বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালনসাঁই
লালনসাঁই

হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতে তখনও আগুন লাগানো হয়নি। তাঁর বাড়ি ঘিরে বসে আছে ছয় লাঠিয়াল। তাদের একজনের হাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে মশাল। এক্ষুনি বুঝি ছারখার হবে সব!

বন্ধ ঘরের ভিতরে কাঙালের বাড়ির লোক অশ্রুসজল নয়নে জানলার বাইরের দিকে চেয়ে। এমন বিপদের কথা, হরিনাথ কি জানে? উঠোনে বসে গুড়ুক গুড়ুক করে একজন ফরসা-টুকটুকে চেহারার টেকো লোক তামাক টানছে। সম্ভবত ঠাকুরবাড়ির নায়েব।

হঠাৎ ছায়াময় জঙ্গল ফুঁড়ে, একজন মানুষ তাঁর দলবল সমেত রণ-পায়ে সটান টেকো লোকটার একেবারে সামনে। সে মাটিতে নামতেই নায়েব বাজখাঁই স্বরে প্রশ্ন করল, ‘‘কে তুই?’’
‘‘আমরা হরিনাথের বন্ধু।’’
‘‘বন্ধু! নিজে লুকিয়ে থেকে তোদের পাঠিয়েছে!’’
‘‘হ্যাঁ বন্ধু। কাঙালের কি খাজনা বাকি আছে? যত দূর জানি, সে তো ইস্কুল গড়ার জন্য সব দিয়ে দিয়েছে। তবু তাকে ধরতে এসেছেন কেন?’’
‘‘সে কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে নাকি! ভালো চাস তো এই বেলা সরে পড়।’’
‘‘পিছু হঠতে আমরা আসিনি কত্তা! হরিনাথকে ধরলে লাশ পড়বে। রক্তারক্তি হবে! তার চেয়ে দেশে আইন আছে…।’’
‘‘কী! আমাকে আইন দেখাচ্ছিস! ওরে কে আছিস...!’’
কাঙাল হরিনাথের ‘বন্ধু’ বলে পরিচয় দিয়ে নায়েবের সামনে রুখে দাঁড়ানো কে এই ঋজু-মানুষটি?
ইনিই দুই বাংলার মানুষ-রতন ফকির লালন সাঁই।
এ কাহিনির সত্যতা কত দূর, সে তথ্য-প্রমাণ মেলে না আজ আর।

লালনের জীবন-নির্ভর উপন্যাস ‘মনের মানুষ’-এ ইতিহাস আর কল্পনার আশ্রয়ে গড়া এ কাহিনি যে ফকিরের ‘প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক জীবনকাহিনি’ নয়, তা জানিয়েছিলেন লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বয়ং। তবে, কাঙালের সঙ্গে ফকিরের সখ্য মিথ্যে নয়। চির সত্য।

হরিনাথের উদ্যোগেই তাঁর ‘ব্রহ্মাণ্ডবেদ’ সংকলনে সেই ১২৯২-এ প্রথম লালনের গান প্রকাশ করেন। গানটি ছিল, ‘কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা’।

দু’জনের জন্ম একই এলাকায়, কুমারখালির গড়াই নদীর এপার-ওপারে। হরিনাথ তাঁর সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় শিলাইদহের জমিদার ঠাকুরদের প্রজাপীড়নের খবর প্রকাশ করতেন।

তাই তাঁকে শায়েস্তা করতে লাঠিয়াল নিয়ে সদলে নায়েব এসে হাজির হয় বাড়িতে। সে খবর পেয়ে প্রাণের দোসর হরিনাথের পরিবার-পরিজনকে বাঁচাতে একতারার বদলে লালন লাঠি হাতে রুখে দাঁড়ান।

খালি হাতে ফিরতে হয় নায়েবকে!

কাঙাল নাকি নিজেই তাঁর ডায়েরিতে লিখে গিয়েছেন এই ঘটনার কথা! কিন্তু তারই বা হদিশ কই?
আসলে সাঁই তাঁর আত্মপরিচয় সম্পর্কে বেশ নীরব ও নিস্পৃহ ছিলেন। তিনি তাঁর গানেও আত্মপরিচয় ‘লিখিয়া ঢাকেন’। তাঁর ছিল, ‘শব্দের ঘর নিঃশব্দের কুঁড়ে’। সেই জন্যই হয়তো এত বিতর্ক, এত চর্চা এক দীন ফকিরের জীবনের আয়নামহল ঘিরে।

আছে যার মনের মানুষ
‘‘তোমাদের ধর্মের বিশেষত্বটি কি, আমাকে বলতে পার?’’
‘‘বলা বড় কঠিন, ঠিক বলা যায় না।’’
ফকির কথাটা শেষ করতেই রবিঠাকুর অন্য কি একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন। তার ফাঁকে ফকিরের এক সহচর বলল, ‘‘বলা যায় বৈকি কথাটা সহজ। আমরা বলি এই যে, গুরুর উপদেশে গোড়ায় আপনাকে জানতে হবে। যখন আপনাকে জানি, তখন সেই আপনার মধ্যে তাঁকে পাওয়া যায়।’’

