বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

ভাষা আন্দোলন ও ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
ভাষা আন্দোলন ও ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯) একজন প্রকৃত জ্ঞানতাপসের প্রতিকৃতি। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলা ভাষাকে জ্ঞান সম্পদে রূপান্তরকারী এবং গৌরবদীপ্ত অধ্যয়ের সূচনাকারী হিসেবে তিনি সর্বদা মূল্যায়িতও বটে। তাঁর কৃতিত্ব বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির আলোচনায়।

যে বাংলা ভাষার কারণেই বাঙালি জাতির বাঙালিত্ব একটি সংজ্ঞাযোগ্য রূপ লাভ করেছে, সেই বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করতে অনেক বাধা-বিপত্তি ও লড়াই-সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাঙালির প্রত্যয় ও পরিচয় ভাষাভিত্তিক ও আত্মরক্ষামূলক। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন সেই আত্মপরিচয় রক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সূচনা করেছে। একটি জাতির ঐক্য, সংহতি, স্থিতিশীলতা ও অস্তিত্বের পক্ষে ভাষার অস্তিত্ব একান্তই প্রয়োজন। তাই বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসাবে ভাষা আন্দোলন এক মাইলফলকের ভূমিকা পালন করেছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাঙালি রাষ্ট্রসত্তার যুক্তিনিষ্ঠ বিকাশের লক্ষ্যে এবং বাঙালির জাতিসত্তার মূলে যে বাংলা ভাষা তার মযার্দা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একনিষ্ঠ একজন রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

ইতিহাসের কোনো কোনো পর্যায়ে শাসকশ্রেণি যে বিশেষ আদেশ বলে জনগণের ভাষার বদলে আভিজাত শ্রেণির ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, সেই চেষ্টাকে প্রতিহত করার দ্রোহী বুদ্ধিদীপ্ত প্রত্যয়ে যাঁরা এগিয়ে আসেন ড. শহীদুল্লাহ্ তাঁদের মধ্যে একজন। বলতে গেলে অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে ভাষা আন্দোলনে দ্রোহী বুদ্ধিজীবীর ভূমিকাই পালন করেছেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের মনোস্তাত্ত্বিক পর্বে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা ও লেখনির শক্তির বিরাট প্রভাব ছিল। বিশেষ করে তাঁর লেখায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবির পক্ষে জ্ঞানগর্ভ যুক্তিসমূহ ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্ব থেকে সমাপ্তির পরেও ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাস্তবায়নে যাঁরা কাজ করেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তাদের অন্যতম।

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ভাষাকে এক বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। তখন বাংলা ভাষার নাম বাংলা হয়নি। বাংলা তখন জনগণের কথ্য ভাষা কিংবা কেবল ‘ভাষা’ নামে পরিচিত। সুকুমার সেন স্বীকার করেছেন যে, আঠারো শতকের আগ পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিশেষ কোনো নাম ছিল না। যাঁরা প্রগাঢ় পন্ডিত তাঁরা ছাড়া প্রাকৃত-অপভ্রংশ-অবহট্ঠ ভাষার নামও কেউই জানত না। সাধারণ শিক্ষিত মহলে দুটি দেশি ভাষার নাম প্রচলিত ছিল। এক, শাস্ত্রের ও পন্ডিত ভাষা-সংস্কৃত। দ্বিতীয় ভাষাটিকে তখন ‘দেশি’, ‘লৌকিক’, প্রাকৃত (বা পরাকৃত) ভাষা, অথবা শুধু ‘ভাষা’ বলা হত, যা অপভ্রংশের মাতৃজঠর থেকে ভূমিষ্ঠার পথে ‘দেশি ভাষা’ হিসেবে চিহ্নিত। ঐতিহাসিক প্রয়োজনের খাতিরেই সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে এর সূত্রপাত। বৌদ্ধ যুগে এর সূচনা হলেও রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং শাসক গোষ্ঠীর পরিবর্তনের সাথে সাথে এর ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। বাংলায় সেন রাজাদের শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষারও ভাগ্য বিপর্যয় চূড়ান্ত হয়ে ওঠে। সেন রাজারা রাষ্ট্রীয় আদেশ বলে জনসাধারণের ভাষা বাংলা চর্চা নিষিদ্ধ করেন। আধ্যাত্মিক সূচিতা ও কৌলিণ্য রক্ষার অজুহাতে হিন্দু শাস্ত্রবেত্তা ও সংস্কৃত পন্ডিত-গণ এমন ফতোয়াও জারি করেন- ‘অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতা নিচ ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।’ অর্থাৎ- ‘অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ন যে মানব বাংলা ভাষায় শুনবে, তাঁর ঠাঁয় হবে ভয়াবহ রৌরব নরকে।’ এই কৌলিণ্যবোধের ধারা ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। শাসনকর্তারা যে ভাষা, ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ঐতিহ্যবোধের উত্তরাধিকারী শাসিতের ওপর তার প্রভাব অনিবার্যভাবে বর্তায়। দেশীয় ভাষা বাংলা অতীতে কোনোভাবেই রাজসভার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল না, সে কারণে শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চায় বাংলা ভাষার স্থান ছিল না। বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব কতখানি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই সত্যটি অনুধাবন করার ক্ষেত্রে যাদের কৃতিত্ব সর্বাগ্রে তার মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে একটি আধুুনিক জাতিরাষ্ট্রের উপযুক্ত বিকাশের জন্য মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও শিক্ষার বাহন হিসেবে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা অবশম্ভাবী। বাংলা ভাষার বিকাশ পর্বের প্রতিবন্ধতাগুলো সমাজ-কাল-পাত্রভেদে গভীর অন্তর্দৃষ্টির সাথে পর্যবেক্ষণ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষা নানাদিক থেকে সম্পর্কযুক্ত, সেটিও তাঁর দৃষ্টিতে এড়িয়ে যায়নি।

