বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

শাহ-ই-বাঙ্গালা শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ
শাহ-ই-বাঙ্গালা শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) ছিলেন বাংলার একজন স্বাধীন শাসনকর্তা। তিনি ১৩৪২ সালে সোনারগাঁও বিজয়ের পর লখনৈতির সুলতান হন। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ অবিভক্ত বাংলার প্রথন মুসলিম স্বাধীন সুলতান ছিলেন এবং ইলিয়াস শাহী বংশের সূচনা করেন, যা ১৫২ বছর ক্ষমতায় ছিলো। ইলিয়াস শাহী বংশ ১৩৪২ সাল থেকে ১৪১৫ সাল পর্যন্ত একটানা ৭৩ বছর ধরে অবিভক্ত বাংলা শাসন করে এবং এরপর মাঝখানে প্রায় ২০ বছর বাদ দিয়ে আরো ৫২ বছর তাদের শাসন কায়েম থাকে। ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তার পূত্র সিকান্দার শাহ ক্ষমতায় আসেন।

তিনি পূর্ব পারস্যের সিজিস্তানের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইলিয়াস শাহ এর পিতার নাম সুলতান। প্রাথমিক জীবনে তিনি দিল্লির মালিক ফিরুজের অধীনে চাকরি করতেন। কিন্তু সেখানে কোনো এক অপরাধ করে তিনি বাংলায় পালিয়ে আসেন এবং সাতগাঁওএর তুগলক শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। নিজ যোগ্যতা বলে তিনি মালিক পদে উন্নীত হন। ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার মৃত্যুর পর তিনি ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সাতগাঁওয়ের অধীশ্বর হন। সেখানে তাঁর কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে তিনি লখনৌতির আলাউদ্দীন আলী শাহ-এর বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ উপাধি নিয়ে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন।

লখনৌতিতে তাঁর ক্ষমতা সুদৃঢ় করে ইলিয়াস শাহ রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে সহজেই ত্রিহুত দখল করেন এবং ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপালের তরাই অঞ্চলে এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। ইতঃপূর্বে কোনো মুসলিম বাহিনী এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে নি। তিনি রাজধানী কাঠমুন্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির ধ্বংস করেন এবং বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি নেপালের কোনো অংশ তাঁর রাজ্যভুক্ত করেন নি। অতঃপর ইলিয়াস শাহ পূর্ব বাংলায় অভিযান পরিচালনা করেন এবং ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহকে পরাজিত করে ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও অধিকার করেন। এরূপে তিনি সমগ্র বাংলার অধিপতি হন। শামস-ই-সিরাজ আফিফ তাঁকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’, ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ ও ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ বিশেষণে ভূষিত করেন।

ইলিয়াস শাহ তাঁর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে জাজনগর (উড়িষ্যা) আক্রমণ করেন এবং জয়পুর ও কটকের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত পৌঁছেন। তিনি উড়িষ্যার মন্দির ধ্বংস করেন এবং ৪৪টি হাতিসহ প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর ইলিয়াস শাহ ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার আক্রমণ করেন। বিহারের পরেও তিনি তাঁর কর্তৃত্ব চম্পারণ, গোরখপুর এবং বেনারস পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।

কিন্তু ইলিয়াস শাহ দিল্লির সম্রাটের বিরোধিতা দীর্ঘদিন এড়াতে পারেন নি। সুলতান ফিরুজ শাহ তুগলক ইলিয়াস শাহকে দমন করার জন্য বাংলা অভিমুখে অভিযান করেন। কিন্তু তিনি সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। ইলিয়াস শাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে ফিরুজ শাহ তুগলক দিল্লি ফিরে যান। ফলে ইলিয়াস শাহ স্বাধীন সুলতান হিসেবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। বাংলা ও দিল্লির সুলতানদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপহার ও দূত বিনিময়ের মাধ্যমে আরও দৃঢ় হয়। তাঁদের মধ্যে ১৩৫৫, ১৩৫৬, ১৩৫৭ ও ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে দূত ও উপহার বিনিময় হয়েছিল। দিল্লির সুলতানের সঙ্গে আপোষ ইলিয়াস শাহকে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর তাঁর প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দেয়।

ইলিয়াস শাহ ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে কামরূপএর বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। আক্রমণকারীদের বাধা দেওয়ার মতো অবস্থা কিংবা শক্তি কামতার শাসক ইন্দ্রনারায়ণের ছিল না। এ অনুকূল অবস্থায় ইলিয়াস শাহ কামরূপের কিছু অংশ সহজেই দখল করে নেন। সাহসী যোদ্ধা ইলিয়াস শাহ সফল সমরনায়কের সকল গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি বাংলার এবং বাংলার বাইরে তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেন।

অভিজ্ঞ কূটনীতিকের মতো ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলাকে একত্রিকরণের সময় ও সুযোগ তাঁর অনুকূলে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। তিনি সুশাসন প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং তা প্রবর্তন করে বাংলার স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার জন্য জনসমর্থন লাভে প্রয়াসী হন। স্থানীয় জনগণকে উদারভাবে সুযোগ সুবিধা দিয়ে তিনি তাঁর শাসনকে গণশাসনের রূপ দেন। তিনি বর্ণ, গোত্র ও ধর্ম নির্বিশেষে যোগ্য লোকদের চাকরিতে নিয়োগ লাভের সুযোগ দেন। সম্ভবত তিনিই সর্বপ্রথম স্থানীয় লোকদেরকে অধিক সংখ্যায় সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করেন। ইনশাহ-ই-মাহরু থেকে জানা যায় যে, খান, মালিক, উমারা, সদর, আকাবির ও মারিফগণ সামরিক ও বেসামরিক শাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এদের মধ্যে সম্ভবত খান, মালিক ও আমীরগণ ছিলেন জায়গির ভূমির অধিকারী ও রাজ্যের পদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তাদের কেউ কেউ হয়ত মন্ত্রী হিসেবে সুলতানের উপদেষ্টাও ছিলেন।

ইলিয়াস শাহ একজন নিষ্ঠাবান ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। সুফি দরবেশ ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর শাসনামলে সাদত, উলামা ও মাশায়েখদের মতো হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরাও সরকার থেকে বৃত্তি পেতেন।

জাতি গঠনকারী হিসেবে ইলিয়াস শাহই প্রথম যিনি সাতগাঁও, লখনৌতি ও সোনারগাঁও অঞ্চল একত্রিত করে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ সম্মিলিত রাজ্যের নামকরণ করেন বাঙ্গালাহ এবং এর অধিবাসীদের অভিহিত করেন বাঙালি নামে। তিনি বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করার জন্য চেষ্টা করেন। বস্ত্তত, তিনি উদার নীতি গ্রহণ করে জনগণের মধ্যে সংহতি স্থাপনের মাধ্যমে সমাজে এক নতুন জীবনধারার সূচনা করেন। ফলে বাংলার আপামর জনগণ অভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ও ভাষার অঙ্গনে সমবেত হয়। প্রকৃত জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি সকলের সাথে সমান আচরণ করতেন।

ইলিয়াস শাহ একজন নির্মাতাও ছিলেন। তিনি হাজিপুর শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া দিল্লির শামসী হাম্মামখানার অনুকরণে একটি হাম্মামখানা নির্মাণ করেন। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সালতানাতকে সুদৃঢ় করেন। এ সালতানাত প্রায় দুশ বছর টিকে ছিল। ষোল বছর গৌরবোজ্জ্বল রাজত্বের পর ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ- এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.