বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালনের গান তত্ত্ব
লালনের গান তত্ত্ব

লালনের গান সঙ্গীত জগতে এক অভিনব সৃষ্টি। তাঁর গানের সুরের মধ্যে একটা বৈচিত্র রয়েছে। তাঁর গান ভাব প্রধান হলেও সুর ও তালের মিলনে এই গান সত্যিই অপূর্ব। তার গানে রয়েছে ভক্তি রসের আবেশ। রয়েছে বিহ্বলতা। এই বিহ্বলতা শুধু গায়ক নয়, শ্রোতার মনেও শিহরণ তোলে। গায়ক যখন তন্ময় হয়ে গান গায়, শ্রোতা তখন বিহ্বল হয়ে শোনে। তাঁর গানে বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ রয়েছে। মানুষের মনের সুর ব্যাক্ত হয়েছে। তার গান তাই মানুষকে অভিভূত করে, মানুষের হৃদয়কে বিগলিত করে।

লালন আর বাউল গান গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বাউল গানের ভাবসম্পদ দেহের ভেতর পরম আরাধ্যের অনুসন্ধান। লালন শাহর গানে দেহের ভেতরই যে পরম আরাধ্য বিদ্যমান তার পরিচয় পাওয়া যায়। লালনের গান তত্ত্ববহুল। তার গানের মূল বিষয় দেহতত্ত্ব ও আত্মতত্ত্ব। তার গান সাধন সঙ্গীত। তাই এর ভাব অস্পষ্ট। গানের মাঝে একটা আলো- আঁধারীর খেলা বিদ্যমান। লালনের গানে সুফি ও দেশজ ভাব রয়েছে। সুফীরাও সঙ্গীত ভালোবাসে। সঙ্গীতের ভিতর দিয়ে তারা মনের ভাব প্রকাশ করে। সঙ্গীতের অসীম ক্ষমতার কথা তারা বিশ্বাস করে। সঙ্গীত যেন পাথরে লুকানো আগুন। পাথরে পাথরে ঘষলে আগুন বের হয়। সঙ্গীতও তেমনি এক ধরনের পাথর। আত্মার সাথে ঘষা লাগলে আগুন জ্বলে ওঠে। সোনা আগুনে পুড়ে বিশুদ্ধ হয়। তেমনি সঙ্গীতের আগুনে হৃদয় হয়ে ওঠে আয়না। আর সেই আয়নায় জগতের সৌন্দর্য ধরা পড়ে। তাই সুফিদের কাছে সঙ্গীতের কদর ছিল অসমান্য। লালন শাহ সেই সঙ্গীতেরই সাধনা করেছেন।

লালন তাই বিশুদ্ধ শিল্প-প্রেরণায় তাঁর গান রচনা করেননি, বিশেষ উদ্দেশ্য-সংলগ্ন হয়েই তাঁর এই গানের জন্ম। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনকে অতিক্রম করে লালনের গান অনায়াসে শিল্পের সাজানো বাগানে প্রবেশ করেছে স্ব্বমহিমায়। লালনের গান তাই একই সঙ্গে সাধনসংগীত, দর্শনকথা ও শিল্প-শোভিত কাব্যবাণী। তত্ত্বসাহিত্যের ধারায় চর্যাগীতিকা বা বৈষ্ণব পদাবলি সাধনসংগীত হয়েও যেমন উচ্চাঙ্গের শিল্প-সাহিত্যের নিদর্শন, তেমনি বাউলগানের শ্রেষ্ঠ নজির লালনের গান সম্পর্কেও এই একই কথা বলা চলে।

দীর্ঘজীবী লালন প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও অনুমান করা চলে, তা অনায়াসেই হাজারের ঘর ছাড়িয়ে যাবে। লালন ছিলেন নিরক্ষর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগই তাঁর হয়নি। কিন্তু তাঁর সংগীতের বাণীর সৌকর্য, সুরের বিস্তার, ভাবের গভীরতা আর শিল্পের নৈপুণ্য লক্ষ্য করে তাঁকে নিরক্ষর সাধক বলে মানতে দ্বিধা থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন স্ব্ব-শিক্ষিত। ভাবের সীমাবদ্ধতা, বিষয়ের পৌনঃপুনিকতা, উপমা-রূপক-চিত্রকল্পের বৈচিত্র্যহীনতা ও সুরের গতানুগতিকতা থেকে বাউলগানকে তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর সমকালেই তাঁর পদাবলি লৌকিক ভক্তম লীর গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষিত সুধীজনকেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। উত্তরসময়ে লালনের গান দেশের ভূগোল ছাড়িয়ে পরদেশেও ঠাঁই করে নিয়েছে। এই নিরক্ষর গ্রাম্য সাধককবির শিল্প-ভুবনে প্রবেশ করলে বিস্মিত হতে হয় যে, তিনি কত নিপুণভাবে শিল্পের প্রসাধন-প্রয়োগে রমণীয় করে তুলেছেন তাঁর গানকে। ভাব-ভাষা, ছন্দ-অলঙ্কার বিচারে এই গান উচ্চাঙ্গের শিল্প-নিদর্শন এবং তা তর্কাতীতরূপে কাব্যগীতিতে উত্তীর্ণ।

সুরের সহযোগে শব্দের জিয়ন-কাঠিই কবিতা কিংবা সংগীত-পদের শরীরে প্রাণ-প্রবাহ সঞ্চার করে থাকে। কুশলী হাতে প্রচলিত শব্দ নতুন ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য নিয়ে ধরা দেয়। প্রয়োগ-নৈপুণ্যে আটপৌরে শব্দও যে কীভাবে নতুন অর্থ-ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, লালনের গান তার উজ্জ্বল উদাহরণ। লালন তাঁর গানে সমার্থক শব্দের ['আরশি', 'আয়না', 'দর্পণ'] ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহারে বিশেষ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন : যেমন_ ক. 'বাড়ির কাছে আরশিনগর', খ. 'আয়নামহল তায়', গ. 'জানো না মন পারাহীন দর্পণ'। 'নিরক্ষর' লালনের তৎসম শব্দের অজস্র ও উপযুক্ত ব্যবহার বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। বাংলা শব্দের সঙ্গে আরবি-ফারসি শব্দের গভীর আত্মীয়তা-যোগ ঘটিয়ে তিনি তাঁর গানকে আরও আকর্ষণীয় ও শ্রীমণ্ডিত করে তুলেছেন। কস্ফচিৎ ইংরেজি শব্দের প্রয়োগও তাঁর গানে দুর্লক্ষ্য নয়। এর থেকে সহজেই অনুমান করা চলে যে, গ্রাম্যসাধক লালনের শব্দ-চেতনা কত পরিশীলিত এবং তাঁর শব্দ-ভাদ্ধ ছিল। লালনের অসাধারণ ছন্দ-জ্ঞান প্রাজ্ঞ ছান্দসিকের মনেও বিস্ময় জাগায়।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.