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল বটে, তবে রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। উনিশ শতক পযর্ন্ত বাঙালি মুসলমানের একটি শিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণি ফারসির মোহে মোহগ্রস্ত ছিলেন। বাংলা ভাষাকে তাঁরা হিন্দুয়ানী ও কুফরী ভাষা মনে করতেন। সাধারণ্যে আলাপচারিতায় বাংলার ব্যবহার করলেও পারিবারিক ভাষা ছিল ফারসি- উর্দু। ধর্মশাস্ত্র বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে অনেক মুসলমান কবি সাহিত্যিককে জবাবদিহি করতে হয়েছে। গোঁড়া মোল্লা-মৌলভীদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলা প্রেমিক কবি-সাহিত্যিকগণ বাংলা চর্চা অব্যাহত রাখেন। ব্রিটিশ আমলে আবার সংস্কৃত সেবিরা বাংলাকে সংস্কৃতায়নে সরব হয়ে উঠেন। এতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় উইলিয়াম দুগের্র অনুসারীরা। বাংলা ভাষায় রচিত পুথি সাহিত্যকে বটতলার সাহিত্য বলে পায়ে ঠেলেন। অভিজাত মুসলমানদের পাশাপাশি অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজেও বাংলার চর্চাকে ঘৃণার চোখে দেখা হলো। বাংলা ভাষাকে ‘যাবনিক শব্দ ও ম্লেচ্ছস্বর’ বলে তাঁরা ঘৃণা করতেন। কৃত্তিবাস ও কাশীদাসকে ‘সর্ব্বনেশে’ অপবাদও সহ্য করত হয়েছে, কেবল বাংলা চর্চা চালু রাখার জন্য। সুতরাং মুসলমানদের আশরাফ শ্রেণি ও হিন্দুদের ব্রাহ্মণ শ্রেণি বাংলা ভাষার মুক্তি প্রয়াসকে বাধাগ্রস্ত করেছেন, ইতিহাসে এটাই নির্মম সত্য।

