অনেক গবেষক এবং ভূবিজ্ঞানী মনে করেন, ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি মারাত্মক ভূমিকম্প হয়, যা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও উপকূলীয় অঞ্চলে বিরাট ভূমি পরিবর্তনের কারণ হয়েছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প ছিল ১৭৬২ সালে ৮.৫-৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল, যার ফলে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ বদলে যমুনা নদীর জন্ম হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল ৭.৬। বর্তমানে, বাংলাদেশ ও এর আশেপাশের অঞ্চলে ভূমিকম্পের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূকম্পনের আশঙ্কা করছেন।
১৭৬২ সালের ২ এপ্রিলের ভূমিকম্পটি উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূকম্পন ছিল। এটির উৎপত্তিস্থল ছিল বঙ্গোপসাগরের তলদেশে, মূলত আরাকান উপকূল ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী এলাকায়, এবং এটি বিশাল ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণ হয়। নিচে এই ভূমিকম্পের ফলে নদী, ভূমি এবং রাস্তার যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো ঘটেছিল তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
১৭৬২ সালের ভূমিকম্প: চট্টগ্রামের নদী, ভূমি ও ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল:
- আন্দামান সাগরের উত্তরে আরাকান সাবডাকশন জোনে।
- চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল এবং তৎকালীন আরাকান রাজ্যের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের একট অংশ ছিল এটির মূল উৎপত্তিস্থল।
১. সুনামি ও জলোচ্ছ্বাস:
ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে বিশাল সুনামি সৃষ্টি হয় যা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সন্দ্বীপ এবং অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে।
একাধিক ঐতিহাসিক বিবরণে উল্লেখ আছে যে, সমুদ্রের পানি হঠাৎ কয়েক ঘণ্টার জন্য সরে গিয়ে পরে ভয়াবহ ঢেউয়ে উপকূল প্লাবিত হয়।
২. ভূমি উত্তোলন ও ধস:
চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমি ১.৫ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে যায়। এর ফলে:
- কিছু নদী ও খাল শুকিয়ে যায় বা গতিপথ পাল্টায়।
- বহু নতুন ভূমি সমুদ্র থেকে উঠে আসে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গঠনের পেছনে এই ভূমিকম্পের ভূমিকা থাকতে পারে।
আবার কিছু জায়গায় ভূমি ধসে নিচে নেমে যায়, যেমন টেকনাফ বা নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চলের পাহাড়ি অংশে ধসের খবর পাওয়া যায়।
৩. রাস্তা ও স্থলপথের ক্ষতি:
ঐ সময় মূলত মাটির বা ইটের তৈরি রাস্তা ছিল। অনেক রাস্তা ফাটল ধরায় বা সম্পূর্ণ বসে যাওয়ায় চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম থেকে আরাকান ও ভেতরের মুঘল সড়ক ব্যবস্থায় বিভিন্ন অংশে ধস ও ফাটলের কারণে দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ বন্ধ ছিল।
৪. নদীর গতিপথ পরিবর্তন:
ভূমিকম্প এবং সুনামির ফলে নদীগুলো নতুন প্রবাহ তৈরি করে। বিশেষ করে:
- কর্ণফুলী নদী কিছু অংশে গতি পরিবর্তন করে।
- উপকূলীয় খাল ও শাখা নদীগুলোর বহু জায়গায় পলি জমে প্রবাহ থেমে যায়, আবার কোথাও পানি বেড়ে নতুন নদী বা জলাভূমি তৈরি হয়।
- সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী অঞ্চলেও প্রবাহপথ পরিবর্তনের আলামত ইতিহাসে পাওয়া গেছে।
৫. বন্দর ও নৌপথ:
- চট্টগ্রাম বন্দর তৎকালীন সময় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- জাহাজ চলাচলের রুট পরিবর্তন করতে হয় কারণ উপকূলের পানিপথ বদলে যায় এবং অনেক নতুন চরের সৃষ্টি হয়।
৬. শহর ও জনপদের অবস্থা:
- চট্টগ্রাম শহরের পুরনো অংশ (যেমন বদর মোকাম, আন্দরকিল্লা) এবং মুঘল স্থাপনাগুলোর অনেক অংশ ধসে পড়ে।
- অনেক মসজিদ, দুর্গ ও কেল্লা ধ্বংস হয় বা আংশিক বসে যায়।
- হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে অভিবাসনের ঢল নামে।
ঐতিহাসিক রেফারেন্স:
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছু প্রথমদিককার রিপোর্টে এই ভূমিকম্পের উল্লেখ আছে, যদিও তখন তারা পুরো নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
পরে বাংলা, ইংরেজি ও বার্মিজ নথিপত্রে এই ভূমিকম্পের দীর্ঘমেয়াদি ভূ-প্রভাব সংরক্ষিত থাকে।
আধুনিক গবেষণায়:
বাংলাদেশের জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়:
- ভূমিকম্পটি ছিল সাবডাকশন জোনে হওয়া “থ্রাস্ট ফল্টিং” ধরণের, যার ফলে ভূপৃষ্ঠে বড় ধরনের উল্লম্ব পরিবর্তন ঘটে।
- কিছু উপকূলীয় এলাকার বর্তমান উচ্চতা এই ভূমিকম্পের পর স্থায়ীভাবে বদলে গেছে।
১৭৬২ সালের ভূমিকম্পটি শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগই নয়, বরং এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, নদী ব্যবস্থা ও বসতির গঠন বদলে দিয়েছিল। এই পরিবর্তনের ছাপ আজও চট্টগ্রামের ভৌগোলিক গঠনে বিদ্যমান।
