বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

কাঙ্গাল হরিনাথ ও কালান্তরের ইতিহ ভাবনা
কাঙ্গাল হরিনাথ ও কালান্তরের ইতিহ ভাবনা

বাঙলা এবং বাঙালির অস্তিত্ব সৃষ্টির পর হতে নানা কারনে বাঙালির জীবন কখনও গৌরবের আবার কখনও বিষাদের। মহাকালের পরিক্রমায় কিছু কিছু সময় ও সূচীর ঘটনা সমূহ আমাদের জীবনকে বিশেষভাবে সীলমোহর দিয়ে আবদ্ধ করে রেখেছে। যে কারনে আমরা কখনও কাঁন্না করি, আবার কখনও হাসি। কখনও উদ্ভাস বা উদ্বেলিত হয়, আবার কখনও নিস্তব্ধ হয়।

একথা নিসন্দেহে বলা যায় আমাদের জীবন ও তার পরিচালন চক্রে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন সময়ে প্রকৃতির উপাদানের উপকরণ ও তার উপাচার। তার প্রথমটা হলো বছর ঘুরে আসা গঙ্গা অববাহিকার ঘোলা অথচ মিষ্টি জলে ভেসে আসা পলি ও পাথর। যা আমাদের কৃষি,অর্থনীতি, সমাজ এমনকি মানষিক পরিমন্ডলকে ঔজ্বল্য ও সমৃদ্ধ করে।

দ্বিতীয়টা হলো ঘাত প্রতিঘাতের দোলাচালে এ দেশে মোঘল শাসনের পরে ১৭৪০ সালে বাংলার সুবেদার সরফরাজ খানের ব্যর্থতার মধ্যদিয়ে মসনদ দখল করেন বিহারের শাসক আলিবর্দী খান। এই শাসকের মৃত্যুর পর অনেকটা প্রথাগতভাবে বাংলা ও বিহারের শাসন নেন প্রয়াতের দৌহিত্র কিশোর নবাব, সিরাজউদৌল্লা। কিন্তু সিরাজ কার্যত: নবাব হয়েছিলেন ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল। তবে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবীন এই নবাবের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে স্তমিত হয় ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশী প্রান্তের স্বাধীন এক সূর্যের। তারপর ভারত উপমহাদেশে জেঁকে বসে ইংরেজদের শাসন-নামা। ভারত বর্ষের এক বৈচিত্র্যময় দেশ বাংলার প্রাপ্তি ও অর্জনের ২০০ শত বছরের দীর্ঘ সময়ে শেকড় ছড়িয়েছে হিন্দু- মুসলমান দ্বিজাতী-তত্বের বিষ ফোঁড়া। সময়ের চাকা আর গঙ্গার জল গড়িয়ে অবশেষে আসে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। দ্বিজাতী-তত্বের বিষ্টায় জন্ম নেয় পাকিস্থান রাষ্ট্র নামের কলঙ্কিত ও ক্ষত চিহ্নের এক উপাক্ষ্যান। “হাঁসকে লিয়া পাকিস্থান, লড়কে লেঙ্গে হিন্দুস্থান” শ্লোগানের অবস্বাদ অধ্যায়ের।

১৯৭১ সাল। সময়ের মহেন্দ্র ক্ষণে আসে আমাদের পরম প্রাপ্তির যুগ সন্ধি সাধনের আমোঘ স্পর্শ স্বাধীনতা। নয় মাসের শক্তি, ধৈর্য, সাহস, ত্যাগ এবং প্রাপ্তির সাবলিক সমাধান আমাদের স্বাধীনতা। যুগের মহা-কৈলিক ধারায় সাধন ও সিদ্ধির জন্য জন্ম নিয়েছে এক এক জন মহান পুরুষ। আবার সাধন ভঙ্গ বিহনে তারা চলেও গেছেন বিনাশ বিলোতায়। আসা আর যাওয়ার পথে কেউ হারিয়ে যায় সূর্যাস্তের সাথে সাথে আবার কেউ কেউ স্মরণে থাকেন যুগ যুগ সময় নিয়ে। এই কাল প্রবাহের এক নিরন্তর শ্রীময়ি ব্যক্তিত্ব কুষ্টিয়ার কুমারখালির কালজয়ি ও নৈসর্গিক বরপুত্র কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। জন্ম ২০ জুলাই ১৮৩৩ সাল এবং তার দিব্যধামে গমন ১৬ এপ্রিল ১৮৮৬ সাল। মাঝখানে ৬৩ বছর সময় তিনি ছিলেন নানা চিন্তা ও কর্মে ভবের এই নাট্যশালায়।