ইংরেজ শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রভাষা ফারসির স্থানে এলো ইংরেজি। অনেক ব্রাক্ষণ পন্ডিত ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেন। মুসলমানরা ইংরেজিকে হারাম ঘোষণা করে এ থেকে দূরে সরে থাকেন। হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায়, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা দিক থেকে মুসলমানদের পেছোনে ফেলে এগিয়ে যায়। স্বারাজ (স্বায়ত্তশাসন) প্রতিষ্ঠায় জাতীয়তাবোধও অনুভব করতে থাকেন তারা। ভারতের সাধারণ ভাষার (লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা) প্রশ্নে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দির প্রস্তাব করেন। যার হাত ধরে বাংলা বিশ্বদরবারে আসীন সেই কবি সর্বভারতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দির কথা ভাবলেন। প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবর্ষের ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরলেন। শুধু তাই নয়, বাংলাকে তিনি সমগ্র এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাষা হওয়ার দাবি উস্থাপন করলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মদ হিন্দির অনুসরণে উর্দুকে ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার স্বপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। আবার প্রতিবাদ করেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ সোচ্চার কণ্ঠে। তিনি বলেন- ‘এটি রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হবে। কেবল বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিতও বটে।’ তিনি মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে পরমশ্রদ্ধেয় ভাবতেন। তাই তাঁর পক্ষেই এমন আপোষহীন ভূমিকায় আতীর্ণ হওয়া সম্ভব হয়েছে।

মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংকটকালীন সময়ে বিশেষত পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলা উর্দুর দ্বন্দ্ব নিয়ে উত্তুঙ্গ ঝড় উঠে তখন তাঁকে জাতীয়তাবাদ বা বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বসী হতে কোনো মানসিক সংকটে ভুগতে দেখা যায়নি। পৃর্ব বাংলায় বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীর এই দ্রোহী পটভূমিকার কথা বিস্মৃত হলে চিরায়ত বাঙালির লড়াকু ইতিহাস উপলব্দি করা অসম্ভব হবে। ভাষা আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ে তিনি আনেকটা কলম সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ‘দি উইকলি’, ‘কমরেড’, ‘দৈনিক আজাদ’ প্রভৃতি পত্রিকায় লেখা লেখির মাধ্যমে যুক্তিনিষ্ঠ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রথম উচ্চারণ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। সুতরাং তিনিই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ একথা বললে অত্যুক্তি হয় না। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের পূর্বে লেখনি ও মৌখিক বিতর্ক ছাড়া বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে সাংগঠনিক কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম পরিকল্পিত ও সংগঠিত ভাবে আন্দোলন শুরু করে তমদ্দুন মজলিশ। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪টায় তৎকালীন সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান ঢাকা কলেজ) ছাত্রাবাস ‘নুপুর ভিলায়’ অনুষ্ঠিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উর্দু’ শীর্ষক ঘরোয়া সেমিনারে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সভা সমিতিতে ও মিলাদ মাহফিলে সুযোগ পেলেই বাংলা ভাষার পক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য উপস্থাপন করতে থাকেন।

