বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

সাধক লালন শাহ - ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন
সাধক লালন শাহ - ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন

সঙ্গীতপ্রিয় বাংলা-দেশীয় সমাজে লোকগীতির ক্ষেত্রে সাধক লালন শাহ এত অজস্র ও অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন যে, এইসব পরমার্থ-সূচক মরমী গানের সহজ প্রকাশমাধূর্য ও লালিত্যের গুণেই তিনি বেশ কয়েক শতাব্দী যাবত বাঙালীর হৃদয়ে ভাব-লহরীর উদ্রেক করতে পারবেন। মরমী গানের প্রকৃতিই হচ্ছে, নানা রুপক নিয়ে অতীন্দ্রিয় ভাবকে প্রকাশ করতে হয়। অনেক সময় সেগুলো বুদ্ধি দিয়ে বেড় পাওয়া যায় না, হৃদয় দিয়ে অনুভব করেই লোকে তৃপ্তি পায়।

হৃদয়ের অলক্ষ্যে ভাবগুলো যেন মনকে কোনও মনোহর উচ্চগ্রামে নিয়ে যায়, এ অবস্থা অধিকক্ষণ স্থায়ী না হলেও, এর ক্ষণিক প্রাপ্তির আনন্দটাই বা কম কি? সমুদয় মরমী ভাবের জন্য উপযুক্ত ভাষা না থাকাতেই ভাবাবিষ্ট গায়ককে হয়তো কখনো এক একটা আজগুবি শব্দের উদ্ভাবণ করতে হয়, নয়তো রুপক অলংকার প্রভূতি দিয়ে ঈঙ্গিতে ভাব-সঞ্চারণ করতে হয়, আবার কখনোও হয়ত ঐশিক প্রেরণায় হঠাৎ দৃষ্টি খুলে যায়,- সে অবস্থায় অজ্ঞাতসারে ‘অপরিচিত-ও যেন পরিচিতরুপে আবির্ভূত হয়। এ সব রহস্যের কথা কে কাকে বুঝাবে? যার যার মেকদার মত সেই সেই, একটা অর্থ ঠিক করে নেয়। তাতে একটি বস্তু বা দৃশ্য এক এক জনের কাছে এক এক রুপে গৃহীত হয়। এই অনিশ্চিত ক্ষেত্রের প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জওয়াব নেই।

আমার মনে হয় সদগুরু সবাইকে শিক্ষা দেন, আর যেটুকু পারে সেটুকু ধারণ করলেই মুরশিদ তুষ্ট হন, অবশ্য যার ক্ষমতা অধিক তাঁর দিকে গুরুর কৃপাও কিছু অধিক হয়। এসব অগম্য রাজ্যের কথায় আমার বিশেষ বক্তব্য নাই-তাই তর্ক বা বিতর্কের দিকে আমি যেতে চায়নে। তবে গণিতশাস্ত্রের সামান্য অভিজ্ঞতা থেকেই আমি বলতে পারি,- যখন বহু চেষ্টা করেও কোন অঙ্কের সমাধান করতে পারছিনে, তখন সময় সময় অবচেতন মনে বা স্বপ্নঘোরে হঠাৎ যেন অঙ্কের পেচ খুলে গিয়ে সমাধানটা সুস্পষ্ট হয়ে পড়ে। আধ্যাত্বিক জগতেও এটা যে হতে পারে না, তা কেমন করে বলবো? অকস্মাৎ হৃদয়ের রুদ্ধদারের অন্ধকার টুটে গিয়ে “বিদ্যুৎচ্ছটার মতো দিব্য আলোকের আবির্ভাব” হওয়া আমি বিশ্বাস করি। শুনা যায়, একজন বিশিষ্ট আউলিয়ার মৃত্যুর পূর্বে শয়তান এসে জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি যে বল, “আল্লা আছেন”- তা প্রমাণ করতে পার?” “পারি” বলে আউলিয়া সাহেব এক একটা করে প্রমাণ দিতে শুরু করলেন। কিন্তু শয়তান তাঁর প্রত্যেকটা প্রমাণ যুক্তি দ্বারা খন্ডন করে দিল। এইভাবে দশ-বিশটা প্রমাণ রদ হয়ে যাওয়ায় আউলিয়া সাহেব খুব ফাঁপরে পড়ে গেলেন। হঠাৎ তিনি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন মুর্শিদ তাঁকে বলছেন, “ওরে বেওকুফ-তুই কেন বলছিস না যে, আল্লা আছেন, তা আমি বিল গায়েব বিশ্বাস করি।” মুর্শিদের এই কথা শুনামাত্র শয়তান অন্তর্হিত হল। বস্তুতঃ আল্লা ‘অলখ্ সাঁই’। কখনও কখনও সলক হলেও বেশীর ভাগ সময়েই ‘অলখ’ বা অগোচরে থাকেন। জ্যামিতিশাস্ত্রেও এমন অনেক ‘সত্য’ আছে যা প্রমাণ করা যায় না, সেগুলোকে বলে স্বতঃসিদ্ধ।

