অনেকটাই নিভৃতচারী ফকির আব্দুল করিম শাহের বয়স সাতাশি বছর, কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার অঞ্জনগাছী গ্রামে জন্ম নেয়া এই সাধক এক হাতে একতারা এবং কোমরে ডুগি বাজিয়ে হেঁটে হেঁটে গান করতেন। ছেলেবেলায় বাবা ঝুমুর আলী জোয়াদ্দারের সাথে পালাগান করতেন।
শুরুতে পালাগান হলেও সেই বালক বয়সেই বাউল গানে ঝুঁকে পড়েন। চৌদ্দ বছর বয়সে বাবা মারা যাবার পর নিজেই বাউল গান শুরু করেন। গান বাজনার বিষয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই, গুরুই তাঁর প্রতিষ্ঠান। প্রথম শিক্ষাগুরু বাবা গত হবার পর পর্যায়ক্রমে অঞ্জনগাছীর আব্দুল মকসেদ দৌলতপুরের তছের ফকির এবং আলমডাঙ্গার বিহাল শাহের নিকট রপ্ত করেন বাউল গানের তত্ত্বকথা।
লালনের প্রতি নিষ্ঠাবান এই সাধক সাধনার এক পর্যায়ে এসে খেলাফত অর্জন করেন। তাঁর মতে লালনের গান হলো আত্মার গান যেখানে তাঁর মুর্শিদ বাস করে। দেশ বিদেশের নানা জায়গায় গান করে বেড়িয়েছেন, পশ্চিম বাংলার বীরভূমসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গান করতে গেছেন বহুবার। লম্বা গড়নের এই সাধক নেচে নেচে গান করতেন। প্রায় দুই হাজার বাউল গান তাঁর মুখস্থ ছিল।
বর্তমানে তিনিই একমাত্র গুরু যিনি আদি সুরে সর্বাধিক সংখ্যক লালনের গান গাইতেন। এক সময় যশোরে বাস করতেন, পরে কুষ্টিয়ার পোড়াদহে এসে বসবাস শুরু করেন। সেই থেকে সেখানেই, স্ত্রী রিজিয়া বেগম নিজে গান করেন না। বয়স বেড়ে যাওয়ায় আব্দুল করিম একা একা খুব বেশী দূর হেঁটে যেতে পারেন না; হাফ ধরে যায়, সহধর্মিণী রিজিয়া বেগমকে সাথে করে মাঝে মাঝে আঁখরাবাড়িতে আসতেন, গান করে ফিরে যেতেন। আয় রোজগার করতে পারতেন না, এক সময় বছরে ছয় হাজার টাকা ভাতা পেতেন সেটাও দীর্ঘদিন কি কারনে বন্ধ ছিলো।
বহু কষ্টেই বেঁচে ছিলেন জীবনের সন্ধিক্ষণে ফকির আব্দুল করিম শাহ্। ২০০৭ সালে লালন একাডেমী থেকে পেয়েছেন লালন সম্মননা পদক। তাঁর আগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে পেয়েছিলেন লালন মেন্টর ফেলোশিপ। প্রকৃত সুরকে অবহেলা করে লালনের গানকে যখন নানানভাবে গাইবার চেষ্টা চলছে, তখনো সাতাশি বছরের এক দরিদ্র যুবক ফকির আব্দুল করিম শাহ্ খাঁটি সুরে গেয়ে চলেছিলেন লালনের গান...
পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে।
ক্ষম হে অপরাধ আমার
এই ভবকারাগারে।।
ফকির আব্দুল করিম শাহ্ জীবনভর লালনের গান গেয়েছেন। লালনের ভাব-দর্শন ছিল তাঁর একমাত্র আরাধ্য। তিনি শিক্ষার্থীদের গান শেখাতেন। লালন একাডেমির উন্নয়নে নিরলস কাজ করতেন। দেশের বৃত্ত পেরিয়ে আমেরিকা, ফ্রান্স, লন্ডন, ভারতসহ দেশে দেশে গান গেয়েছেন তিনি। বাউল আব্দুল করিম শাহ্ তাঁর জীবন কর্ম ও সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।
বাউল আব্দুল করিম শাহ্র স্ত্রী রিজিয়া খাতুন বলেন,
‘জীবনের শেষ সময়ে অর্থকষ্টে জর্জরিত ছিলেন তিনি। স্বামীর ওষুধের খরচের জন্য ভিক্ষাও করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচাতে পারলাম না।’ লালন মাজারের খাদেম মোহাম্মদ আলী শাহ্ জানান,
বাউল আব্দুল করিম শাহ্ জীবনের সবটুকু ব্যয় করেছেন লালন ও তাঁর গানকে নিয়ে। বিনিময়ে তিনি কিছুই পাননি। একুশে পদকপ্রাপ্ত একজন বাউল চিকিৎসা না পেয়ে চলে যাবেন তা মানতে পারছি না।’
কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম জানান,
প্রবীণ বাউল শিল্পী করিম শাহ্ শুদ্ধভাবে লালনের গান গাইতেন। তিনি শিল্পকলার ছাত্রদের লালনের গান শিখিয়েছেন। টাকার অভাবে তিনি এভাবে মারা যাবেন এটা কষ্টের।
বিশিষ্ট লালন গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী বলেন,
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন ফকির আব্দুল করিম শাহ্। তিনি লালন একাডেমির উন্নয়নে সারা জীবন কাজ করেছেন। অথচ জীবন সায়াহ্নে সেই শিল্পীর পাশে আমরা থাকতে পারলাম না।’
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সালেক মাসুদ জানান,
করিম শাহ্রে ফুসফুসে সমস্যা ছিল। কয়েকটি পরীক্ষাও করা হয়েছিল। তবে ঢাকা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করে তাঁকে উন্নত সেবা দেওয়া হলে ভালো হতো।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাউল আব্দুল করিম শাহ্ হাসপাতালে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন,
‘কোনো পদক চাই না, দুই বেলা খেয়ে সঠিক চিকিৎসা পেয়ে বেঁচে থাকতে চাই। একুশে পদক পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন আমাকে। সেই টাকা দিয়ে একটি টিনের ঘর তুলেছি। আমার দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমার মতো কষ্ট যেন আর কোনো বাউলকে করতে না হয়।’
একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল আব্দুল করিম শাহ্ আর নেই। ১০ জুন ২০১৪ মঙ্গলবার সকালে কুষ্টিয়া শহরতলির চৌড়হাস এলাকায় নিজ বাড়িতে মারা যান তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তিনি দীর্ঘদিন নানা রোগে ভুগছিলেন। সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল ফুসফুসে সমস্যা হওয়ায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু অর্থের অভাবে তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে অনেকটা বিনা চিকিৎসায়, অভাব আর অবহেলায় প্রাণের একতারা ছিঁড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
ফকির আব্দুল করিম শাহ্ | Fokir Abdul Korim Shah