বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালন সাঁইজীর তীর্থ যাত্রা
লালন সাঁইজীর তীর্থ যাত্রা

বাংলা ১২৮৭ সন মোতাবেক ইংরেজি ১৮৮০ সালে ফাল্গুনের দোল পূর্ণিমায় ছেউড়িয়ায় ফকির লালন সাঁইয়ের আঁখরা বাড়ীতে বাৎসরিক সাধুসেবা ও স্মরণ উৎসবে তাঁর সকল শিষ্য, ভক্ত ও সাধুগুরু ফকির দরবেশ যোগদান করেন। অনুষ্ঠান শেষে কিছু শিষ্য ভক্ত রয়ে গেলেন। তাঁরা পরের দিন ফকির লালন সাঁইয়ের সাথে দেখা করে তাঁকে তাঁদের মনের বাসনা জানালেন- “সাঁইজী, আমরা আপনার সাথে তীর্থ ভ্রমণে যেতে চাই।” এই প্রস্তাব শুনে শিষ্য ভক্তদের বললেন- “তোমাদের মনের বাসনা পূরণের চেষ্টা করবো।”

ফকির লালন সাঁইয়ের শিষ্য ভক্ত হিন্দু মুসলমান উভয়ই ছিলেন। সেহেতু এই তীর্থ ভ্রমণে যাওয়ার আগ্রহীদের মধ্যে কৃষ্ণনগর অঞ্চলের মহেশগঞ্জ, তিওরখালি ও আমঘাটা যে শিষ্য ভক্তদের বাড়ি, তাঁরা সাঁইজীর সঙ্গে এই তীর্থ ভ্রমণে যাওয়ার জন্য পরামর্শ করলেন। কৃষ্ণনগর অঞ্চলের ভক্তদের উদ্দেশ্য সাঁইজী যখন তীর্থ ভ্রমণে যাবেন তখন প্রথম চরন ধুলি তাঁরাই পাবেন। যেহেতু তাঁদের বাড়ি কৃষ্ণনগর অঞ্চলে, সেহেতু সাঁইজী এই পথেই যাবেন। সেই কারণে এই শিষ্য ভক্তরা আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, এ বিষয়ে শীতল শাহের শরণাপন্ন হলে বহুদিনের লালিত মনের বাসনা পূরণ হতে পারে। কারণ শীতল শাহ্‌ ভক্তদের মধ্যে বড় ছিলেন। তাঁর ব্যবহার ছিল ভদ্র, মার্জিত এবং বিনয়ী; তাছাড়া তিনি অত্যান্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাই লালন সাঁইজী যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে মত বিনিময়ের জন্য শীতল শাহের সঙ্গে আলোচনা করতেন। এই সকল বিষয় শিষ্য ভক্ত জানতেন। তাই তীর্থযাত্রার জন্য শিষ্য ভক্তগন ফকির শীতল শাহকে জানালেন যে, “আমরা সাঁইজীর সঙ্গে তীর্থ ভ্রমণে যেতে চাই।” নবদ্বীপ বাৎসরিক সাধু সম্মেলন শেষ করে আমরা উড়িষ্যার পুরীতে জগন্নাথ মহাপ্রভুর ধামে যাবার জন্য আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি। আপনি আমাদের হয়ে সাঁইজীর সঙ্গে আলোচনা করে আমাএর জানালে খুশি হবো।

ফকির শীতল শাহ্‌ বিষয়টি শুনে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “সাঁইজী আপনাদের কি আশ্বাস দিয়েছেন ?” তখন শিষ্য ভক্তগণ হাসি মুখে বললেন- আমাদের প্রস্তাব শুনে সাঁইজী জানালেন, “আচ্ছা তোমাদের মনের বাসনা পূরণের চেষ্টা করবো।” ফকির শীতল শাহ্‌ বুঝলেন সাঁইজীর বাক্য কোনদিন বিফল হবে না। তাই ভক্তদের জানালেন, “এ বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত থাকেন। সময় যখন হবে তখন সাঁইজী আপনাদের জানাবেন।” এই কথা শুনে শিষ্য ভক্তগণ খুশি হলেন, কিন্তু তাঁদের মনের ধাঁধাঁ কাটল না।

ফকির শীতল শাহ্‌ শিষ্য ভক্তদের বললেন, “তাহলে আগামীকাল সাঁইজীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সকল বিষয় অবগত হয়ে আপনাদের জানাব।” পরের দিন সাঁইজী সাধন কক্ষ হতে এসে ভক্তদের নতুন একটি সত্যের বাণী শোনালেনঃ

“একবার জগন্নাথ দেখ রে যেয়ে
ও জাত কেমনে রাখ বাচায়ে।” [ গান নং- ৬০১]