উপরে শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে সদগুরুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্যই গুরুরা অজ্ঞতা দূর করে জ্ঞানদান করেন। এই ব্যাপারে নবজন্মের সাথে তুলনীয়। তাই পিতামাতার মতো গুরুও সম্মানীয়। কিন্তু তাই বলে গুরুকে আল্লার সমাসনে বসানো যায় না, আর একমাত্র আল্লা ছাড়া আর কাউকে সেজদা করা হারাম বা নিতান্ত গর্হিত কাজ। অথচ আল্লাই আবার আগুন দিয়ে সৃষ্ট ফেরেশতাদেরকে ও ইবলিশকে আদেশ দিলেন “তোমরা সবাই আদমকে সেজদা কর”। এ কথার কি ভেদ (গুপ্তরহস্য) রয়েছে তা একমাত্র আল্লাই জানেন, আর কেই জানে না। তা ছাড়া কেতাবে যে উক্তি আছে, আদমের পাঁজরের একটা হাড় খুলে নিয়ে তাই দিয়ে হাওয়া বিবিকে সৃষ্টি করে আদম হাওয়াকে বেহেশতে অবাধে একত্রে বেড়ানোর অধিকার দিলেন, আর একটি গাছের ফল ছাড়া, অন্য সব গাছের ফল, যদৃচ্ছভাবে ভোগ বা ভক্ষণ করার অধিকার দিলেন - এসবের তাৎপর্য কি? এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে। অবশেষে ইবলিসকে সাপের আকার ধারণ করায়ে তাকে দিয়ে বিবি হাওয়াকে প্রলুদ্ধ করে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করানো এবং পরে হাওয়া বিবির সঙ্গে আদমকেও ঐ নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করানো হয়, এইসবই বা কেন? এরপর আদম-হাওয়ার মনে লজ্জার উদয় হওয়া, বেহেশতের গাছের লতাপাতা দিয়ে যথাক্রমে পুরুষাঙ্গ ও নারীঅঙ্গ ঢেকে ফেলানো এবং বেহেশত থেকে তাদের বহিস্কৃত করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আরও আশ্চর্যের বিষয় শয়তানের অনুরোধে তাকেও পৃথিবীতে চিরজীবন ভোর আদম-হাওয়া ও তাঁর সন্তান-সন্ততিদের বিপথে নিয়ে যাওয়ার অধিকার দেওয়া হল। এইসব আদিম রহস্য ও পরবর্তীকালে হাবিল-কাবিল কেচ্ছার প্রথম হত্যাকান্ড সংঘটন-এ সব কি আল্লার ইচ্ছাক্রমেই হল? না, এগুলো সবই ইবলিসের কারসাজী? আমরা একদিকে জানি আল্লাই সবই ঘটনার নিয়ন্তা। তাহলে বর্তমানে দুনিয়াব্যাপি যেসব ছলনা, দুষ্কর্ম চলছে এসবের জন্য কি তাঁর দায়িত্ব কিছুই নেই? তিনি শুধু সুকর্মই সংঘটন করেন,আর ইবলিশই সব দুষ্কর্ম করায়? ইবলিশের সঙ্গে কি আল্লার একপ্রকার ভাগ বাটোয়ারার চুক্তি হয়েছে? এসব বড় গুরুতর প্রশ্ন। আবার আমাদের বিশ্বাসযোগে দেখতে পায়,-মানুষকে দিয়ে কবুল করিয়ে নেওয়া হচ্ছে-“আমি ঈমান আনলাম আল্লার প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কেতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসুলদের প্রতি, আর শেষ (অর্থ্যাৎ কেয়ামতের) দিনের প্রতি, তকদীরের ভালোমন্দ সবকিছু আল্লার তরফ থেকেই ঘটে এই সূত্রের প্রতি।”এই ঈমানকেই কেউ নির্বিচারে (বিল গায়েব) বিশ্বাস করে, কেউবা তলিয়ে দেখে বিশ্বাস করে। এইসব গুরুতর প্রশ্ন মনে জাগ্রত হবেই। আল্লা স্বয়ং এসবের জওয়াবে যা বলেছেন তার ভাবার্থ হচ্ছে : আমি আমার বান্দাদের ভালো-মন্দ বেছে নেবার কিছুটা শক্তি দিয়েছি, আবার কতকটা কষেও রেখেছি, বস্তুত আমি লোক বুঝে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি-ভূলভ্রান্তি ক্ষমা করি, অক্ষমদের অবস্থা বিবেচনা করি, প্রকৃত অনুতপ্ত লোকদের মার্জনা করি, কিন্তু মুনাফেক এবং উদ্ধত সত্যেদ্রেহীদের কিছুতেই ক্ষমা বা দয়া করি না। অর্থ্যাৎ আল্লা তাঁর নিজের বিচার অনুসারে কাজ করেন, তিনি অসীম দয়াময় ও সর্বজ্ঞ। শ্রেষ্ঠ মানুষের বিচারেও ভূল হতে পারে, কিন্তু আল্লা পাকের ভূল হয়না। মোটকথা সীমাবদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহির্ভূত বিশাল ক্ষেত্রে মানবকূলের জীবনের অভিযাত্রা সহজ ও নিকন্টক নয়। তাই কবি নজরুল আক্ষেপ করে বলেছেন :

