শিষ্যদের বললেন, আমি চললাম। লালন চাঁদর মুড়ি দিয়ে বিশ্রাম নিলেন, শিষ্যরা মেঝেতে বসে থাকলেন। এক সময় লালন কপালের চাঁদর সরিয়ে বললেন, তোমাদের আমি শেষ গান শোনাব।
লালন গান ধরলেন, গভীর অপরূপ সুন্দর গান-
পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে।
ক্ষম হে অপরাধ আমার
এই ভবকারাগারে।।
গান শেষ হলো, চাঁদর মুড়ি দিয়ে চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন ফকির লালন। ফকির লালনের জন্ম সাল জানা যায়নি, তিনি ১লা কার্ত্তিক ১২৯৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান এবং তিনি বেঁচে ছিলেন ১১৬ বছর।
সেই হিসেবে তিনি জন্মেছিলেন ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে। ছেউড়িয়াতে ফকির লালনের সাথে তাঁর পালিত মা মতিজান ফকিরানি, পালিত বাবা ফকির মলম শাহ্, ফকির পণ্ডিত মানিক শাহ্, শীতল শাহ্, ভোলাই শাহ্, বিশখা ফকিরানি এবং ফকির মনিরুদ্দিন শাহ্সহ অন্যান্য আরো অনেক ভাবশিষ্যর সমাধি আছে।
প্রতি বছর ১লা কার্ত্তিক এখানে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার বাউল সমবেত হয়ে উদযাপন করে তাঁর মৃত বার্ষিকী।
লালনের মৃতর অব্যবহিত পরে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে ৩১ অক্টোবর কুষ্টিয়ার রাহিনীপাড়া থেকে প্রকাশিত কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদনায় পাক্ষিক হিতকারী পত্রিকায় “মহাত্না লালন ফকির” শিরোনামে একটি বস্তুনিষ্ঠ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি পাঠ করিলে লালন ও তাঁর শিষ্যদের জীবনধারার একটি পরিষ্কার বর্ণনা পাওয়া যায়।
নিবন্ধকার লিখেছেন,
“ফকির লালনের নাম এ অঞ্চলের কাহারো শুনিতে বাকি নাই। ইহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছে, আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি। শুনতে পায় বঙ্গদেশ জুড়ে ইহার শিষ্য দশ হাজারের উপর। কুষ্টিয়ার অনতিদূরে কালীগঙ্গার ধারে ছেউড়িয়া গ্রামে ইহার একটি সুন্দর আঁখরা আছে।
আখড়ায় ১৫/১৬ জনের অধিক শিষ্য নায়। শিষ্যদের মধ্য শীতল ও ভোলাই নামক দুইজনকে ইনি ওরসজাত পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেন, অন্যান্য শিষ্যগণকে তিনি কম ভালোবাসিতেন না। আখড়ায় ইনি সস্ত্রীক বাস করিতেন। সম্প্রদায়ের ধর্ম মতানুসারে ইহার কোন সন্তানসন্ততি হয় নায়। শিষ্যগনের মধ্যও অনেকের স্ত্রী আছে, কিন্তু সন্তান হয় নায়। সম্প্রতি সাধুসেবা বলিয়া এই মতের এক নতুন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইয়াছে। সাধু সেবা ও বাউলদের দলে যে কলঙ্ক দেখিতে পাই, লালনের সে প্রকার কিছু নায়।
লালন সকল নীচ কাজ হইতে দূরে ছিলেন ও ধর্ম জীবনে বিলক্ষণ উচ্চ ছিলেন বলিয়া বোধ হয়। মিথ্যা জুয়াচুরিকে লালন ফকির বড়ই ঘৃণা করিতেন। নিজে লেখাপড়া জানিতেন না, কিন্তু তাহার রচিত অসংখ্য গান শুনলে তাহাকে পরম পণ্ডিত বলিয়া বোধ হয়।
ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। শিষ্যরা হয়ত তাহাঁর নিষেধক্রমে না হয় অজ্ঞাত বসতঃ কিছুই বলিতে পারেনা। ইহার মুখে বসন্ত রোগের দাগ বিদ্যমান ছিলো।”