বাংলা হরফকে আরবি বা উর্দুর ন্যায় রোমান হরফে লেখার ষড়যন্ত্রও সুদীর্ঘকালের। ড. শহীদুল্লাহ্ অত্যন্ত সচেতনভাবে এ উদ্যোগকে প্রতিহত করেন। এ উদ্যোগকে তিনি একটি সর্বনাশা উদ্যোগ উল্লেখ করে বলেন- ‘এতে পূর্ব পাকিস্তানের জ্ঞানের ¯্রােতরূদ্ধ করে দেবে এবং হয়ত এতে পাকিস্তানের ভিত্তিমূল ধ্বংস হয়ে পড়বে।’ গণতন্ত্রের শর্ত মোতাবেক তাঁর মতে বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবি রাখে। তাঁর কাছে ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামী বা ছুৎমার্গের কোন স্থান ছিল না। যাঁরা জবরদস্তি করে পাকিস্তানের ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চাইলেন তাঁদের তিনি পাকিস্তানের দুশমন বলেই ক্ষ্যান্ত হননি, ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলা ভাষাকে বহুগুনী ও জ্ঞানী ব্যক্তি বিভিন্ন ভাবে সেবা করেছেন। কিন্তু তাঁর মতো এই ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য মরণপণ সংগ্রামের কথা আর কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না। কোনোরূপ রাজনৈতিক অভিলাষ পোষণ না করে এবং রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হয়েও জাতির সেবায় এমন নেতৃত্বের দৃষ্টান্তেও তিনি অদ্বিতীয়। সে কারণেই হয়ত তাঁকে ভাষার জন্য মিছিলের অগ্রভাগে থেকে তরুণ নেতৃত্বের বোঝা কাঁধে নিতে কুণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি। সেদিন তিনি বগুড়ার মিছিলে অংশ নিয়ে এবং সমাবেশের সভাপতির ভাষণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পক্ষে যুক্তি ও তথ্য নির্ভর বক্তব্য দিয়ে উপস্থিত জনসমাবেশকে বিমোহিত করেছিলেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দৃঢ় প্রত্যয়ের শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। সাঁজোয়া পুলিশ কর্ডন করে দাঁড়িয়ে আছে। ড. শহীদুুল্লাহ্’র চোখে মুখে উদ্বেগের ছায়া। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপে ছত্রভঙ্গ ছাত্র-জনতা। মিছিলে অংশ নিতে আসা ছোট ছোট শিশু-কিশোররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে ড. শহীদুল্লাহ্ মেডিকেল কলেজের পার্শ্ববর্তী দেয়াল ভেঙ্গে তাদের নিরাপদে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। পুলিশ টের পাওয়ার আগেই ঘটনাটি ঘটে গেল। বেলা তিনটার দিকে মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে রাজ পথ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রফেসর আয়ারসহ হাসপাতালে হতাহতদের দেখতে আসেন। এই বর্বরোচিত নৃশংসতার প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি তাঁর কালো আচকান কেটে প্রথম কালো ব্যাজ ধারণ করলেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা জেলা শিক্ষক সম্মেলনে একুশের হত্যাযজ্ঞ ও হতাহতের প্রসঙ্গ টেনে বলেন- ‘ছাত্ররা এসব ব্যাপারে জড়িত আমরা সে সম্পর্কে নীরব থাকতে পরি না। আমরা আশা করি, একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির দ্বারা এই ঘটনা সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে বাংলা ভাষার উন্নয়নের বিষয়টি সংযুক্ত ছিল। বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রথম স্বপ্ন পুরুষ ছিলেন। তিনি সর্বজনীন শিক্ষার প্রয়োনীয়তায় মাতৃভাষাকে উপযুক্ত বাহন মনে করতেন। বিদেশি ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে তিনি সৃষ্টিছাড়া প্রথা ভাবতেন। তাই বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও ভাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র বাংলা বিভাগ তাঁরই হাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলা বানানের জটিলতা ও অনিয়ম নিরসনে তাঁর সুচিন্তিত মতামতটিও যুক্তিযুক্ত ছিল। বাংলা ভাষায় ও বর্ণমালায় এমন বহু বিষয় বর্তমান যা শুধু অবৈজ্ঞানিকই নয়- অনাবশ্যক ও দুর্বোধ্যও বটে। তিনি বাংলা সন তারিখের অস্থিরতা ও পরিবর্তনমান চরিত্রের জন্য সংশোধন ও যুগোপযোগী করার সুপরিশও করে। বাংলা ভাষার নানা দিক থেকে সেবার দৃষ্টান্ত তাঁর ক্ষেত্রে বিরল। বাংলা ভাষার জন্য তাঁর নানামুখী অবদান তাঁকে বাংলা ভাষাভাষি জনগণের কাছে এক মহৎ চরিত্র দান করেছে।

একটি আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের উপযুক্ত বিকাশের জন্যই তিনি বাংলা ভাষার এমন সেবক হিসেবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মাতৃভাষার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধকে তাঁর বিরোধীপক্ষরা হিন্দুঘেঁষা মনোভাব বলে কটূক্তি করেছেন। তাঁর সত্য কথনের সাহস ও তীক্ষ¥ অন্তর্দৃর্ষ্টি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুকে রক্ত পিপাসু করেছে। চঁহফরঃ ুড়ঁৎ ধৎব ধ ঃৎধরঃড়ৎ বলেও এই অশীতিপর বৃদ্ধ সংগ্রামীকে থামানো সম্ভব হয়নি। তিনি পাহাড়ের মতো মাথা উঁচু করে বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিদের ও সংগ্রামী ভাষাসৈনিক- যোদ্ধাদের পথিকৃৎ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের তাঁর অবদানের ঋণ অপরিশোধ্য।

তথ্যসুত্রঃ- দৈনিক ইনকিলাব - মোঃ ইসরাফিল হোসাইন - প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক (বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজ, বগুড়া)

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.