‘কেন দিলে এ কাঁটা, যদি গো কুসুম দিলে?
ফুটিত না কি কুসুম ও কাঁটা না বিঁধিলে’।

এতক্ষণে হয়ত মানবের যাত্রাপথের দুস্তরতা ও জটিলতা সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়েছে-এখন লালন-গীতি থেকে কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে খতিয়ে দেখা যাক, এই স্বয়ং-শিক্ষিত (বা অশিক্ষিত) ব্যক্তিটার মতি-গতি, ধ্যান-ধারণা কেমন ছিল। তিনি কি জাগ্রত-চিত্ত ব্যক্তি ছিলেন? তাঁর মনে কি বিবিধ বিচিত্র প্রশ্নের উৎপত্তি হয়েছিল? আর হয়ে থাকলে তিনি এসবের কিরুপ সমাধান দিয়ে গেছেন?

পার কর হে দয়ালচাঁদ আমারে,
ক্ষম হে অপরাধ আমার ভাব কারাগারে।

না হলে তোমার কৃপা সাধনসিদ্ধি কে করিতে পারে?
আমি পাপী তাইতে ডাকি, ভক্তি দাও মোর অন্তরে।

পাপী-তাপী জীব তোমার, না যদি কর হে পার,
দয়া প্রকাশ করে,
পতিত-পাবন- পাতক-নাশা বলবে কে আর তোমারে?
জলেস্থলে সব জায়গায় তোমার সব কীর্তিময়,
ত্রিবিধ সংসারে
না বুঝে অবোধ লালন পড়ল বিষম ঘোরতরে।

এখানে দেখা যাচ্ছে,- লালনের সম্পূর্ণ আত্নসমর্পন এক ‘দয়ালচাঁদ’ আল্লার উপরে। লালন জানেন, কোনও মানবের সাধ্য নেই, সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে তার সব কর্তব্য সম্পন্ন করে যাবার, তাই অপরাধী হিসাবে খেদ করছেন, আর আস্তাগফার চাচ্ছেন, গাফুর-উর-রাহীমের কাছে। বলেছেন জানি তুমি কৃপাময়, তবু সাহস পাইনে, আমার পাপ-ভয় তুমি খন্ডন করবে কিনা, আমি ভয়ে অভিভূত। এটা ঠিক ‘মুত্তাকীর’ পরিচয়। নিজেকে অবোধ লালন বলেছেন, কাতর মিনতির সহিত। এইত ভক্তের ভক্তি। কোন নবী আল্লার দরবারে এসে ভয়ে ক্রন্দন করেননি, দোজখের আগুন থেকে রেহাই চাননি? শেষে ঘোরতর শব্দটি ‘ঘোরতর বিপদ’ বুঝাচ্ছে, -মনের আবেগে ব্যাকরণ বদলে গেছে। তবে এটা কোন গুরুতর ভূল নয়, বরং ‘পদ্যের নিস্কৃতি’(Poetical license)।

