এক শতাব্দীরও বেশি সময় জূড়ে বিস্তৃত লালন ফকীরের জীবন। এ সময়সীমার মধ্যে তিনি রচনা করেছেন, গেয়ে বেড়িয়েছেন হাজার দশেক গান। গানগুলোর সাহিত্যের এমন এক সম্ভারে পরিণত হয়েছে, সারা বিশ্বের লোকোজ এবং মরমী সাহিত্যর ইতিহাসে যার কোনো নজির নেই।
লালন ফকিরের পূর্বপুরুষের ঠিকানা কুলুজি, ধর্ম, বর্ণ, জন্মতারিখ এমনকি তাঁর নামও রহস্যাবৃত। অধ্যাপক মোহাম্মদ মনসুরউদ্দিন লালন ফকীরের গান সংগ্রহে সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। খোঁজ-খবর আন্দাজ আর যুক্তি মিলিয়ে তিনি চেষ্টা করেছিলেন লালনের একখানা জীবনী দাঁড় করাতে।
১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নদীয়া জেলার ছাপরা গ্রামে এক হিন্দু পরিবারে লালনের জন্ম। লালন মারা যান ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর। একদা তীর্থপলক্ষে মুর্শিদাবাদ গমনের পথে ভীষণ অসুস্থতাহেতু তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। সহযাত্রীরা তাঁকে মৃত ভেবে নদীতে ছুড়ে ফেলে দেয়। ভাসতে ভাসতে এক স্নানঘাটে গিয়ে ঠেকেন লালন। তারপর চেতনা ফিরে পেয়ে সাহায্যের আশায় চীৎকার করেন। এক মুসলমান পরিবার তাকে উদ্ধার করে। রোগমুক্তির জন্য তাঁকে ওই পরিবারে দীর্ঘদীন কাটাতে হয়। সেখানে ওই পরিবার আধ্যাত্মিক গুরু যশোরের সিরাজ সাঁইয়ের অনুপ্রেরণায় তিনি দরবেশ হিসেবে দীক্ষা নেন। দীর্ঘ বিরতির পর তিনি নিজ পরিবারে ফিরে গিয়ে ওই মুসলমান পরিবারে তাঁর দীর্ঘদীন অবস্থানের ঘটনা বিবৃত করেন। ফলে তাঁকে একঘরে করা হয়। লালন তখন বাউল হয়ে যান। পরমাত্মার খোঁজে বাকী জীবন তিনি উৎসর্গ করেন।
জীবদ্দশাই লালন অত্যন্ত খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দু’সপ্তাহ পর স্থানীয় হিতকরী পত্রিকা “মহাত্মা লালন ফকির” শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ওই সম্পাদকীয়তে লালনের খ্যাতির বিবরন দেওয়া হয়। ওতে লেখা হয়-
নিজে লেখাপড়া জানিতেন না, কিন্তু তাহার রচিত অসংখ্য গান শুনিলে তাহাঁকে পরম পণ্ডিত বলিয়া বোধ হয়। তিনি কোন শাস্ত্রই পড়েন নাই, কিন্ত ধর্মালাপে তাহাকে বিলক্ষণ শাস্ত্রবিদ বলিয়া বোধ হইত।
ওই একই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, মৃত্যুকালে লালনের দশ হাজার শিষ্য ছিল। শিষ্যরা তাঁকে ‘সাঁই’ বলে সম্বোধন করত। একারণে দরবেশদের নামের শেষে ব্যবহৃত ‘শাহ্’ পদবীটিও তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়।
লালন ছিলেন বাউলশ্রেষ্ঠ। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় বাউল মতাদর্শ ব্যাপক প্রসারলাভ করে এবং লালনের সৃজনশীল সাধনার জোরে উনবিংশ শতকে তা পুরো মাত্রায় পরিপুষ্টি লাভ করে। বাউল মতাদর্শ কোন পৃথক ধর্ম নয়, বরং আল্লাহকে অনুধাবনের একটি পথ মাত্র।
বাউলদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে। গৃহকর্মে নিয়োজিত ব্যাক্তিও বাউল সাধনা অনুসরন করতে পারে। তবে বাউলদের প্রধান অংশটি সংসারত্যাগী ও সহায়- সম্পদহীন। দিনের বেলা তারা একতারা হাতে ভিক্ষাবৃত্তি করে, গান বাঁধে, সাধারণ্যে তাদের গান শুনিয়ে বেড়ায়। রাত নামলে তারা তাদের আখড়ায় ফিরে আসে। সেখানে যৌথ তত্ত্বলোচণা, ভজন–সাধনা হয়। বাউলরা মসজিদেও যায় না, মন্দিরেও না। তাঁরা শরিয়তও মানে না, শাস্ত্রও মানে না। গুরুবাদী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কোনো পীর বা স্বামীর দ্বারস্থ হয় না। মেয়েদের নিয়ে তাঁরা আখড়াতেই রাত্রিযাপন করে, সূফীরা যা করেনা। বাউলদের ক্ষেত্রে মেয়েরা সাধনারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে মেয়েদের সঙ্গে একত্রে বাস করলেও সন্তানধারণ করা তাদের নিষিদ্ধ।