বাউলের এই উন্মাদ অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে-

‘আসার সাঁই দরদী আর কতদিন রব?
দেশ বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াই, আর বা কোথা পাব?
যার জন্যে হয়েছি পাগল, তারে কোথায় পাব?
মনের আগুন দ্বিগুন জ্বলে তারে কি দিয়ে নিবাব?’

এই প্রেমোন্মাদনার মাধ্যমে বাউল সব সময় সেই অজ্ঞাত রহস্যময়কে জানার চেষ্টা করে চলেন। স্বভাবতঃই পারেন না। তাই সুফি কিম্বা বেদান্তজ্ঞানীর মত তিনি দৃষ্টি ফেরান নিজের ভেতর। তিনি বলতে পারেন সেই কারণে – ‘যা নেই ভান্ডে, তা নেই ব্রম্মান্ডে’। এখানে ভান্ড অর্থ এই শরীর। এই ভাবনার সঙ্গে সুফি ‘কুরবাত’-এর ধারণা সমাপতিত হয়ে যায়। বাউল ধ্যানধারণার মধ্যে এভাবে একদিকে যেমন প্রচ্ছন্নভাবে বৈষ্ণব প্রেমতত্ব মিশে আছে তেমনি আছে সুফি আত্মোপলদ্ধির ধারণা। বাউল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন এই অজ্ঞেয়-অধরা আর কোথাও নয়, মন্দিরে নয়, মসজিদে নয়, গীর্জায় নয় আছেন এই শরীরের খোলেই। যদিও তিনি রহস্যময় কিন্তু সঠিক ভাবে ডাকলে তাঁর সাড়া অবশ্যই পাওয়া যায়।

‘মানুষ হাওয়ায় চলে, হাওয়ায় ফিরে, হাওয়ার সনে রয়।
দেহের মাঝে আছে রে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয়’।

এই রহস্যভেদের জন্য বাউল দ্বারস্থ হন গুরু বা মুর্শিদের কাছে ঠিক যেমন সুফিভক্ত যান পীরের দরজায়। গৎ বাঁধা ধর্মাচরণ বাউলের নয়। তীর্থভ্রমণ, পূজাপাঠ, এবং অনুষ্ঠান-আচার যেমন বাউলের কাছে পরিত্যাজ্য সুফির কাছেও তেমনি।

‘আমার নাই মন্দির কি মসজিদ
পূজা কি বকরিদ
তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী
পলে পলে সুদিক’।

সুফিসাধক এবং হিন্দু তত্ত্বজ্ঞানীর মত বাউলও বিশ্বাস করেন সংসার মায়াময়। এই পার্থিব জীবন মরীচিকা। তাই তো বাউল নিজের চারপাশে গড়ে তোলে পার্থিব জীবন বিমুখ মনোভাব। সুফি অনুগামী বা হিন্দু তাত্ত্বিকের থেকে বাউল এখানে স্বতন্ত্র। সুফি চিন্তার সঙ্গে অনেক সমাপতন সত্বেও বাউলকে দেখা যায় এক নিজস্ব রীতিনিয়ম তৈরী করে নিতে। তিনি কোন জাতপাতের উপর নির্ভরশীল নন। তাঁর নিজস্ব পথ স্বকীয় চিন্তার আলোকে উদ্ভাসিত হয়। তুলনামূলকভাবে সুফিবাদ দৃশ্যতই এবং পরিপূর্ণভাবে ইসলামনির্ভর। সুফি ভাববাদ যেহেতু ‘আল্লা’ নির্ভর, তাই তাঁদের ‘পরম লক্ষ্য’-এর ব্যাপারে ধ্যানধারণা অনেক স্বচ্ছ। এ ব্যাপারে বাউলদর্শন অনেকটাই অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত।

এত সব সমাপতন থেকে, সে কাকতালীয় হোক আর ইচ্ছাকৃত, ধারণা করা যেতে পারে বাউলতত্ব বৈষ্ণববাদী প্রেম ও সুফি একেশ্বরবাদী আত্ম-অনুসন্ধান ও আত্মোপলব্ধির ভিতের উপর গড়া।

বাউল ভাববাদের এই পরিপ্রেক্ষিতটির কথা মাথায় রাখলে বাউল-শ্রেষ্ঠ লালন সাঁইয়ের জীবনাদর্শে আলোকপাত অনেক সহজ হয়ে আসে। বাল্য বয়স থেকেই প্রথাগত ধর্মসম্প্রদায় এবং জাতপাত ভিত্তিক ধারণার বাইরে বেরিয়ে এক অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের পথে এগোচ্ছিলেন তিনি। পরবর্তী জীবনে এই মনোভাবই লালনের দর্শন চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছিল। তাই তিনি পরিণত বয়সে বলতে পেরেছিলেন -