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে,
লালন কয় জাতের কি রুপ দেখলাম না এ নজরে।

যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কি হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতে প্রমান, বামনী চিনি কিসে রে।

কেউ মালা কেউ তসবী গলায়, তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়?
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়, জেতের চিহ্ন রয় কার রে।

জগৎ বেড়ে জেতের কথা, লোকের গৌরব করে যথাতথা
লালন সে জেতের ফাতা, বিকিয়েছে সাত বাজারে।

অক্ষরজ্ঞানহীন লালনের মুখের এমন ‘অন্তর ন্যাশনাল’ মানবতার বাণী শুনলে বুঝা যায় কি গভীর ঔদার্য বিরাজ করছে ঐ ‘উম্মী’র অন্তরে। এ শক্তির মুল কোথায়?- ধ্যাণে, সাধনায়। এত ঊর্ধ্বে লাখের মধ্যে একজনও উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ। এর গুণ-বিচারি কি আমাদের মত ক্ষুদ্র লোকের পক্ষে শোভা পায়? আল্লাকি সব মানুষকে সমদৃষ্টিতে দেখেন না? হ্যাঁ, দেখেন, কিন্তু তাঁর কাছে যে যোগ্যতার বিচার আছে, তাকি মর্ত্যভূমিতে পাওয়া যায়? থৎনা, পৈতে, টিকি, টুপী, লেংটি, ধূতি ইত্যাদি দিয়ে কি মানুষের ইনছানিয়্যাৎ বা মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতে বন্টিত হয় না?

ফাঁকা বুলি ও জাঁকজমকের ধাপ্পাবাজীতে কি তাঁকে ভূলানো যায়? গানটাকে বেশ চমৎকার রকম করে মুসলমান নরনারী আর হিন্দু বামন-বামনী চিনবার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছে।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।।

আট কুঠরী *নয় দরজা* মধ্যে মধ্যে ঝলকা আঁটা।
তার উপর আছে সদর কোঠা আয়নামহল তায়।।
মন তুই রইলি খাঁচাল আঁশে, খাঁচা যে তেরী কাঁচা বাঁশে
লালন কয় খাঁচা খুলে সে পাখি কোনখানে পালায়।।

অতি সুন্দর গান। এর জিজ্ঞাসা, আমাদের দেহের খাঁচার ভিতরে যে একটা জ্যান্ত পাখী (প্রাণ) রয়েছে, সেটা কোন পথে আসা-যাওয়া করে? আমার ক্ষমতা থাকলে চিরকাল ঐ পাখিটাকে দেহ-পিঞ্জরে থরে রাখতাম। কিন্তু তা’ত হবার নয়। নশ্বর মানুষ, আমি’ত কাঁচা বাঁশের মতো বিকল হয়ে পড়বো। কিন্তু সব দরজায়ই আট-সাঁট করে ঘেরা রয়েছে, ফাঁকগুলোও আয়না দিয়ে মোড়া আছে, তাই তো আশ্চর্য লাগে-‘ঐ প্রাণ-পাখীরা কোন পথ দিয়ে উড়ে যাবে।

লালন শাহ দেহতত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদের গ্রাজ্যুয়েটদের থেকেও অধিক জ্ঞান রাখেন। এই উম্মি লোকের শব্দ-সম্ভারও দেখা যায় প্রচুর। অতএব এঁকে রীতিমত কৃষ্টিবান বলতে হয়।

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
আমার বাড়ীর কাছে আরশীনগর, এক পড়শী বসত করে।।

গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, ও তার নাই কেনারা, নাই তরণী পাড়ে।
মনে বাঞ্ছা করি, দেখব তারি-আমি কেমনে সে গাঁয় যাই রে।
কি কব সেই পড়শীর কথা, ও তার হস্ত-পদ-স্কন্দ-মাথা নাই রে।
ও ক্ষণেক থাকে শূণ্যের উপর আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।।

