বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

মারফত আলী গন মানুষের নেতা
মারফত আলী গন মানুষের নেতা

আততায়ীর গুলিতে মারা যাওয়ার পর তার মরদেহ যখন আমলা হাই স্কুল মাঠে আনা হয় তখন লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিলো। কারো মৃতুতে এত লোক, এমন কান্না কেউ কখনও দেখেনি।

মারফত আলী একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন। কুষ্টিয়া কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ১৯৬৮- ৬৯ সালে সাধারন সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। কুষ্টিয়া কলেজ থেকে বি,এস,সি পাশ করেন।

মারফত আলী একজন উন্নতম সেরা মুক্তিযোদ্ধা। মিরপুর থানা, গাংনী থানা, আলমডাঙা থানায় তার নেতৃত্বে বহু সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধারা সফলতা পেয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি আমলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আমলা কলেজে ঢুকে বাম হাতে তার কবর আছে।

মারফত আলী ১৯৪৪ সালে মিরপুর থানার মালিদাহ গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা - মৃত মকছেদ আলী, মাতা - রমেছা খাতুন। তার স্ত্রী আঞ্জুমান মারফত একজন সমাজসেবিকা ও রাজনীতিবিদ তার একটি কন্যা। মারফত আলী ১৯৯১ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারী আততায়ীর গুলিতে প্রান হারান।

গন মানুষের নেতা মারফত আলীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ মাঠে পতাকা উত্তোলন ও সাধীনতার ইস্তেহার পাঠের দৃশ্য
১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ কুষ্টিয়া হাই স্কুল মাঠে মারফত আলীর নেতৃত্বে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ ও অভিবাদন। অভিবাদন গ্রহন করছেন জনাব গোলাম কিবরিয়া এমপিএ
১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ জনগনের নেতা মারফত আলীর নেতৃত্বে কুষ্টিয়া হাই স্কুল মাঠে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ এর ছবি।
১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ জনগনের নেতা মারফত আলীর নেতৃত্বে কুষ্টিয়া হাই স্কুল মাঠে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ এর ছবি।

তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৬ দফা দাবী আদায়ের জন্য আলমডাঙা, গাংনী,মিরপুর দৌলতপুর সহ জেলার বিভিন্ন স্কুলে এবং গ্রাম গঞ্জে সভা সমাবেশ করে সাধারন মানুষের ভেতর ৬ দফা বাঙ্গালীর খবরদারি সম্পর্কে বোঝান এ দাবি আদায় করার জন্য সংগঠন প্রয়োজন কর্মী প্রয়োজন। মারফত আলী নি:সার্থ ভাবে সাধারন মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রসার করে সংগঠন গড়ে তোলেন। সাধারন মানুষের বিভিন্ন দাবী দাওয়া আদায় করে দিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ৬৯ এর ছাত্র গন আন্দোলনে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায় ব্যাপক ভুমিকা রাখে। গ্রামগঞ্জে সভা সমাবেশ করার কারনে সাধারন মানুষের নেতা তথা কৃষকদের জন্য আন্দোলন করায় কৃষক নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়। ছাত্র নেতা মারফত কে স্কুল কলেজে গেলে তাকে দেখার জন্য, তার মুখের কথা শোনার জন্য ভিড় লেগে যেতো। ৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নৌকায় প্রাথমিক জয়লাভ করার জন্য সমগ্র জেলায় কাজ করেন এবং একজন ত্যাগী যুব কর্মী হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠে।

