বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

আত্ননিবেদনের সুর – ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
আত্ননিবেদনের সুর – ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

লালন শাহের কাব্যে আত্ননিবেদনের সুর

মানুষের মধ্যে কতকগুলি ভাব আছে, যার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন সৌন্দর্যবোধ। পৃথিবীতে সভ্য, অসভ্য, অর্ধসভ্য সকল জাতির মধ্যে এই সৌন্দর্যবোধ বিদ্যমান আছে।

সৌন্দর্যবোধ দ্বারা মানুষের কোনই জৈব অভাব দুর হয় না। তবু কিন্তু মানুষের মন সৌন্দর্যের জন্য পাগল। জীবন-যাত্রায় এর প্রয়োজন নেই, কিন্তু মানুষের মনে এর প্রয়োজন আছে। এইরূপ মানুষের একটি মনোভাব প্রেম। জীবনযাত্রায় তাঁর কোন দরকার হয়তো নেই, কিন্তু জগতে প্রেমশুন্য কোন মানুষ নেই। মানুষের এইরূপ আরেকটি ভাব অদৃশ্য বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের মধ্যে যে বিশ্বাস যুগে যুগে মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে – ধর্ম ও কর্মের পথে পরিচালনা করেছে – দুঃখ-যন্ত্রনা-নির্যাতনের মধ্যে আশা ও আনন্দ দিয়েছে; তা খোদার প্রতি বিশ্বাস। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ভাবে মানুষ-বিশ্বাসী মানুষ তাঁকে ডেকেছে এবং তাতেই সে চরিতার্থ হয়েছে। এ হচ্ছে মরমিয়াবাদ।

বাংলাদেশের নৈষ্ঠিক হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের বাইরে এক শ্রেণীর সাধক ছিলেন এবং এখনও আছেন যারা খোদাকে চেয়েছেন এবং চান। হিন্দুদের মধ্যে তাঁরা হলেন বাউল, সাঁই, কর্তাভজা প্রভৃতি। আর মুসলমানদের মধ্যে তাঁরা হলেন ফকীর, দরবেশ। ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক বড় একটা নেই। তাঁরা কিন্তু মুখে ধর্মের আনুগত্য অস্বীকার করেন না। একদল ফকীর হয়তো নামাজ, রোজা ইত্যাদি ইসলামের অবশ্যকরণীয় কোন কাজই করেন না। কিন্তু তাঁরা প্রকাশ করেন যে তাঁরা আল্লা ও রসুলের ভক্ত। তাঁরা বলেন, সাধারণ মুসলমান আছে শরীয়ত বা ধর্মের আচার নিয়ে। আর, আমরা আছি মারেফাত বা ধর্মের অন্তরঙ্গ নিয়ে। এঁরা জিকরে মশগুল হন, মারেফতী গানে মাতোয়ারা হয়ে নাচেন, লম্বা চুল, দাঁড়ি রাখেন, গেরুয়া রঙের আলখাল্লা পরেন। মৌলানা-মৌলবীরা এদের বে-শরা ফকীর বলে নাম দেন। তাঁরা এঁদের ইসলামের গণ্ডীর বাইরে কাফির বলে ফৎওয়া দেন। সত্যই দলীল প্রমাণে এই সমস্ত বে-শরা ফকীর ইসলামের গণ্ডীর বাইরে পড়ে। তবু এ কথা সত্য যে, তাঁরা নিজের ভাবে সে যতই ভুল হোক – খোদার ভক্ত। মদন বাউল, লালন শাহ্‌ প্রভৃতি এই শ্রেণীভুক্ত। এঁদের গানে এমন অনেক আলো-আধারি ভাষা আছে, যা তাঁদের সম্প্রদায়ের বাইরের কারও বোঝা অতি কঠিন। কতকভাব আছে – যার উৎস হিন্দু ধর্ম, আর কতক ভাব আছে – যার উৎস ইসলাম। আর কতক যা তাঁদের নিজস্ব। এর কতকগুলি গান দেহতত্ত্ব বিষয়ক। বৌদ্ধদের সহজসিদ্ধি হতে বোধহয় এগুলি লওয়া।

এখন লালন শাহের গান থেকে তাঁর বিভিন্ন ভাবের কয়েকটি উদ্ধৃত করছি। এখানে অবশ্য আমাদের অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের লোকসঙ্গীত সংগ্রহ “হারামণি”র ঋণ স্বীকার করতে হয়।

এনে কোন ফুলের সৌরভ জগতকে মাতালিরে
জমীন ছাড়া গাছের মূল ডাল ছাড়া পাতা
ফল ছাড়া বীথি তাঁহার অসম্ভব কথারে।
গাছের নামটি চম্পকলতা, পত্রের নাম তাঁর হেম,
কোন ডালেতে রসের কলি কোন ডালেতে প্রেম
লালন শা ফকীর বলে ভক্তি প্রেমের নিগুঢ় কথা,
যার হ্রদয়ে বস্তু নাই সে খুঁজলে পাবে কোথারে।।

এই গানটির অর্থ মুরশিদের মুখে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আরেকটি গানের অংশঃ

যে করিবে কালার চরনেরি আশা,
তুমি জান নারে তাঁরও কি দুর্দশা।
ও সে ভক্ত বলি রাজা ছিল রাজ্যেশ্বর,
বামনরূপে প্রভু করে ছলনা।।

