খুলনা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া বলেছেন, কারো কারো মতে নিরক্ষর বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের সৃষ্টি গানে গভীর জ্ঞান আমাকে সত্যিকার অর্থে বিমোহীত করেছে। তিনি জ্ঞানভান্ডারে এক অনাবিস্কার পৃথিবী। তাঁকে চিনতে অনেক দেশ বহুভাবে উপস্থাপন করেছেন। আধ্যাত্মিক সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে সত্য ও জাতহীন সমাজ গড়তে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি।
লালন সাঁই এক বিশ্ব মানব। আজকের যুগেও তিনি মানুষের হৃদয়ের মাঝখানটা দখল করে আছেন। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় গবেষনা হচ্ছে। হচ্ছে তাঁর গানের ভাষান্তর। যুগে যুগে মানুষের কল্যাণে জ্ঞানী-গুনি ও পথ প্রদর্শকদের জন্ম। তেমনি কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার পবিত্র মাটিতে লালন সাঁইয়ের মত মহাত্মা মহাজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। মানবজনমের পূর্নজন্মে লালন কোন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। লালন সাঁই সকল ধর্মের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে সদা সত্য পথে চলতে মানুষকে মানতাবাদীর পথে ডাক দিয়ে ছিলেন। গতকাল বুধবার রাতে ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ীতে লালন একাডেমির আয়োজনে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১২৭তম তিরোধান দিবস (মৃত্যুবার্ষিকী) উপলক্ষ্যে ৩দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার গতকাল বুধবার সমাপনী দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, লালন সাঁই মানবতার ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই অসংখ্য গান লিখে গেছেন। মানুষেরা ভজলে যে প্রকৃত সরল ও খাটি মানুষ হওয়া যায় লালন মানুষকে শিখিয়েছিলেন। ধর্মের বেড়ালে মানুষকে আটকিয়ে রাখা যাবে না। কোন ধর্মের মধ্যে আবদ্ধ থেকে স¤প্রীতি বজায় রাখা যায় না। সকল ধর্মের উপর মানব ধর্ম। এই মরমী সাধকের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকলেও তিনি ছিলেন আধুনিক সমাজ বিন্যাসে স্ব-শিক্ষিত। ধর্ম আর জাতি ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কল্যাণে কি অসীম কথা বলেছেন তিনি। তিনি বলেন দেহ এবং আত্মার মাঝে বসবাসকারীকে আমরা সহসায় না চিনতে পারলেও লালন সাঁই গানের মধ্যে চিনিয়েছেন সে কোনজনা। প্রধান অতিথি আগামী দিনের নেতৃত্বদানকারী যুব সমাজের প্রতি আহবান রেখে বলেন, ব্লূ হোয়েলের মত আত্মঘাতি খেলায় নিজেকে নিমজ্জিত না করে খেলার মাঠের প্রতি আগ্রহ গড়ে তোল। মাদকের ভয়াবহতা থেকে নিজেরে সন্তানকে রক্ষা করতে আপনার সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখুন এবং লালন সাঁইয়ের আদর্শ অনুপ্রানীত হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদেরকে গঠনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করুন। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই ছিলেন বাঙালীর আধুনিক সমাজ বিন্যাসের রূপকার। বাঙালি জাতিসত্বা চেতনা বোধের প্রতœপুরুষ ফকির লালন সাঁই। লালনের এই পূণ্য ভূমিতে তাঁকে স্মরণ করতে তিনি তাঁর যোগ্য শিষ্যদের রেখে গেছেন। যুগে যুগে তাঁর ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন তারা। তাঁর মানবতার ভাবধারা কুষ্টিয়াকে ভাববাদের রাজধানীতে পরিণত করেছেন। সভ্যতার এই যুগে মানুষ মানুষে হিংসা বিদ্বেশ ভূলে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের গান, ধর্ম দর্শনের চিরাচরিত ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন এই শ্লোগানকে বাস্তবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে হবে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো: জহির রায়হানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল বায়েছ মিয়া, ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. অরবিন্দু পাল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদীন, কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা পত্রিকার সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুর রশীদ চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক ও কলামিষ্ট শেখ গিয়াস উদ্দিন আহমেদ মিন্টু, কুষ্টিয়ার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এ জেড এম শফিউল হান্নান, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আমিরুল ইসলাম, বিশিষ্ট লালন গবেষক আলহাজ্ব গাজী মঞ্জুরুল ইসলাম, জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি আলম আরা জুঁই প্রমুখ।
স্বাগত বক্তব্য ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন লালন একাডেমির এ্যাডহক কমিটির সদস্য সচিব উছেন মে। ফকির লালন সাঁইয়ের আধ্যাত্মিকতা তুলে ধরে প্রধান আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড.হারুন-উর-রশিদ আসকারী।
এবারের তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠানে আসা দেশ-বিদেশের লাখ ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরুদের চরণ ধূলায় সিক্ত বাউল সম্রাটের ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ী। সাঁইজির মতাদর্শের ধর্ম আর জাতি ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কল্যাণে মানুষ নিবেদিত থাক চিরকাল এবং মানবতার নিগুড় প্রেমের ভাবধারা বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ভক্তকুলের অঙ্গীকার। সভ্যতার এই যুগে মানুষ মানুষে হিংসা বিদ্বেশ ভূলে সাঁইজির জাতহীন মানব দর্শনের “কে তোমার আর যাবে সাথে” এই শ্লোগানকে বা¯Íবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে হবে। মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের অহিংস মানবতা ও ফকিরী মতবাদের জাতহীন মানব দর্শন ও সঙ্গীত দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বাঙ্গনে নিজের মহিমায় জায়গা করে নিলেও বাংলা ভাষা ব্যতিত অন্য কোন ভাষায় প্রকাশ, প্রচার ও প্রসার ঘটেনি তেমন একটা। এ ব্যাপারে আরো উদ্দ্যেগী হতে হবে। মানবতা মুক্তি ও ভক্তির পথকে প্রতিষ্ঠা করতেই তিনি হাজারো ভাবধারার গান সৃষ্টি করছেন। কিন্তু তা বিশ্ববাসীকে নাড়া দিতে পারেনি যথার্থ একাডেমিক প্রচার আর প্রকাশনার অভাবে। তিনি অতি কঠিন কথাগুলো খুব সহজ করে তার গানে বলে গেছেন। তাঁর অমর সৃষ্টি সঙ্গীত গতানুগতিকভাবে প্রচার ও প্রকাশ হলে চলবেনা। বিশ্বের বিশিষ্ট গবেষকেরা লালনের সৃষ্টি আরো নতুন নতুন তথ্য জানতে চাই।
লালন একাডেমির সভাপতি কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো: জহির রায়হান ৩দিনের তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠান সফল স্বার্থক ও সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হওয়ায় আইনশৃংখলায় নিয়োজিত পুলিশ, র্যাব, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ, দেশ-বিদেশ থেকে আসা লালন সাঁইয়ের অগনিত ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরু, সাংবাদিকসহ এলাকার সুধীজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ও ধন্যবাদ জানান।
আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে লালন মঞ্চে বিভিন্ন শিল্পি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে লালন সংগীতি পরিবেশিত হয়। এতে সংগীত পরিবেশন করেন উপহমাদেশের প্রখ্যাত বাউল শিল্পী সমীর বাউল, সুফিয়া কাঙ্গালিনীসহ দেশের খ্যাতিনামা শিল্পীবৃন্দসহ লালন একাডেমীর স্থানীয় শিল্পিরা। ৩ দিনব্যাপী তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠানমালার উপস্থাপনা করেন সৈকত মাহমুদ ও লিনা আফরোজ।
সুত্রঃ- আন্দোলনের বাজার