এই বানী শুনে সকলেই আচার্যন্মিত হলেন। তারপর ফকির শীতল শাহ্‌ সাঁইজীর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন তীর্থ ভ্রমণ সন্মন্ধে - শিষ্য ভক্তগণ আপনার কাছে যে অনুরোধ রেখেছেন এ বিষয়ে সকলেই অপেক্ষা করছেন। তখন লালন সাঁই হেসে বললেন, “আচ্ছা বাবা, সকল তীর্থ ভ্রমণে সত্যই যেতে হবে ?” শিষ্যগণ হ্যাঁ সাঁইজী বলে করজোড় মিনতি জানালেন। সাঁইজী বাক্য দিলেন, “হ্যাঁ তীর্থ ভ্রমণে যাওয়া হবে। শীতল শাহ্‌, ভোলাই শাহ্‌, মানিক শাহ্‌ ও মনিরুদ্দীন শাহের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে দিন ধার্য করলেই হবে।” অবশেষে সবাই মিলে একটা আলোচনা করে দিন ধার্য করে সাঁইজী জানালেন। সাঁইজী শিষ্যদের জিজ্ঞাসা করলেন- “তোমরা এবার সন্তুষ্ট হয়েছো তো ?” হ্যাঁ সাঁইজী ! সকলের মনে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেলো।

প্রথমে কৃষ্ণনগর হয়ে নবদ্বীপ গৌরাঙ্গ মহা প্রভুর ধামে সাধু সম্মেলন শেষ করে, উড়িষ্যার পুরী জগন্নাথ মহাপ্রভুর ধামে আমরা যাত্রা করবো এবং এই তীর্থ ভ্রমণ হবে এক মাস।

সুতারাং ধার্যদিনের দু’দিন পূর্বে তোমরা ছেউড়িয়া আঁখরা বাড়ীতে এসে পৌঁছাবে। আর এই আখড়ার শিষ্য ভক্তবৃন্দ তোমরাও তীর্থ ভ্রমনের জন্য প্রস্তুত থাকবে। শিষ্য ভক্তগণ সাঁইজীকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিবেদন করে বিদায় নিলেন।

লালন সাঁইজীর তীর্থ ভ্রমনের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণনগর যাত্রা

নিদিষ্ট দিনে সাঁইজী ভদ্র ছমির, ফকির গোপাল শাহ্‌, ফকির ছুটির শাহ্‌ এবং ফকির আহাদ আলী শাহ্‌কে আখড়ার দায়িত্বে নিয়োজিত করে শিষ্য ভক্তসহ চল্লিশজন (?) কৃষ্ণনগরের উদ্দেশ্যে ছেউড়িয়া আখড়া হতে কুষ্টিয়া বড় ষ্টেশনে পৌঁছালেন। কিছুক্ষণ পর প্লাটফরমে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। সকলেই রাল গাড়িতে উঠে বসলেন। তারপর গাড়ি দুরতগতিতে চলতে শুরু করলো। রানা ঘাট জংশন ষ্টেশনে গাড়ি পৌঁছালে, সকলেই গাড়ি হতে নেমে কৃষ্ণনগর অভিমুখের গাড়িতে উঠে বসলেন। এক সময় গাড়ি কৃষ্ণনগর ষ্টেশনে যেয়ে পৌঁছালে কৃষ্ণনগরের ভক্তবৃন্দ সাঁইজীকে অভ্যর্থনা জানালেন। পূর্বেই অনেকগুলা গরুর গাড়ি ঠিক করা ছিলো। সবাই গাড়িতে চড়ে কৃষ্ণনগর ও নবদ্বীপের মাঝামাঝি মহেশগঞ্জ ফকির ইমান আলী শাহের আখড়াতে উপস্থিত হলেন। তারপর গাড়ি থেকে ফকির লালন সাঁইকে নামিয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসানো হলো। স্থানীয় শিষ্য ও ভক্তবৃন্দ সাঁইজীকে ভক্তি শ্রদ্ধা জানালেন এবং সকলেই যে যার মত সাঁইজীকে সেবা শুশ্রদ্ধায় লেগে গেলেন।

ফকির ইমান আলী শাহের আখড়াতে ফকির লালন সাঁইয়ের স্বরচিত গান মহা ধুমধামের সঙ্গে শুরু হলো। এই গান শোনার জন্য এবং সাঁইজীকে এক নজর দেখার জন্য অনেক মানুষের ভীড় জমে উঠল। এই অনুষ্ঠান তিন দিন চলে।

লালন সাঁইজীর নবদ্বীপ যাত্রা

অবশেষে নির্দিষ্ট দিনে ফকির ইমান আলী শাহের আখড়া হতে আরো দশজন ভক্তসহ মোট পঞ্চাশজনের একটা দল গরুর গাড়ি যোগে নবদ্বীপে উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। স্বরূপগঞ্জ ঘাটে নেমে নৌকা যোগে গঙ্গানদী পার হয়ে ভক্তবৃন্দসহ নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ধামে পৌঁছালেন।