কর্ণ রাজা ভবে বড় ভক্ত ছিল,
অতিথরূপ তাঁরে স্ববংশে নাশিল,
কর্ণ অনুরাগী না হইল,
দুঃখী অতিথের মন করে সান্তনা।।

প্রহাদ চরিত্র দেখ এহি পৃথ্বীধামে,
কত দুঃখ তাঁর এহি কৃষ্ণনামে,
ও তাঁরে জ্বলে ডুবাইল, অগ্নিতে ফেলিল,
তবু না ছাড়িল শ্রীনাম সাধনা।।

রামের ভক্ত লক্ষণ ছিল চিরকালে,
শক্তিশেল হানিল তাঁদের বক্ষস্থলে,
তবু রামচন্দ্রের প্রতি না ভুলিল ভক্তি,
ফকীর লালন বলে তাঁহার কর বিবেচনা।।

নিশ্চয়ই এ গানটির উৎস হিন্দু – সংস্কৃতি। আরেকটা গানের নমুনা বলছিঃ

এসে মদীনায় তরিক কে জানাল এ সংসারে।
কে তাহারে চিনতে পারে।।

সবে বলে নবী নবী, নবীকে নিরাঞ্জন ভাবি,
দিল ঢ়ুঁড়িতে জানতে পাবি, আহমদ নাম দিল কারে।।

যার মর্ম সে যদি না কয়, সাধকে কি জানিতে পায়,
তাইতে আমার দীন দয়াময় মানুষরূপে ঘুরে ফিরে।।

নবী এজবাত যে বোঝে না, মিছেরে তাঁর পড়াশুনা,
লালন কয় ভেদ উপাসনা না জেনে চটকে মারে।।

এই গানটির উৎস বাহ্যতঃ মুসলিম বটে, কিন্তু এতে আছে ইসলাম বহির্ভূত অবতার-বাদের ইঙ্গিত। এই গানে “নবী এজবাত” অবশ্য তসওউফের “নফী ইসবাত”। এই বার দেহতত্ত্ব বিষয়ক একটি গান উদ্ধৃত করছিঃ

দিল দরিয়ার মাঝে দেখলাম আজব কারখানা।
দেহের মাঝে বাড়ি আছে,
সেই বাড়ীতে চোর লেগেছে,
ছয়জনাতে সিঁদ কাটিছে,
চুরি করে একজনা।।

এই দেহের মাঝে নদী আছে,
সেই নদীতে নৌকা চলছে,
ছয়জনাতে গুন টানিছে,
হাল ধরেছে একজনা।।

দেহের মাঝে বাগান আছে,
নানা জাতির ফুল ফুটেছে
ফুলের সৌরভ জগত মেতেছে,
কেবল লালনের প্রাণ মাতল না।।

লালন শাহের গানে খোদার প্রতি যে আত্ননিবেদনের গভীর আন্তরিক সুরটি আছে, তাঁর একটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করছি।

ভক্ত যতই সাধনভজন করুক, সে ভাবে এসব কিছুই হলো না, তাই সাধন-ভজন তাঁকে উদ্ধার করতে পারবে না। তাঁকে উদ্ধার করতে পারবে কেবল করুণাময়ের করুণা। তাই সে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তাঁর কাছে সঁপে দেয়। নিচের গানটিতে সেই ভাব প্রকাশ পেয়েছেঃ

কোথায় হে দয়াল কান্ডারী;
এ ভবতরঙ্গে আমার দয়াল,
দাও দাও তোমার চরণতরী।।

যত করি অপরাধ, তত ক্ষমা দাও হে নাথ
পতিতপাবন নাম ধরেছো
এসে কিনারে লাগাও তরী।।

তুমি হে করুণা সিন্ধু, অধম জনার বন্ধু
দাও হে তোমার পাদারবিন্দু
যাতে তুফান তরিতে পারি।।

পাপী যদি না তরাবে, পতিতপাবন নাম কে লবে
জীবের ভাগ্যে আর কি হবে,
যাবে নামের মরম তোমারি।।

ডুবাও ভাসাও হাত তোমার,
এ জগতে কেউ নাই আমার,
ফকীর লালন বলে দোহাই তোমার,
এসে চরণে স্থান দাও হে হরি।।

ভক্ত কঠোর সাধনা করে বুঝেছে, প্রবৃত্তি কখনো তাঁর বশ্য নয়। তাঁর মন সকল সময় বিপথে কুপথে নিয়ে যেতে চায়। তাই সে চাইছে, তাঁর মনকে মনের মালিকের কাছে সঁপে দিতেঃ

গুরু সুভাব দাও আমার মনে।
রাঙ্গা চরণ যেন আমি ভুলিনে।।

গুরু তুমি নিদয় যার প্রতি,
ও তাঁর সদায় ঘটে কুমতি,
তুমি মনোরথের সারথি,
গুরু যেথায় লও যাই সেইখানে।।

গুরু তুমি মন্ত্রের মন্তরী,
তুমি তন্ত্রের তন্তরী,
গুরু তুমি যন্ত্রের যন্তরী,
না বাজালে বাজিবে কেনে।।

আমি জনম অন্ধ মননয়ন,
গুরু তুমি বৈদ্য সচেতন,
কথা বিনয় করি কয় লালন,
তুমি জ্ঞানাঞ্জন দাও মোর নয়নে।।
Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.