মোঘল আমল, সুলতানী আমল, কোম্পানী ও বৃটিশ আ্মল, পাকিস্থানী আমল সব সময়ই বাঙলার মানুষেরা ছিলেন পরাধীন। এই আবদ্ধ জীবনের জ্বালা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের উৎগ্রীব আগ্রহ কিংবা আকাঙ্খা সেই সেকাল থেকেই। সময়ের বাতাবরণে অনেকের আত্মোৎস্বর্গের পরে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। মাস্টার দা সূর্য সেন. প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদি রাম বসু, বাঘা যতিনসহ মুক্তি পাগল মানুষ যুগে যুগে আত্মাহুতি দিয়ে আমাদের স্বাধীকার কে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছেন। এই সারল্য ধারার আরেক মহাবীর আমাদের কঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। যিনি ১৮৮০সালের মে সংখ্যায় তার গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় লেখনির মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজকে অঙ্কুরোদগম করেছিলেন এই বলে যে,

‘‘স্বাধীনতা –হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়,
দাসত্ব শৃংঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।’’

সমকালিন শাসন, শোষণ এবং সমাজ বদলের উত্তরণ পেতে কাঙ্গাল হরিনাথ যে স্বপ্ন দেখে ছিলেন তার সরূপ উদ্ভাসিত হয় ৭১ সালে। কাঙ্গালের সে ইচ্ছের স্বপ্ন দর্শন হলো তারসৃষ্টিতঃ ‘‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’’ পত্রিকা।

১২৭০ বঙ্গাব্দের প্রথমেই ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশিত হতে লাগলো। লেখনির ক্ষুরধারে অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে, অত্যাচার-নিপিড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলতে লাগলো। এলাকার অত্যাচরিত জমিদারেরা তাদের সরূপ উন্মোচনের কারনে কাঙ্গাল নানাবিধ নিপিড়নের মুখোমুখি হতে লাগলেন। নিরূপায় তার অসহায়ত্বের কথা লিখে প্রেরণ করলেন তার প্রিয় এক স্নেহভাজন শিষ্যকে। তিনি লিখলেন-

‘‘ জমিদারেরা প্রজা পরিত্যাগ করিয়া আমার প্রতি যতদূর সাধ্য অত্যাচার করেন। কিন্তু তাহাতেও কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া পরিশেষে অত্যাচারের হাত খর্ব্ব করিয়া আনিয়াছেন। এখন আর তাহাদিগের অত্যাচারের কথা শুনিতে পাওয়া যায় না। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা যথাসাধ্য প্রজার উপকার করিয়াছে। পরে কি ঘটে তা বলিতে পারি না। জমিদারেরা যখন আমার প্রতি অত্যাচার করে, এবং আমার নামে মিথ্যা মোকদ্দমা উপস্থিত করিতে যতœ করে, আমি তখন গ্রামবাসী সকলকেই ডাকিয়া আনি এবং আত্মাবস্থা জানাই। গ্রামের একটি কুকুর কোন প্রকারে অত্যাচারিত হইলেও গ্রামের লোকে তাহার জন্য কিছু করে, কিন্তু দু:খের বিষয় এই যে, ও আমার এতদূরই দূর্ভাগ্য যে, আমার জন্য কেহ কিছু করিবেন, এরূপ একটি কথাও বলিলেন না। যাঁহাদের নিমিত্তে কাঁদিলাম, বিবাদ মাথায় করিয়া বহন করিলাম, তাহাদিগের এই ব্যবহার।’’