এ বার রবিঠাকুর একটু ধন্দ্বে পড়লেন। উঠে গিয়ে বোটের একেবারে কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

দূরে, বহু দূরে কুমারখালির দিকে পদ্মা যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চেয়ে রইলেন। শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে তাঁর জোব্বায়, চিকনের কাজে। রাঙা রোদ আলপনা আঁকছে পদ্মার জলে। কবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমাদের এই ধর্মের কথা পৃথিবীর লোককে সবাইকে শোনাও না কেন?’’

ফকিরসাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কবির কাছে এসে বললেন, ‘‘যার পিপাসা হবে, সে গঙ্গার কাছে আপনি আসবে।’’

‘বাংলাদেশের একটি ছোটো নদীর ধারে এক সামান্য কুটিরে’-র বাসিন্দা এই দুই ফকিরের মধ্যে লালন ছিলেন কি না তার উল্লেখ করেননি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মবোধ’ প্রবন্ধে। কিন্তু পড়ন্ত বিকেলের পদ্মার আশমানি হাওয়ায় কান পাতলে এখনও সুদূর থেকে শোনা যায় কবি আর ফকিরের এমন সংলাপ।

তাহলে কি দু’জনের মধ্যে সত্যিই কখনও দেখা হয়েছিল?

লালন চর্চার বড় অংশজুড়ে তর্ক সে নিয়েই! কেন না, রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে যখন শিলাইদহে গেলেন, সেটা লালনের মৃত্যুর পরের বছর, ১৮৯১।

সে সময় শিলাইদহে লালন ঘনিষ্ঠ গগন হরকরা, সর্বক্ষেপি, গোঁসাই গোপালের সঙ্গে কবির নিত্য লালনের গান ও দর্শন নিয়ে কথা হত।

ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে লালনের গানের দুটি খাতা আনিয়ে এস্টেটের এক কর্মচারীকে দিয়ে নকল করিয়েও নেন।

দ্বিতীয় খাতার কয়েকটি গানে শব্দ সংশোধন করে শুদ্ধ পাঠ লিখে দেন তিনি। তার থেকেই ‘প্রবাসী’তে প্রকাশ করেন কুড়িটি লালনগীতি। সেই সব গানের নিবিড় পাঠে, কবি ভেসে যান ফকিরের ভাব নদীর গহনে।

‘সে যে মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়নদ্বারে’ শুনলে তাই আমাদের মনে পড়ে লালনের ‘আছে যার মনের মানুষ মনে, সে কি জপে মালা’। এমনি করেই, ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে’ শুনে মনে পড়ে যায় ‘আমার মনের মানুষেরি সনে মিলন হবে কতদিনে’।

প্রবাসীতে যখন ধারাবাহিক ভাবে ‘গোরা’ প্রকাশিত হচ্ছে, সেই তখন থেকেই কবির এই লালন-ঘোর। ‘গোরা’-য় লিখলেন, ‘খাঁচার ভিতর অচিন-পাখি কেমনে আসে যায়।’ আবার লালনের সেই গানের কথাই ফিরল পরে তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-র পাতায়।

লিখলেন, ‘এই অচিন পাখির যাওয়া-আসার খবর গানের সুর ছাড়া আর কে দিতে পারে!’

ঘরে কি আর হয় না ফকিরি
কাঁটাতার পেরিয়ে মেহেরপুর, তারপর...
কুষ্ঠিয়া হয়ে সেই ছেঁউরিয়া। কাছেই সাঁইয়ের হৃদয়পুর!
কেন্দুলির বাসন্তিক রাত-আখড়ায় বসে বাউল সুরের আয়না মহলে ওড়াউড়ির ফাঁকে, লালন সাঁই আর তাঁর শেষ সাকিন ছেঁউড়িয়ার গল্প বলছিলেন দুই বাংলার কয়েকজন বাউল-ফকির-দরবেশ।

তাঁদের সঙ্গে মেহেরপুরের বাউলানি রাইকমলিনী। সে ঠিক তারাশঙ্করের ‘কমল’ যেন। ‘নয়ন-ফাঁদে শ্যাম শুকপাখি ধরিয়া হৃদয়পিঞ্জরে প্রেমের শিকল দিয়া বাঁধিয়া রাখিতে’ সে জানে! এই মধ্য-বাইশেই সে সাঁইয়ে সঁপেছে মন-রতি।

মাথার উপর মেঘ কেটে কেটে ফাল্গুনি চাঁদ জাগছে। অদূরে কদম্বখণ্ডীর ঘাটে দাউ দাউ চিতা। হাওয়ায় ভাসছে বাতুল সুর। ‘নারীর এত মান ভাল নয় গো কিশোরী/ যত সাধে শ্যাম আরও মান বাড়াও ভারী।’ ফকির-দরবেশদের জোর বাহাস আর কমলের নয়ন-ফাঁদে চেয়ে চুপটি করে থাকতেই হয় লালন-কথায়।

সাঁইকে নিয়ে তাঁর এই শিষ্যমহলের ঘর-গেরস্থালির উলটো পিঠে স্মৃতিপাঠ থেকে মনে পড়ছিল কুষ্ঠিয়াজুড়ে লালন-বিরোধী আন্দোলনের কথা। ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’-র কথা।

কী শুনতে হয়নি তাঁকে?