৭০ সালের নির্বাচনে ৬ দফা দাবী আদায়ের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ছাত্র জনতার জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বক্তব্য রাখতো। মারফত আলী ১৯৬৭ সালে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য তথা নিউক্লিয়াসের সদস্য হন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনার জন্য ঢাকায় যান। ঢাকা থেকে ফিরে এসে জেলার বিভিন্ন যায়গায় জয় বাংলা বাহিনী গঠন করে বেড়ায় এবং জেলা জয় বাংলা বাহিনীর সহকারী কমান্ডার হয়ে ছাত্র যুবকদের সামরিক ট্রেনিং দেওয়ার জন্য বিভিন্ন থানায় কাজ করেন। ২৩ শে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসকে বাংলাদেশ দিবস হিসেবে ঘোষনা দিয়ে কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন যায়গায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে এবং জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ করার জন্য কুষ্টিয়া হাই স্কুল মাঠে সমবেত হন। প্রতি থানা থেকে জয় বাংলা বাহিনীর সদস্যগন দেশী বিদেশী অস্ত্র নিয়ে হাই স্কুল মাঠে সমবেত হয় এবং তার নেতৃত্বে কুচকাওয়াজ হয়। সবাই সপথ গ্রহন করে দেশ স্বাধীন করার। জন্য। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে সালাম গ্রহন করেন গোলাম কিবরিয়া এম, পি, এ।

জয় বাংলা বাহিনীর কাজের সুবিধার জন্য আমলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস থেকে একটি নতুন জীপ গাড়ী নেন এবং উক্ত গাড়িতে করে মারফত, বারী ভাই, সামসুল হাদী, আব্দুল মোমেন, মেহেরপুরের বিখ্যাত ডাকাত আলীহীম ডাকাতের ভাই ইংরেজ ডাকাতের বাড়ীতে যায় জয় বাংলা বাহিনীর সদস্যদের বোমা বানানো সেখানোর জন্য এবং সেই বোমা বানানো শেখায়।

বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতি সাধনে এবং শোষনমুক্ত সমাজ গঠনে যে সকল রাজনীতিবিদ ও চিন্তাবিদ কালের অমোঘ বিধানে আপন মহীমায় চির ভাস্কর হয়ে আছেন, বিংশ শতাব্দীর ক্ষণজন্মা পুরুস্কার শহীদ মারফত আলী তার মধ্যে অন্যতম। শৈশব মলিহাদের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত সহপাঠিদের সাথে কাটান। তাহার শিক্ষা জীবন ছিল্য অত্যন্ত কষ্টের। হাট বোয়ালীয়া উচ্চ বিদ্যালয় হতে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপন করে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ হতে বি,এসসি, ডিগ্রী লাভ করেন এবং ঐ সময় তিনি কলেজের ছাত্র সংসদে সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্কুল ও কলেজে অধ্যায়ন কালে তিনি বিভিন্ন রাজনীতিবিদের সহিত ঘনিষ্ঠ সহচর্যের কারনে মেজাজের দিক দিয়ে রাজনীতির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষ ভুমিকা পালন করেন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাদরি অংশগ্রহন করেন।

শহীদ মারফত আলীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছিলো অনন্য। শৈশব কাল থেকেই তিনি বাংলাদেশের নীপিড়িত, লাঞ্চিত - বঞ্চিত ধনীক ও বনীক শ্রেনীর কবল থেকে মুক্ত করে একটি শোষনমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। তিনি তার রাজনৈতিক মতাদর্শের মাধ্যমে ন্যায় বিচারকে প্রতিষ্ঠা করে একটি আদর্শ রাষ্ট্র " An Ideal State " খুজে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি উপলব্ধি করেন যে, যে মেনোফেষ্টোর উপর শপথ রেখে এদেশকে স্বাধীন করা হয়েছিলো তার কোনটায় পুরন হচ্ছে না, কামার, কুমার, ধোপা, জেলে, নাপিত, মাস্টার, ডাক্তার, প্রভৃতি পেশাজীবীদের প্রকৃত স্বার্থ ও অঙ্গীকার রক্ষা পাচ্ছে না। মেজর জলিলের কঠিন নেতৃত্বে তিনিও '৭১ এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেক বার ' এই শ্লোগান নিয়ে তদানিতন

উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তিনি কৃষি উপাদন ,শিক্ষা,সাংস্কৃতি,খেলাধুলার প্রতি বেশী নজর দেন। তিনি সর্ব প্রথম এতদাঞ্চলের ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা সম্পর্কে প্রথম চিন্তা করেন এবং তারি প্রচেষ্টাই সর্বোচ্চ শিক্ষার পাদপীঠ আমলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৮ সালে অক্লান্ত পরিশ্রম করে উক্ত কলেজকে সরকারীকরন করান।

বস্তুতঃ নারী শিক্ষার প্রতি তার আশক্তি ছিলো অসাধারন। তারই অদম্য ইচ্ছায় জাহানারা মধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের উন্নতি সাধিত হয় এবং মিরপুর উপজেলা বালিকা বিদ্যালয়কে সরকারীকরন করান । তার সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে গেলে তাহার জীবদ্দশায় মিরপুর উপজেলা তথা কুস্টিয়ার শিক্ষা,সংস্কৃতি,ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার চরম উকর্ষ সাধিত হয়।

ব্যক্তি জীবনে মারফত আলী ছিলেন অসাধারন ব্যক্তি।তিনি সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলতেন। কোন জটিল বষয়কে তিনি সহজ ভাবতেন এবং অসাধ্য কথাটি তার কাছে হার মানতো। সাধারন মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি সর্বদা কর্ম চঞ্চল ছিলেন। তিনি কোনদিন নিজের চিন্তা করননি। তার খাওয়া দাওয়া পোশাক পরিচ্ছেদ ছিলো অতি সাধারন অতি নগন্য। সাধারন মানুষের সাথে মিলনের জন্য তিনি আমলা বাজারে আমোদ আলীর চায়ের দোকানকে বেছে নিয়েছিলেন এবং সকাল ও সন্ধ্যায় এখানেই বসে তিনি রাজনীতি,ধর্ম,সামাজিক,সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা ও মত বিনিময় করতেন। তিনি অট্টলিকার মোহ পরিত্যাগ করে সদরপুর গ্রামে এক খড়ের ঘরে শুয়ে থাকতেন।

শহীদ মারফত আলী তাহার রাজনৈতিক মতাদর্শের উৎপাদক শ্রেনীকে বেশী গুরুত্ব দিতেন। তাহার চেতনা ছিলো যেহেতু উৎপাদক শ্রেনীয় জাতির উন্নতির নিরামক শক্তি এবং এই শ্রেনীই হবে আদর্শ রাস্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নাগরিক ও শাসনকর্তা। তিনি নিজেও একজন চাষী ছিলেন এবং চাষাবাদে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ উৎপাদকের মধ্যে উন্নতম ছিলেন। চাষাবাদে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জনের জন্য তিনি ১৯৮৯ সালে সরকারি পৃষ্টপোসকতায় ইন্দোনেশিয়া,ফিলিপাইন,মালাক্কা দীপ ও মরোক্ক প্রভৃতি দেশে কৃষির উপর বিভিন্ন গবেষনা অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। মোট কথা তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ট কৃষিবিদ ও গবেষক।

সুর্যের প্রতিফলিত ছায়াগুলি যায় অগ্রে অথবা পিছনের সদুরে। শোষনমুক্ত সুন্দর সুসৃঙ্খল গঠন প্রচেস্টায় সামান্য সমালোচনার মুখাপেক্ষি হলেও একথা স্বরনযোগ্য যে ,তিনি ছিলেন এতদঞ্চলের তীক্ষ্ণ ধী-সম্পন্ন একজন চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক চিন্তা ধারার অনন্য ব্যক্তিত্ব।

Add comment

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
আমরা কুকিজ ব্যবহার করি
আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে কুকিজ ব্যবহার করি। তাদের মধ্যে কিছু সাইট পরিচালনার জন্য অপরিহার্য, অন্যরা আমাদের এই সাইট এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সাহায্য করে (কুকিজ ট্র্যাক করা)। আপনি কুকিজকে অনুমতি দিতে চান কিনা তা আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দয়া করে মনে রাখবেন যে আপনি যদি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেন তবে আপনি সাইটের সমস্ত কার্যকারিতা ব্যবহার করতে পারবেন না।