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস পথের পাঁচালি। যার উপজিব্য বিষয় হলো শাশ্বত গ্রাম, তার মানুষ এবং প্রকৃতির আাঁচরকে নিয়ে। গ্রামের মানুষগুলোর পারিবারীক জীবনের অভাব আর দারিদ্রতার মধ্যেও ছিল অনাবিল এক আনন্দ। সত্যজিৎ রায় এই কাহিনী অবলম্বণ করে সৃষ্টি করেন পৃথিবী খ্যাত চলচিত্র ‘‘পথের পাঁচালী’’। ঐ চলচিত্রে তিনি শিল্পি চুণিবালার কন্ঠে যে গাণটি সুরালোলিত করেছিলেন তা ছিলঃ-

‘‘ হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে।
তুমি পারের কর্ত্তা, শুনে বার্ত্তা, ডাকছি হে তোমারে।’’

তবে এই গানে গীতিকার হিসেবে কারো নাম ছিল না। বিষয়টি নজরে আসে কুষ্টিয়ার সদ্য প্রয়াত ঋত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব ও কাঙাল গবেষক ম, মনিরুজ্জামানের চোখে। তিনি বিষয়ীট তাৎক্ষণিক চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায়কে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন। সত্যজিৎ রায় ০৮-১১-১৯৮০ তারিখে ফিরতি পত্রে ম, মনিরুজ্জামানকে জানালেন যখন চলচিত্রে এই গানটি কম্পোজ করা হয়েছিল, তখন তিনি জানতেন না এই বিখ্যাত গানটির গীতিকার কে। অথচ এই গানটি বাঙালির মুখে মুখে প্রচারিত একটা গান। তবে পরে আমি (সত্যজিৎ রায়) জানতে পারি এই গানটির গীতিকার বিখ্যাত কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার।

১৮৮০সালের মে সংখ্যায় গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকার মাধ্যমে কাঙ্গাল জীবন হতে শৃঙ্খল মুক্তির কথা বললেন। স্বাধীনতা আর পরাধীনতার স্বাদ-বিস্বাদটা শুধু মানুষ উপলদ্ধি করতে পারে। যে জন্য মানুষ অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়। কিন্তু এই নিষ্ঠাবান, উপলদ্ধিসম্পন্ন মানুষই কখনও পশু-প্রাণি, বৃক্ষ-তরুলতা, পাহাড়-নদীল প্রতি কত নির্দয়্ তাদের স্বাধীনতাকে এরা গলাটিপে হত্যা করছে। আবার কাঙ্গাল ‘‘ হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হলো’’....... গানের মাধ্যমে মুক্তির স্বাদ অন্মেষণ করেছিলেন। এখানে তিনি মহামুক্তির কথা প্রকাশ করে গেছেন। কাঙ্গালের হৃদয় ব্যাকুলতার আরো অনেক প্রমাণ আমরা পায়। তিনি বাঙালি জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে বিশেষ করে অনগ্রসর হিসেবে নারীদের শিক্ষার প্রতি সাগ্রাহক ভাব প্রকাশই করেন নি, তিনি এজন্য নিজ বাড়ীতে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থাও করেছিলেন। আমরা ১১৮ বছর পরে কাঙ্গালের দিব্যধাম প্রস্থান দিবসে এসে ভাবছি, কাঙ্গাল যুগের সন্ধিক্ষণে এসে ভেবেছিলেন যে সামাজিক আবদ্ধতা এবং মানস মুক্তির ভাবনাকে জোছ্নায় ছড়িয়ে দিতে। আর এ ভাবনাকে তিনি আন্দোলিত করেছিলেন কবিতা এবং গানে গানে। আমরা আমাদের যুগের ধারায় আগত মঙ্গোলিক স্বাধীনতার সতীর্থদের সাথে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারকে এ কাফেলার এক উত্তম পুরুষ হিসেবে বলতে পারি।

লেখক: গৌতম কুমার রায় - গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.