‘লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।
কেউ মালা কেউ তসবী গলে তাইতোরে জাত ভিন্ন বলে
যাওয়া কিন্বা আসার বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কারে’।

আজকালকার সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও বিদ্বেষের মুখে লালনের এই দর্শন যে ভীষণই বৈপ্লবিক ও প্রাসঙ্গিক সে সন্দেহ নেই। কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় যেখানে লালনের আখড়া, তা একসময় বৃহত্তর নদীয়ার অংশ ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে সুপ্রাচীন নদীয়ায় বৈষ্ণব ও সুফিবাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল যার ছাপ আমরা বাউল সঙ্গীতে লক্ষ্য করি। লালন এই জায়গার লোক হওয়ার সুবাদে তাঁর চিন্তাধারাতেও বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ এবং সুফিবাদের প্রভাব থেকে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সুফিসন্তদের মতো তিনিও ভাবতেন আপনাকে জানার মধ্যেই আছে জগতের রহস্যভেদের চাবিকাঠি। সেই ‘অপার-অজানা’ আছেন আমাদের এই দেহ-দেউলেই। এই শরীরের খোলেই। দেহ এক মাধ্যম ও বাহক - তার বেশী কিছু নয়। দেহ নষ্ট হবে কিন্তু চলতেই থাকবে দেহ থেকে দেহান্তরে ‘অচিন পাখি’র আনাগোনা। লালনের এই ধ্যানধারণা, বিখ্যাত দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ দেকার্তে-র দার্শনিক চিন্তার সমান্তরাল। দেকার্তে বলেছিলেন – ‘cogito ergo sum’ বা সাদা কথায় ‘I think, therefore I exist’। চিন্তা ভাবনার ধারক ও বাহক হিসেবে অস্তিত্ব আছে এই শরীরের। লালনও বললেন -

‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’।

এই খাঁচা (দেহ) যেদিন খসে পড়বে- ‘লালন কয় খাঁচা খুলে সে পাখি কোনখানে পালায়’। মোদ্দা কথা দেহ বিনষ্ট হবে কিন্তু আত্মা ও মন রয়ে যাবে। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন ‘বাসাংসি জীর্নানি যথা বিহায়’ ইত্যাদি। বাসা জীর্ণ হলে পাখি যেমন বাসা বদল করে, শরীররূপী এই খাঁচা খসে পড়লে পাখি মুক্ত হয়ে বাসা বদল করে। এই আধ্যাত্ম চিন্তা এতটাই শাশ্বত যে ধর্ম ও জাতের জায়গা এখানে কোথায়? সেই কারণেই লালনের চিন্তাভাবনার দর্শনকে কোন প্রথাগত ধর্মের গন্ডিতে বাঁধা মুশকিল।

মন্দির মসজিদে লালনের বড় অনীহা ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণের বিরুদ্ধতা বাউলরা সব সময়েই করেছেন একথা আগেই বলেছি। কোন তীর্থস্থানে যেতে হবে না। এই দেহই সব মসজিদের শেষ মসজিদ, সব মন্দিরের শেষ মন্দির। লালন তাই বলেন-

আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখল নারে মন ভেয়ে
দেশ দেশান্তরে দৌঁড়ে এবার
মরিস কেন হাঁপিয়ে’।

তিনি বলেন – ‘দশ দুয়ারী মানুষ মক্কা
গুরুপদে ডুবে দেখ গা
ধাক্কা সামলায়ে
ফকির লালন বলে সে যে গুপ্ত মক্কা
আদি ইমাম সেই মিঞে’।

বাউলের কাছে মন্দির এই দেহ, মসজিদ এই দেহ, মক্কা-মদিনা-কাশী-বৃন্দাবন এই দেহ। সুফি দর্শনের সঙ্গে লালন বা বাউল দর্শনের বৈপরিত্য এখানেই। মানব-শরীরের মাধ্যমে সেই ‘মিঞে’–কে ধরার প্রয়াস কেবল বাউলই করেন।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে বাউলরা তথাকথিত বিদ্বৎসমাজে ও সমাজের উঁচুস্তরে প্রায় ব্রাত্যই ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই সম্প্রদায়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ নতুন করে জাগিয়ে তুললেন। রবীন্দ্রনাথ এবং লালন প্রায় একই সময় পৃথিবীতে ছিলেন। তিনি লালনের প্রভাবে এতটাই প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন যে তাঁর কাব্য চিন্তায় বাউল-দর্শন এ বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ লালনকে দেখা করবার জন্য ডেকেও ছিলেন যদিও লালন যাননি। যাই হোক লালনের ভাবনার প্রতিফলন দেখা গেল তাঁর গানে -

‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি’।

কিম্বা তিনি যখন বলেন ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তায় সকলখানে’,

তখন লালন-রবীন্দ্রনাথ-দেকার্তে-প্লেটো—সুফি-সন্ত সব একাকার হয়ে যায়। মনুষ্যত্বের আদর্শ ও চিন্তাই এই চিন্তার মূলভিত্তি। নিজেকে জানা ও চেনার মধ্য দিয়েই জানা যাবে ‘তাঁকে’ – আর কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণ ও তদজনিত ভেদবুদ্ধির প্রচার ও বিচারের দরকার নেই। এ কথাই লালন তাঁর সমগ্র জীবন ও চিন্তায় প্রতিফলন করে গেছেন।

ঘুরেফিরে এই প্রবন্ধে অনেক বারই বলা হয়েছে যে লালনের বাউল-ভাবনায় বাংলার মধ্যযুগীয় নববৈষ্ণব চিন্তা ও সুফি ভাববাদের গভীর প্রভাব আছে। নদীয়া জেলাই যেহেতু লালনের আখড়া, এই প্রভাব এড়ানোও সহজ ছিল একথা মনে করার কোন কারণ নেই। সুফি ভাবধারার সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য থাকায় লালনকে অনেকে সুফি-সাধকও বলেছেন। সাম্প্রতিক গবেষকরা এ ব্যাপারে নির্দ্বিধায় বলেছেন লালন সুফি ছিলেন না। কেন? সুফি-দর্শন প্রথমত এবং প্রধানত ইসলাম ধর্মের মধ্যেই বেড়ে ওঠা এক অধ্যাত্ম চিন্তা। সুফিরা ‘আল্লা’ ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। আল্লার প্রতি অপার ভক্তির মাধ্যমে সুফি সাধক সেই ‘পরম’-কে পেতে চান। এখানেই লালনের চিন্তাধারা বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। লালন এবং বাউল-দর্শন মানবদেহের অভ্যন্তরে যে ‘মনপাখি’, ‘মনের মানুষ’ আছে তাঁকে জানার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুতে বিশ্বাস করেন না। সেই চিন্তায় আল্লা নেই, কৃষ্ণ নেই। মানুষ তার কাছে আল্লা। তাই তিনি বলতে পারেন -

‘আল্লা কে বোঝে তোমার অপার লীলে
তুমি আপনি আল্লা ডাকো আল্লা বলে’।

লালন সেই অর্থে সুফিদের মত ধর্মযাজক ছিলেন না। ফারহাদ মাজহার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন লালনকে সুফি বলে ভুল করা হয় এই কারণে যে তাঁর গানে প্রচুর আরবী শব্দ ও ইসলামিক ভাবনা চিন্তার প্রতিফলন আছে। কিন্তু অত্যন্ত সতর্ক ভাবেই তিনি সুফিদের থেকে নিজেকে সরিয়ে এক স্বতন্ত্র দর্শনের উদ্ভাবন করেছিলেন যা প্রথাগত ইসলাম থেকে অনেক দূরে। আল্লাকে বা ‘অচিন পাখি’-কে দেখো এই মানবদেহেই – অন্য কোথাও নয়, অন্য কোন তীর্থে নয়।

প্রবন্ধের শুরুতে আমাদের যে প্রশ্ন ছিল তার উত্তর একটাই হতে পারে। লালনের ভাবনা ও দর্শন সুফি দর্শন এবং বৈষ্ণবীয় ভাব রসের জারনে জারিত এক স্বতন্ত্র চিন্তা যা গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতির আধারে পরিপুষ্ট হয়েছিল। তিনি বৈষ্ণব নন, সুফি নন, হিন্দু নন, মুসলিম নন। জাতের ফাৎনা তিনি ডুবিয়েছেন সাধ-বাজারে। তিনি ব্যাকুল স্বরে বলতে পারেন -

‘বিবিদের নাই মুসলমানী
পৈতে নেই যার সেও বামনী।
বোঝ রে ভাই দিব্যজ্ঞানী
লালন তেমনি জাত একখানা’।

তিনি লালন সাঁই, ফকির লালন- জাত- পাতের বহু উর্ধে এক তত্বজ্ঞ দিব্যজ্ঞানী।

তথ্যসূত্রঃ-
1) “Sufism and Peace”, Mowlana Salaheddin Ali and Nader Shah Angha
2) “A History of Sufism in Bengal”, Muhammed Enamul Haq
3) “Lalon –Baul’s Mysticism”,
4) “On Fakir Lalon Shah (an interview)”, Farhad Mazhar.

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন