বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

বাউল গানে বাউলের সংজ্ঞা
বাউল গানে বাউলের সংজ্ঞা

বাউলের প্রকৃতি সম্পর্কে বাউল গানে নানা ধরনের তথ্য বিবৃত হয়েছে। এ পর্যায়ে বাউল-সাধকের রচিত সংগীতের বাণীকে আশ্রয় করেই বাউল মতের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে। যেমন, একটি বাউল সংগীতের বাণীতে পাওয়া যাচ্ছে-

যে খুঁজে মানুষে খুদা সেই তো বাউল বস্তুতে ঈশ্বর খুঁজে পাই তার উল॥

পূর্ব জন্ম না মানে ধরা দেয় না অনুমানে মানুষ ভজে বর্তমানে হয় রে কবুল॥

বেদ তুলসী মালা টেপা এসব তারা বলে ধুকা শয়তানে দিয়ে ধাপ্পা করে ভুল॥

মানুষে সকল মেলে দেখে শুনে বাউল বলে দীন দুদ্দু কি বলে লালন সাঁইজির কুল॥

বাংলাদেশের ঝিনাইদহ অঞ্চলের বাউল-সাধক দুদ্দু শাহ কর্তৃক উপর্যুক্ত সংগীতের বাণীতে “বাউল মত” তথা বাউলতত্ত্বের মূল-কথাটা অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কেননা, বাংলার বাউলদের মূল পরিচয়ের প্রধানতম একটি দিক হলো- তাঁরা মানুষেই শ্রষ্টার সন্ধান করেন। দ্বিতীয়ত দিক হলো- তাঁরা প্রচলিত ধর্মগোষ্ঠীর লোকদের মতো অনুমানে বিশ্বাস করেন না, এমনকি পূর্বজন্ম বা জন্মান্তরবাদকে মানতে নারাজ; তৃতীয়ত- বেদ তুলসী মালা টেপাকে তাঁরা ধোক্কার কাজ বলে গণ্য করেন। আসলে, প্রচলিত ধর্মীয় চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলার বাউল মত মূলত ‘মানুষে সকল মেলে’ এই তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে।

বাউল-গবেষক শক্তিনাথ ঝা তাঁর ব্যাখ্যায় বলেছেন- ‘বাউল মতবাদ কোন ধর্ম নয়। সম্প্রদায় কথাটি শিথিলভাবে এখানে ব্যবহৃত হতে পারে। বিভিন্ন ধর্ম গোষ্ঠী ও সামাজিক স্তরের ব্যক্তি বিশেষ গুরুর কাছ থেকে এ মতবাদ, গান ও সাধনা গ্রহণ করে নিজ নিজ সামর্থ্য ও সংস্কারানুযায়ী তা পালন করতে চেষ্টা করে এবং এক শিথিল স্বেচ্ছামূলক ম-লী গঠন করে। সাধক আবার গুরু হিসাবে বিশ্লিষ্ট হয়ে পৃথক এক বৃত্ত নির্মাণ করে। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য ও বৈচিত্র্য দুই-ই আছে। বাউল তত্ত্বে এবং সাধনায় প্রচলিত মূল্যবোধ ও আচারকে বিপরীত রূপে আদর্শায়িত করা হয়, প্রচলিত শাস্ত্রবিরোধী সাধনা নানা বৈচিত্র্য-মত রূপে বাউল জীবনচর্যা রচনা করেছে। অলৌকিক ঈশ্বর, দেহব্যতিরিক্ত আত্মা, স্বর্গাদি পরলোকে অবিশ্বাসী বাউল ইহবাদী, দেহবাদী। আর্থ- সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিধিবিধানের প্রতিবাদী মানুষেরা বাউল মতবাদ গ্রহণ করে।’

বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বাউল মতের প্রভাব রয়েছে। তবে, এক এক অঞ্চলের বাউল মত এক এক রকমভাবে বিকাশ লাভ করেছে। যেমন- কুষ্টিয়া অঞ্চলের লালনপন্থী বাউল-সাধকদের সাধনা-পদ্ধতি, জীবনাচার-বেশ-বাস, সাধুসঙ্গ, এমনকি গায়কী ও গানের সুর-বাণী ইত্যাদির সাথে বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ইত্যাদি অঞ্চলের বাউলদের তেমন কোনো সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু ভাবের দিক দিয়ে ও সাধনার ঘর হিসেবে দেহকে আশ্রয় করার বিষয়ে কিছুটা মিল রয়েছে। আসলে, সব অঞ্চলের বাউলেরাই সাধনার আশ্রয় হিসেবে দেহকে অবলম্বন করে থাকেন এবং দেহ-ঘরের মধ্যে তাঁরা সৃষ্টি-শ্রষ্টার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেন, আর গুরু-শিষ্য পরম্পরায় প্রায় সব অঞ্চলের বাউলেরা সাধনার ধারা অব্যাহত রাখেন। এক্ষেত্রে গুরুকে তাঁরা শ্রষ্টার সমতুল্য বিবেচনা করেন। তাঁরা মনে করেন গুরু বা মুর্শিদকে ভজনা করার ভেতর দিয়ে শ্রষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করা যায়। গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরাভেদকে লালন সাঁইজি প্রকাশ করেছেন এভাবে-