পঞ্চাশজন লোকের একই রকম বেশভুষা অবলোকন করে মন্দির কমিটির লোক ইনাদের পরিচয়াদি জানতে চাইলে “ফকির শীতল শাহ্‌ বললেন- “আমরা কুষ্টিয়া থেকে এসেছি” কমিটির লোক আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কোন মতবাদের সাধক ?” ফকির লালন সাঁইজী বললেন, “আমরা দরবেশ, ফকির মতবাদের সাধক।” সম্মেলনে সাধুগুরু বৈষ্ণবদের বসবার জন্য নির্ধারিত জায়গা থাকলেও মুসলমান নাড়ার ফকির বলে সাঁইজী ও তাঁর ভক্তদের জন্য আঙ্গিনার একপাশে বড় একটি নিম গাছের তলায় জায়গা নির্ধারণ করে দিলেন। ফকির লালন সাঁই ও তাঁর ভক্তগণ সেইখানে আসন গ্রহণ করলেন। অধিবাসের সেবার সময় দেখা গেল- সাধুগুরু বৈষ্ণবদের সেবা হয়ে যাবার পর এঁদের সেবা দিলেন। সমস্ত রাত অনুষ্ঠান চলল। সকালে বাল্য সেবার পূর্বে একদল যুবক একটি পিতলের থালায় সোয়া সের চুন নিয়ে আঙ্গিনায় ঢুকে বলল, “সাধুদের জন্য আমরা মহাপ্রভুর প্রসাদ এনেছি।” আপনারা সবাই হাত পাতুন এবং প্রসাধ গ্রহণ করুন। কিন্তু সাধু মহোদয়গণ চুনে মুখ পুড়ে যাওয়ার ভয়ে কেহই হাত পাতলেন না। করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন। তখনি যুবক দল বলল, “আপনারা কেমন সাধু ? মুখ পুড়ে যাবার ভয়ে কেহই হাত পাতলেন না। কিন্তু সাধুগুরু বৈষ্ণবদের তো মুখ পুড়বার কথা নয়।”

আঙ্গিনার একপাশে অবস্থানরত ফকির লালন সাঁই সাধুগুরু বৈষ্ণবদের করজোড়ে ক্ষমা চাওয়া দেখে যুবকদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের মনের বাসনা কি ?” যুবকদল তাঁদের বাসনা প্রকাশ করলে, সাঁইজী বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা একটা বড় চাড়ি নিয়ে এসো, ঐ সঙ্গে একখণ্ড কলার পাতাও এনো।” যুবকদল সাঁইজীর কথামত চাড়ি এবং কলার পাতা নিয়ে এলো। তখন সাঁইজী বললেন, “জল দিয়ে এই চাড়িটা ভরে দাও।” এহেন কার্যকলাপ দেখে সাধুগুরু বৈষ্ণব সকলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে, আশ্চর্য ঘটনা দেখতে লাগলেন। সাঁইজী কলার পাতায় খানিকটা চুন তুলে রেখে বাকিটা সেই প্রকান্ড মাটির চাড়িতে জলে গুলিয়ে দিলেন। সেই গোলানো চুন হতে এমন সুঘ্রাণ বেরোতে লাগল যে, সাধুরা তাতে মহিত হয়ে গেলেন। এরপর সাঁইজী যুবকদের বললেন, “এইবার তোমরা মেটে গ্লাস নিয়ে এসো এবং সাধুগুরু বৈষ্ণব সবাইকে গোলানো চুনের শরবত এক গ্লাস করে দিয়ে দাও।” সাধুদের তখনও ভয় কাটেনি। তাছাড়া চুন গোলানো শরবত আবার কিভাবে সেবা করা যায় ? কিন্তু সাঁইজী সবার সামনে কলার পাতায় উঠানো সব চুনটুকু সেবা করলেন এবং সাধুদেরকে বললেন, এবার আপনারা আপনাদের গ্লাসের শরবত পান করুন।” সাঁইজীর কথামত তাঁরা পান করে দেখল, গ্লাসের চুন গোলানো শরবত সত্যিই শরবতে পরিণত হয়েছে এবং তা অমৃতের স্বাদে ভরপুর। এই ঘটনার পর সবাই বুঝলেন ইনি মানুষ নন একজন মহাসাধক। সুতারাং বাল্য সেবার পারশ সাঁইজীকে দেওয়ার জন্য সাধুগুরু বৈষ্ণব সকলেই কমিটিকে অনুরোধ জানালেন। বলা বাহুল্য, কমিটি বাল্যসেবা এবং পূর্ণসেবার উভয় পারশই সাঁইজীকে প্রদান করেন।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.