কেউ বলেছেন, ‘শরিয়তবিরোধী, বেশারাহ, বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট ফকির’, কেউ বলেছেন, ‘নারীভজন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল লালন শাহের একমাত্র সাধ্যসাধনা।’

কুষ্ঠিয়ার পাক প্রেস থেকে লালনপন্থীদের বিরুদ্ধে লিফলেটও বিলি হয়েছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘‘...তার অবতারবাদের সংবাদ জানলে যে কোনও রুচিসম্পন্ন মানুষ লালন এবং তাঁর অনুসারীদের নাম মুখে আনতে ঘৃণা বোধ করবে। কিংবদন্তীর উপর ভিত্তি করে সত্য জানবার কোনও প্রকার চেষ্টা না করে কিছু সংখ্যক ক্ষমতাবান জ্ঞানপাপী একটা নূতন কিছু করে হঠাৎ যশস্বী হওয়ার চেষ্টায় মেতে উঠেছেন।... কুষ্ঠিয়ার জনসাধারণ এই হীন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করছে!’’

হাওয়া কি উজানে বয়?

কেন্দুলি মেলা ফুরিয়েছে সেই কবে। অথচ এই ফাল্গুনেও আখড়া দিব্য জমে উঠেছে।

জিকির দিয়ে দোতারায় গান ধরলেন দিনাজপুরের দরবেশ। উদাত্ত সুর। ‘অধরচাঁদকে ধরবি যদি/ দম কষে দম’ গান থামলে লালনের তত্ত্ব গানের কথার ফুঁপি তুললাম।—

আচ্ছা, লালনের গানে এই যে অধরচাঁদকে ধরার কথা বললেন। সে কেমন?

দরবেশ স্মিত হেসে বললেন, ‘‘এ হল গিয়ে সাঁইয়ের অমাবস্যায় চাঁদের আলো ধরা। মাসে মাসে চাঁদের উদয় হয়। আর অমাবস্যায় অধরচাঁদকে ধরতে হয়। লালন শাহ বলেছেন, ‘অধরচাঁদকে ধরবি যদি/ দম কষে দম সাধন কর।’’

‘শাহ’ কথাটার মানে ফরাসিতে মহারাজা। সে তো দরবেশদের পদবি। কিন্তু সব দরবেশ যে বাউল নয়। তাহলে লালন সাঁই?

‘‘সব বাউল দরবেশ নন। কিন্তু লালন ফকির ছিলেন দীক্ষায় দরবেশ, আর সাধনায় বাউল।’’

ফের দখিন হাওয়ায় সুর ওঠে, ‘চেয়ে দেখ না রে মন দিব্যনজরে/ চার চাঁদ দিচ্ছে ঝলক মণিকোঠার ঘরে।’

কার বা আমি কেবা আমার
সাঁইয়ের জন্ম নিয়েও নানা জনশ্রুতি।
শিষ্যদের একাংশের মত, সাঁইজি ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। মৃত্যু হয় ১৮৯০-এ। তাহলে জন্ম ১৭৭৪ সা‌লে।

বেশির ভাগেরই দাবি, নদিয়া জেলার কুষ্ঠিয়ার কামারখালি থানার চাপড়া ইউনিয়নের গড়াই নদীর তীরে ভাঁড়ারা গ্রামে সাঁইয়ের জন্ম। বাবার নাম মাধব কর, মা পদ্মাবতী।

আবার একটি দলিলের কথাও মেলে। ১৮৮০ সালের ১৯ জানুয়ারি রেজিস্ট্রি করা সেই দলিল জানাচ্ছে, ‘‘পাট্টা গ্রহীতা-শ্রীযুত লালন সাঁই, পিং মৃত সিরাজ সাঁই, জাতি মুসলমান, পেশা ভিক্ষা ইত্যাদি। সাকিন ছিঁউড়ে, পরগণা ভ্রাহিমপুর, ইস্টাসন ভলকো, সাব-রেজিস্টারি-কুমারখালী।’’

এরপর জটিল হয়ে পড়ে লালনের পরিচয়।

তবে ফকিরের একটি পরিচয় কখনও গোপন নয়, তিনি ছিলেন ‘একা’ একজন মানুষ।

ছেলেবেলায় বাবা মারা যায়। অর্থকষ্টে তেমন শিক্ষা গ্রহণও হয়নি। চাপড়ার ভৌমিক পরিবার ছিল তাঁর মামার বাড়ি।

কিন্তু ক্রমে মামার বাড়ি দুঃসহ হয়ে ওঠে। দুঃখ ভুলতে সারাদিন একা একা সে টইটই ঘোরে মাঠে-প্রান্তরে-গাঙের ধারে। কখনও উদাস হয়ে চেয়ে থাকে বন-প্রকৃতির দিকে। কখনও সুরেলা পাখির পিছনে ছুটতে ছুটতে তার দিন যায়। কোনও ফকির মেঠো পথে সুরের সারিন্দা নিয়ে হেঁটে গেলে, খেলা ছেড়ে লালন তার পিছু নেয়।

একদিন ফকিরের হাত থেকে একতারা নিয়ে সত্যি সত্যিই সে শিখে নেয় সুর-সাধন।

আনমনে গায়, ‘কার বা আমি কেবা আমার/ আসল বস্তু ঠিক নাহি তার।’

বাবার মৃত্যুর পর সংসারের সব দায় এসে পড়ে তার উপর। একদিন বিয়েও হল। দিন যত যায়, তার রকমসকম দেখে নানা কথা ওড়ে হাওয়ায়।

পড়শিদের কানাকানিতে আর দারিদ্রের জ্বালা সঙ্গে নিয়ে, লালন পথে নামে। সঙ্গে মা আর নতুন বৌ। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ায় ভাঁড়ারা গ্রামের শেষ ঠিকানা দাসপাড়ায়। সেখানেই নতুন করে ঘর বাঁধে লালন। কিন্তু সংসারে মন কই তার!

মন যে বাঁধা মনের ওপারে!

‘না জেনে ঘরের খবর তাকাও কেন আসমানে।’ দোতারায় সুর তুলেছে কমল।
লালন যখন নতুন করে ঘর বাঁধে, তখনও সারাক্ষণ তার বিবাগী মন নিভৃতে খুঁজেছে এর উত্তর।
এই দেহটাই কি তবে ঘর, কখনও খাঁচা? নাকি আরশিনগর?
লালন কি তবে শান্তরতির পথে বিশ্বাসী ছিলেন?

নাম জানা নেই। মুর্শিদাবাদের এক তরুণ বাউল বগলে খমক চেপে ধরতে ধরতে বললেন, ‘‘শান্তরতি নয়, এ সাধনা যে কামাচারের সাধন! লালন সাঁইয়ের গানেই রয়েছে এর সহজ উত্তর। শুনুন তবে — ‘তিরপিনির তীর-ধারে, মীনরূপে সাঁই বিহার করে’।

সাঁই আমার কখন খেলে
সে বার গাঁ থেকে অনেকে গঙ্গাস্নানে চলল মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে।
লালনও ঝোলা নিয়ে সঙ্গী হল দাসপাড়ার পড়শিদের। ক’দিন বেশ কাটল তার। কত নতুন মানুষ, কত কথার ভিড়।
স্নান তো হল, এ বার ফেরা। ফেরার পথেই লালনের গা গরম হল। ধুম জ্বর!
‘বসন্ত হয়েছে লালুর! গুটিবসন্ত! গুটিবসন্ত!’

জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে বকতে লালন একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কে দেখবে তাকে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে!‌

রাত্তিরে জ্বর বাড়ল প্রবল। কোনও সাড় নেই শরীরে। সঙ্গীরা রোগের সংক্রমণের ভয়ে দেহ ফেলে রেখেই চলল। কারা যেন মুখাগ্নি করে ভাসিয়ে দিল তার শরীর!

গাঁ-ঘরে রটল লালনের মৃত্যু সংবাদ। পুত্রশোকে কান্নায় ভেঙে পড়লেন লালনের মা। কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে গেল বৌয়ের।

কলার ভেলায় লালনের দেহ ভেসে চলল গাঙের ঢেউয়ে ঢেউয়ে। কত গ্রাম, কত পথ।

‘‘এ পথই যেন সাঁইজির এক জন্ম থেকে জন্মান্তরের যাওয়ার পথ’’, শ্রুতি নির্ভর লালনের মরা-বাঁচার গল্প বলছিলেন বৃদ্ধ দরবেশ। লালনকে নিয়ে এমন কাহিনির মিশেল সুনীলের উপন্যাসেও আছে।

কাল্পনিক। তবু সে লালনের যাত্রাপথের কথায় সুনীল লিখছেন, ‘‘কখনও আটকে যায় কচুরিপানায়। কখনও সাহেবদের কলের জাহাজ ভোঁ বাজিয়ে গেলে বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় সরে যায় পাড়ের দিকে। ... ভেলা এসে ঠেকল একটা মস্ত বড় গাছের শিকড়ে। সেখানে নদীর পাড় ভাঙছে, গাছটির গুঁড়ির কাছেই ছলাৎ ছলাৎ করছে ঢেউ। পাশেই একটা গ্রাম্য ঘাট। সেই ঘাটে সারাদিন পুরুষরা এলেও সন্ধের সময় শুধু নারীরাই জল সইতে আসে। ... তিনজন রমণী সেই ঘাটে দেহ প্রক্ষালন করছে। গ্রামটি মুসলমান প্রধান। রমণীরা নিজেদের মধ্যে কলস্বরে কথা বলছিল, হঠাৎ যেন তারা কাছেই উঃ শব্দ শুনতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে কথা থামিয়ে তারা উৎকর্ণ হল।... খুব কাছেই, পুরুষের কণ্ঠ। দু’জন রমণী সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে দৌড় দিল আলুথা‌লুভাবে। একজন দাঁড়িয়ে রইল...!’’

হায় আল্লা! বেঁচে আছে তো!
পিপাসায় ঠোঁট শুকিয়ে আসছে লালনের। শোনা গেল কেবল, ‘জল, জল!’
জলের কথা শুনে রমণী আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘আমরা মুসলমান!’
আর যে পারছে না লালন। সে আবার বলল, ‘মানুষের আবার জাত কি। জল দাও একটু। জল...!’

ঘাটের এই রমণীই লালনকে সেবায় ভরিয়ে সুস্থ করেন। নিয়ে যান ঘরে। কী নাম রমণীর? আর তাঁর স্বামী?

গবেষকদের কেউ বলছেন, ছেঁউড়িয়ার মলম কারিকর। আর তাঁর স্ত্রী-ই লালনকে সুস্থ করে তোলেন। তাঁর ঘরে সে সময় সিরাজ সাঁই এসেছিলেন। রমণীর সেবায় আর সিরাজের ওষুধে রোগমুক্তি ঘটল কয়েক দিনেই। বল ফিরল শরীরে। কিন্তু মুখে বসন্তের দাগ রয়ে গেল। চির জন্মের মতো অন্ধ হয়ে গেল একটি চোখও। কোনও কোনও গবেষক বলেন, ‘মলম’ নয়, লালনকে সিরাজই ঠাঁই দিয়েছিলেন।

লালন চেয়েছিল, সিরাজের সঙ্গেই পথে হারাতে। সিরাজ সঙ্গে নেননি।
কেন নেননি?
প্রশ্ন শুনে স্মিত হেসে দরবেশ বলেন, ‘‘তখনও যে সংসারে লালনের কাজ বাকি।’’
লালন ফিরল আপন গাঁয়ে।

মিলন হবে কত দিনে
ফিরল বটে, গ্রাম তাকে মানল না। তাকে দেখে আনন্দ আর বিস্ময়ে চমকে উঠল মা আর বৌ। কিন্তু সারা মহল্লা রটে গেল, লালনের জাত গিয়েছে। সে মুসলমানের অন্ন-জল গ্রহণ করেছে। ভাঁড়ারা গ্রাম তাকে ভিটেছাড়া করল।
একতারা আঁকড়ে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে যে পথে এসেছিল, হাঁটা দিল আবার সেই পথে।
এত দুঃখ, এত দহন!
লালনের তখন কত বয়েস? যৌবনের মধ্যভাগ।

তাঁর কেবল মনে হল, এ কেমন জাত? এ কেমন ভগবানের বিচার? মনের রঙে বৈরাগ্যের রং ধরল তার। ঘর ছাড়ার সময় বৌকেও ডেকেছিল। সেও সঙ্গে এল না! অভিমানে-কান্নায় তখনই বুঝি মনে মনে গান বাঁধল লালন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।/ লালন বলে জেতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।’

ফের দেখা হয়ে গেল কাহার-সম্প্রদায় ভুক্ত বাউলগুরু সিরাজের সঙ্গে। কে এই সিরাজ সাঁই?

‘‘সিরাজ হলেন আমাদের সাঁইয়ের গুরু দরবেশ। সুফি সাধক।’’

দরবেশের উত্তর শেষ হলে, ওপারের এক ফকির বললেন, ‘‘নানা জনের নানা মত। তবে কেউ কেউ বলেন, দীক্ষা লাভের আগেই লালন সাঁইয়ের ধর্মান্তর ঘটেছিল।’’

মনে পড়ল লালনের প্রথম জীবনীকার বসন্ত পালের অভিমত। তিনি বলছেন, সিরাজ সাঁইয়ের জন্ম যশোরের ফুলবাড়ি গ্রামে।

লালনের মতোই তাঁর গুরুজির পরিচয় নিয়েও নানা ধন্ধ!

লালন নিত্য নানা প্রশ্ন করতেন সিরাজকে। বিশ্ব সংসার ও জগৎ নিয়ে তাঁর সে সব কৌতূহল মেটান সিরাজ সাঁই। ধীরে ধীরে লালন জানতে পারে, সাধনার আরেক রূপ ‘রংমহল’-এর কথা। সেও এক দেহতত্ত্ব। তাতে নাকি তালা লাগানো। ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে সেই তালা খোলা শিখতে হয়। লালন তাই সিরাজের কাছে দীক্ষা নেন। জানতে পারেন সাধনসঙ্গিনীর কথা। দিন দিন মনের মানুষের সন্ধানে লালন যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।

গহন বনে একলা বসে গান, ‘আমার মনের মানুষের সনে/ মিলন হবে কত দিনে।’

ঠিক এই সময় থেকেই নতুন নতুন কথা এসে বাসা বাঁধে তাঁর প্রাণে। তাতে সুর বসিয়ে গেয়েও ফেলেন।

‘‘সিরাজ সাঁইয়ের সংর্স্পশে এসে লালন জেনেছেন, মহাযোগের খবর। সে খবর যোগেশ্বরীকে ধরে জানতে হয়। জেনেছেন, সবই রস-রসিত খেলা। আর তারই মাঝে বাউলের সাধনা বায়ুর সাধনা। তাকে জানতে হয় কখনও অমাবস্যা, কখনও জোয়ার। কামের ঘরে কপাট মারতে হয়,’’ ফকির বলতে বলতে থামে।

সাধন করতে সঙ্গিনী লাগে। অথচ সাধন তো হয় একার! এ কেমন ধারা?

কলকে রেখে সে বলে,‘‘বাউল চিরকাল একা। সে কখনও অনুমানে বিশ্বাস করে না। গুরু লালন সাঁইও করতেন না। আমরা লালনপন্থীরাও করি না! লালন বলেছেন, রস-রতির যোগ সাধনায় পুরুষ আর প্রকৃতি মিশে আছে। বলছেন, ‘হাওয়া ধর অগ্নি স্থির কর/ যাতে মরিয়া বাঁচিতে পার/ মরণের আগে মর/ শমন যাক ফিরে।’’

ফকিরি করবি খ্যাপা কোন রাগে
খড়ের চালের কয়েকটা বাঁশ-বাতার ঘর। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে বাঁকা নদী। ওপারে আদিগন্ত চর। ধু ধু বালিয়াড়ি।
কখনও সখনও নির্জন নদীঘাটে নৌকো এসে থামে। ঘুঙুরালি সুর তুলে শিষ্যরা এসে বসে আখড়ায়।

লালন গায়, ওরা বাজায় খমক-দোতারা। ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর। সেথায় এক পড়শি বসত করে।’ গায়, ‘দেহের মাঝে নদী আছে।/ সেই নদীতে নৌকা চলছে/ ছয়জনাতে গুণ টানিছে/ হাল ধরেছে একজনা।’

সিরাজের কাছে দীক্ষা নিয়ে কুষ্টিয়া কাছে ছেঁউড়িয়ায় নদী কিনারে লালন আখড়া করেছেন। জনশ্রুতি আছে, ছেঁউড়িয়া মৌজায় লালন-ভক্ত মলম-শাহ কারিকর লালন ফকিরকে সাড়ে ১৬ বিঘে জমি দান করেন। তার উপরই এই আখড়া গড়ে ওঠে।

সেটা বাংলা ১২৩০ সাল।

চরের দিক থেকে অজয়ের জল ছুঁয়ে হাওয়া ফিরছে। দূরের গাঁ থেকে ভেসে আসছে সংকীর্তন। খোল-করতালে মহাপ্রভুর নাম-গান। এ পারে আখড়ার লালন সুর কখনও সখনও কীর্তনের সেই সুরে মিলে মিশে একাকার। রাত গড়াচ্ছে পাল্লাগানে। কখনও বাউলের জবাবে ফকির ম্রিয়মান, কখনও দরবেশের বাহাসে কাবু বাউল।

ওরই মাঝে প্রথম দিকে সাঁইজির আখড়া কেমন ছিল, উৎকর্ণ হয়ে জানতে চাই ওপারের বাউল-বাউলানির কাছে।

‘‘মুখে মুখে যে কথা ঘোরে তা হল— প্রথমে ছেঁউড়িয়ায় গ্রামের বাইরে একটি বনের মধ্যে আম গাছের নীচে বসে সাধনা করতেন লালন সাঁই। বন থেকে খুব একটা বের হতেন না প্রথমে। পরে ওই গ্রামের কারিগর সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় গড়ে উঠল আখড়া। একে একে এসে জুটলেন তাঁর শিষ্যরা। শীতল, মনসুর, মনিরুদ্দিন। গাঁ-ঘরের লোকও তাঁকে গুরু মানল। শীতল ও ভোলাই ছিল ছেলের মতো।

কখনও সখনও নাকি তিনি বেরিয়ে পড়তেন ঘোড়ায় চরে। কখনও একা, কখনও শিষ্য সঙ্গে। পাবনা, রাজশাহি, ফরিদপুরের পথে। সে সময় শিষ্য বাড়তে থাকে তাঁর।’’ বলতে বলতে থামলেন ওপারের ফকির। জানালেন, শুধু ছেঁউরিয়া নয়, এখনও এমন করেই লালন-কথা মুখে মুখে ফেরে ওপারে।