যেহি মুর্শিদ সেই তো রাছুল ইহাতে নেই কোন ভুল খোদাও সে হয়; লালন কয় না এমন কথা কোরানে কয়॥

বাংলাদেশের বাউলেরা এভাবেই অকাট্য যুক্তির আলোকে শরিয়তি গ্রন্থকে সামনে রেখেই গুরুবাদী ধারার সাধনচর্চাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তাই নয়, মানুষ-গুরু ভজনা এবং মানুষকে সেজদার যোগ্য বিবেচনা করে, তার ভেতর দিয়েই যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ট ইবাদত সম্ভব বাংলার বাউল-সাধকেরা সেকথা ব্যক্ত করতেও দ্বিধা করেন নি। এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলার বাউল মত কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির সৃষ্টি নয়। তাই বাউলেরা বৈষ্ণব, চিশতিয়া প্রভৃতি সাধক-শ্রেণীর মতো কোনো বিশিষ্ট সম্প্রদায় নয়। বৈষ্ণব ও বিভিন্ন শ্রেণীর সুফি মতের অনুসারীরা যেমন তাঁদের প্রতিষ্ঠাতার নাম বলতে পারেন, বাউলেরা তা পারেন না। অতএব, আদি বাউল কে- তা নিয়ে বির্তকের কোনো শেষ নেই।

বাউল-গবেষক শক্তিনাথ ঝা অবশ্য বিভিন্ন গবেষকের সূত্র মিলিয়ে বাংলার বাউল মতের প্রাচীনতম দৃষ্টান্ত দিয়েছেন চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি সাহিত্য নিদর্শনের উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যা সহকারে।১০ তাঁর মতে, বাউলদের আদিগুরুর নাম সঠিকভাবে নির্ধারণ করা না গেলেও এ কথা অন্তত বলা যায়- বাংলার ‘বাউল পন্থা কোন অর্বাচীন মতবাদ নয়।’

বাউলদের স্বরূপ ও পরিচয় দিতে গিয়ে মুহম্মদ এনামুল হক বলেন “বাউল”-দিগকে “বাতুল” অর্থাৎ পাগল বলা হয়। বাউলেরা যাঁহার সন্ধানে পাগল, তাঁহার কোন নাম নাই,- তিনি “অনামক”। তবে তাঁহারা তাঁহাকে যখন যাহা খুশী সেই নামে অভিহিত করে। তাই দেখিতে পাই, তাহারা তাঁহাকে “মন-মনুরা”, “আলেক্”, “আলেখ্ সাঁই”, “অচিন পাখী”, “মনের মানুষ”, “দরদী সাঁই” ও “সাঁই” প্রভৃতি কত নামেই না পরিচিত করিতে চেষ্টা করিয়াছে। এইরূপ যে নামেই তাহারা তাঁহাকে পরিচয় দিক না কেন, তিনি তাহাদের নিকট চিরদিনই “অনামক”। হিন্দুর “ব্রহ্ম”, বৈষ্ণবের “কৃষ্ণ”, বা মুসলমানের “আল্লাহ”-এর ন্যায় কোন একটি বিশিষ্ট নাম আরোপ করা তাহাদের স্বভাব নয়।”১২ একই সঙ্গে সেই পরমসত্তাকে বাংলার বাউলেরা সাধারণ ধর্মাচারী মানুষের মতো তারা ভীতিকর এবং দেহ ও নিজের আত্মগত সত্তার বাইরের বস্তু বলেও মনে করে না। বরং দেহকেন্দ্রিক ষট্চক্র যোগে সাধনায় আত্ম তথা স্রষ্টা দর্শনের অপূর্ব প্রশান্তি খুঁজে ফেরেন।

তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ- নাট্যকার ও গবেষক সাইমন জাকারিয়া

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.