পড়শী যদি আমায় ছুঁতো, আমার যম যাতনা যেত দূরে।
আবার সে ও লালন একখানে রয়, তবু লক্ষ যোজন ফাক রে।।

এই কবিতার ঈঙ্গিত বোঝা কঠিন মনে হচ্ছে-অতিশয় আচ্ছন্ন করে যেন কোন প্রচ্ছন্ন ভাবের বর্ণনা আছে। ‘তারে’ বলতে ‘পড়শী’কেই বুঝাচ্ছে। কিন্তু সেই পড়শীটি কে? এর উত্তর হতে পারে ‘পীতম পিয়ারী’ কোনও নারী-স্বকীয়া অথবা পরকীয়া। এই অর্থে, রতিক্রিয়া সংসৃষ্ট পানি অতিক্রম না করে মিলন অসম্ভব। তাই মনে নিদারুন পিপাসা থাকলেও, বৈষ্ণব-প্রথা (বা বাউল প্রথা) অনুসারে সামনের ভোগ সামগ্রী ভোগ বা ভক্ষণ করা সাধকের পক্ষে অবৈধ, আত্নসংযম করে রিপু দমন করতেই হবে। আবার রমনী লালনের কাছেই আছে, হয়ত লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে এমনভাবে রয়েছে যে তার ‘হাত-পা-স্কন্ধ-মাথা’ কিছুই দেখা যায় না; আর বিপুল আকাঙক্ষা থাকলেও রমণীর একটা স্পর্শও পাওয়া যায় না। সে পাওয়া কি এতই সহজ? সে জানে “রমনীর মনে সহস্র বর্ষেরই, সখা, সাধনার ধন।”হয়ত রমনীর মন পড়ে আছে অন্যত্র, তাইতেই কি লালন একটু স্পর্শও লাভ করতে পারছে না। প্রিয়তমা কাছে থেকেও যেন সহস্র যোজন (৪০০০ ক্রোশ বা ৮০০০ মাইল) দূরে অবস্থান করছে, একি সামান্য দুঃখের কথা। আর পূর্বোক্ত প্রশ্নের আর একটি জওয়াব হচ্ছে, পড়শীটি হচ্ছে বিশ্ব-বিধাতা। তিনি তো দূরে অবস্থান করেন না, বরং প্রত্যেকের শাহ রগের চেয়েও কাছে তিনি রয়েছেন।

কোরআনের ভাষায় ‘আকরামু মিন হাব্লিল ওয়ারীদ।’ ‘তার হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা’ কিছুই নাই। এখানে আরশীনগর বোধ হয় খোদার আরশকেই বুঝাচ্ছে। সে গাঁয়ে যেতে হলে সচরাচর মালিকুল-মৌত এর দরজা দিয়েই যেতে হয়। কিন্তু কোনক্রমে সেখানে গিয়ে পড়তে পারলে আর দ্বিতীয়বার যম যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না। তিনি থাকেন অতি উর্দ্ধ আরশের উপর। ‘আবার ক্ষণেক থাকে নীরে’ কথাটা রহস্যজনক। আল্লার কিতাবে আছে, আবার বিজ্ঞানেও বলে-পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়েছে পানি, তারপর পানির উপরে ফেনা, তারপর জলচর প্রাণী, তারপর মৃত্তিকা, তারপর জলচর ও স্থলচর প্রাণী, ঘাসপাতা, পাহাড় ইত্যাদি তারপর মানুষ। হয়তো এই বিভিন্ন যুগের আভাস দেবার জন্যই ‘ক্ষণেক ভাসে নীরে’ পদগুলো লিখিত আছে। অবশ্য সৃষ্টির সমুদয় রহস্য এখনও জানা সম্ভব হয়নি। সাধকেরা হয়তো দিব্যচক্ষে সময় সময় কিছুটা ঈঙ্গিত বা ইসারা পেয়েছেন। এ সব ইসারাও আদৌ ফেলে দেবার মত নয়।