মানুষের সেবায় কবিরাজী চিকিৎসাও করতেন লালন। গবেষকরা বলেন, শিষ্য ভোলাইয়ের গানের খাতায় তেমন ওষুধ ব্যবহারের বিধির নজির মিলেছে। আসলে, মানুষের জন্য প্রাণ কাঁদত তাঁর। নিরাশ্রয়-নিঃসঙ্গ মা মারা যাওয়ার পর, সাঁই তাঁর গ্রামে আখড়া থেকে খাবার পাঠিয়েছিলেন নিজের গ্রামে শ্রাদ্ধের জন্য।

আসলে লালন কেবল সাধক ফকির ছিলেন না, জগত-সংসারের খবরও রাখতেন। ছিলেন স্বভাবকবি। ছন্দমিল নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তাঁর শিষ্যরা সেগুলি লিখে রাখতেন। লিপিকরের কাজ করতেন মানিক শাহ ওরফে মানিক পণ্ডিত। আর মনিরুদ্দিন শাহ।

প্রাণে গান এলে বলতেন, ‘ওরে আমার পুনা মাছের ঝাঁক এসেছে।’
কেউ কেউ বলেন, এই আখড়া গড়ে তোলার পর সাঁই ফের বিয়েও করেন।

মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের তেমন একটি লেখার কথা বলা যাক। তিনি লিখছেন, ‘‘কিছুকাল পরে একজন বিধবা বয়নকারিণী মুসলমানীকে তিনি (লালন) নেকাহ করেন এবং পানের বরোজ করিয়া তাহার ব্যবসা করিতে থাকেন। ফকিরকে প্রায়ই দেখা যাইত না, শুনা যাইত তিনি নির্জ্জন স্থানে বসিয়া নিজতত্ত্বে মগ্ন থাকিতেন এবং গান রচনা করিতেন।’’ কোনও কোনও গবেষকের দাবি, ইনিই ছিলেন লালনের প্রেম-সাধিকা। সাধনসঙ্গিনী।

নিজের পূর্ব-স্ত্রীর মৃত্যুর পর এই বিশাখা বা মতিবিবিকে জীবনসঙ্গিনী করে সাঁই সাধন-ভজন করতেন ‘হকের ঘর’ নামে আখড়ারই একটি ঘরে। সেখানে বসেই, শিষ্যদের সঙ্গে বাহাসও করতেন। বলতেন, ‘‘এ বিশ্ব সংসারে আমি নিঃস্ব!’’

বাড়ির কাছে আরশিনগর
কেমন দেখতে ছিলেন ফকির লালন সাঁই?
স্মৃতি থেকে ডুব দিই ‘মনের মানুষ’-এর পাতায়। যেখানে জ্যোতিরিন্দ্রের আহ্বানে লালন গিয়েছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জ্যোতিদাদার তখন পোর্ট্রেট আঁকার পর্ব চলছে।
‘‘দ্রুত হাতে কয়েকটা টান দিয়ে রেখাচিত্রটি সম্পূর্ণ করে জ্যোতিরিন্দ্র বলল, এই দিকে এসে দেখুন তো, আপনার মুখখানি ঠিক হয়েছে কি না।

লালন উঠে এসে জ্যোতিরিন্দ্রের পাশে দাঁড়াল। ছবিটি দেখার পর হাসি ছড়িয়ে গেল তার সারা মুখে।
সে বলল, বাবুমশাই, আমার মুখখানি কেমন দেখতে, তা তো আমি জানি না। কখনও দেখি নাই।
জ্যোতিরিন্দ্র বলল, সে কী? নিজের মুখ কখনও দেখেননি? এই যে গাইলেন আরশিনগরের কথা?’
লালন বলল, ‘‘সে আরশিনগরে নিজেকেও দেখা যায় না, পড়শিকেও দেখা যায় না!’’

লালনের কী এমন ছবি এঁকেছিলেন রবিঠাকুরের জ্যোতিদাদা, যা দেখে উপন্যাসের সাঁই হেসেছিলেন!

রবীন্দ্রভারতীতে ১৮৮৯ সালের ৫ মে শিলাইদহে বোটের উপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালনের যে পেনসিল স্কেচটি রয়েছে, তাতে লালন ন্যুব্জ। অসম্পূর্ণ হলেও, সেটিই একমাত্র লালনের পার্থিব অবয়ব। ছবির উপর লেখা ‘লালন ফকির। শিলাইদহ বোটের উপর।’ গবেষকদের অনুমান, এ ছবি লালনের মৃত্যুর এক বছর আগে আঁকা। নন্দলালও এক সময় এই স্কেচটি দেখে লালনকে এঁকেছিলেন। তবে নন্দলালের লালন-এর খাড়া নাক। মাথার চুল বাঁধা।

‘হিতকরী’-র নিবন্ধকার স্বচক্ষে দেখেছিলেন লালন ফকিরকে। তাঁর লালন একটু অন্য।
বাবরি চুল, একটি চক্ষু দৃষ্টিহীন। মুখে বসন্তের দাগ।

একটু আগে ওপারে সংকীর্তন হচ্ছিল, কখন যেন থেমে গিয়েছে। চরের দখিন হাওয়ায় মিঠে শিহরণ।
আখড়া এখন ফাঁকা।
কেন্দুলিতে ভোর নামছে।
বালি ভেঙে ভেঙে গোড়ালি ভেজানো জল পেরিয়ে বাউল-বাউলানি, ফকির, দরবেশরা হেঁটে যাচ্ছে দূরে জলের গহনে।
কানে এখনও বেজে চলেছে, ওদের সমবেত লালন-সুর।
‘চাতক প্রায় অহর্নিশি/ চেয়ে আছে কালশশী।’

পাখি কখন যেন উড়ে যায়
শেষের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু নিরন্তর তত্ত্বালাপে মেতে থাকতেন। সে সময় রোগশয্যায় দুধ ছাড়া আর খুব একটা কিছু খেতেন না। খেতে চাইতেন মাছ।

অসুস্থ শরীরে একদিন যে সামান্য জোতজমা, বাড়ি-ঘর ছিল তার অন্তিম দানপত্র করে স্ত্রী, কন্যা, শিষ্য-জামাতা শীতলকে দিয়ে দিলেন।

শেষের সময় শিয়রে প্রায়, বুঝতে পেরে, সাধন সঙ্গিনী ও ধর্মকন্যা পিয়ারী সারাক্ষণ তাঁর পাশে পাশে থাকত, লালন তবু তাঁদের বুঝতে দিতেন না, কষ্টের কথা।

একদিন নগদ দু’হাজার টাকাও রাখলেন সৎকারের জন্য। শিষ্যদের বললেন,
‘‘ইন্তেকাল হলে হিন্দু মতে দাহ হবে না। আবার ইসলামি মতে জানাজা নামাজও পড়া যাবে না।’’
আর যে দিন চলে গেলেন, রাত থেকে শিষ্যরা নাম-গান করেছে। ‘পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে।/ ক্ষম হে অপরাধ আমার ভবকারাগারে।’
কার্তিকের সেই ভোরের কথায় বসন্তকুমার পাল লিখেছেন, লালনের রোগশয্যার কথা।

শেষের দিনও সাঁই সারা রাত্তির গান করেছেন। গলা উঠেছে তারসপ্তকে, ‘পাখি কখন যেন উড়ে যায়।/ বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়।’ রাত যখন ফুরিয়ে এল, নদীর জলে আলো এসে পড়েছে সবে, শেষ হল গান।

বসন্তকুমার লিখছেন, ‘‘স্বরলহরী থামিয়া গেল, সমস্ত গৃহতল নীরব নিস্তব্ধ, ইহার পর শিষ্যগণকে সম্বোধন করিয়া ‘আমি চলিলাম’ বলিয়া তাঁহার কণ্ঠ হইতে শেষ স্বর উচ্চারিত হইল, নেত্রদ্বয় নিমীলিত করিলেন, সমাজ পরিত্যক্ত দীন ফকিরের জীবননাট্যের যবনিকাপাত হইল।’’

একটু পরেই নাড়ি স্থির হয়ে এল। শিষ্যরা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।

সে দিন ছিল কার্তিকের পয়লা!

ঋণ: ‘লালন সাঁই’ (আবুল আহসান চৌধুরী), ‘ফকির লালন সাঁই’ (শক্তিনাথ ঝা), ‘মনের মানুষ’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়), ‘বাউল’ (জসীমউদ্দীন), ‘আলালদোস্ত সেবাকমলিনী লালন’ (সুধীর চক্রবর্তী), ‘লালন ফকির ও তাঁর গান’ (অন্নদাশঙ্কর রায়), ‘মরমীয়া লালন’ (নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত সংকলন), ‘অচিন পাখি’ তথ্যচিত্র, (পরিচালক: তানভির মোকাম্মেল)

সূত্রঃ আনন্দবাজার প্রত্রিকা

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
আমরা কুকিজ ব্যবহার করি
আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে কুকিজ ব্যবহার করি। তাদের মধ্যে কিছু সাইট পরিচালনার জন্য অপরিহার্য, অন্যরা আমাদের এই সাইট এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সাহায্য করে (কুকিজ ট্র্যাক করা)। আপনি কুকিজকে অনুমতি দিতে চান কিনা তা আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দয়া করে মনে রাখবেন যে আপনি যদি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেন তবে আপনি সাইটের সমস্ত কার্যকারিতা ব্যবহার করতে পারবেন না।