প্রথমোক্ত ‘রসকেলি’ অর্থের অপব্যবহারের দরুন বহুসংখ্যক দূর্বল-হৃদয় যোগীসাধকের অধঃপতন হয়েছে। অবশ্য ভালো হাতিয়ার দিয়েই সু ও কু উভয় কর্মই সম্পন্ন হতে পারে। তাই সাধু-সজ্জনকে অতি সতর্কতার সহিত ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। এ পিচ্ছিল পথ অবশ্যই বিগদসঙ্কুল। তবুও মানবিক দূর্বলতার কথাও স্মরণ রাখতে হয়। স্থলন মানুষের হয়, আবার তা আয়ুস্কালের মধ্যেও শুধরে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। ইসলামেও একপ্রতার ‘মুতাহ’ প্রথা আছে, সেটা অনেকটা অর্ধ বিবাহের মতো বা অস্থায়ী বিবাহের মতো। একথাটা উল্লেখ করলাম ব্যাকোরণে যে, দুর্বল যোগী ঋষি সাধকের অনৈতিক আচরণ দেখে হিন্দু, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, শাক্ত, শিয়া, সুন্নী, মুজাদ্দদিয়া, নকশবন্দিয়া প্রভূতি দলীয় অনুষ্ঠানের মূল আদর্শের প্রতি অনেকেই পরস্পর পরস্পরের আদর্শের প্রতি কটাক্ষ করে থাকেন। সব সমাজেই নব রকমের দূর্বল লোক থাকেন, আবার আদর্শ লোকও আছেন। আদর্শের সীমা লঙ্ঘন করলেই পোলমাল হয়, প্রকৃত সাধু সজ্জনেরা অনায়াসে বিপদ কাটায়ে বেড়িয়ে যান, দূর্বলেরাই পানি ঘোলা করে অনর্থ ঘটিয়ে থাকেন। বিধাতা-পুরুষ বোধ হয়, এইসব লীলা দেখে কৌতুক বোধ করেন। এসব হয়তো বিধাতারই প্রকাশিত লীলা-নইলে তিনি শয়তানকে এতটা আস্কারা দেবেন কেন? আবার সেই ভালমন্দ চিনে নেবার রহস্য।

ও মন, যে যা বোঝে নেইরুপ সে হয়।
সে যে রাম রাহিম, করিম কালা এক আল্লা জগৎময়।।

‘কুল্লো সাইয়েন’ সহিত খোদা, আপন যবানে কয় সে কথা
যার নাই রে আচার বিচার বেদ গড়িয়ে গোল বাধায়।।

আকার সাকার নিরাকার হয়, একেতে অনন্ত উদয়
নির্জন ঘরে রুপ নেহারে এক বিনে কি দেখা যায়।।

এক নেহারে দেও মন আমার, ভজ নারে দেখ তায়
লালন বলে একরুপ খেলে ঘটে পটে সব জায়গায়।।

এই গানটার ভাব অতি পরিস্কার, সন্দেহের লেশমাত্র নেই। এই লোক হিন্দু না মুসলিম, এ প্রশ্ন বৃথা। আল্লা ছাড়া কেই কারো মনের নাগাল পায় না। তিনি বলেছেন, ‘আকার সাকার নিরাকার হয়, একেতে অনন্ত উদয়”। সত্যি তো একের মধ্যে বহুর বাস, যার যেমন দৃষ্টি সে তেমনভাবে দেখে। এধরনের আর একটা গানের (শ্রীরামদুলাল রচিত) খানিকটা উদ্ধৃতি দেই :

জেনেছি জেনেছি তারা, তুমি জান ভোজের বাজি
যে তোমায় যেভাবে ডাকে তাতে তুমি হও মা রাজি।।

মগে বলে ফরা-তারা, গড বলে ফিরিঙ্গি যারা মা
খোদা বলে ডাকে তোমায়, মোগল পাঠান সৈয়দ কাজি।।

শ্রীরামদুলাল বলে, রাজী নয় এ জেনো ভবে
এক ব্রহ্মে দ্বিধা ভেবে মন আমার হয়েছে পাজি।।
কে বোঝে মন মওলার আলেক বাজী
করছে রে কোরানের মানে যা আসে তার মনের বুঝি।।

(সবে) একই কোরান পড়াশুনা; কেউ মৌলভী কেউ মৌলানা,
দাহিরে রয় কত জনা, সে মানে না শরার কাজী।।

রোজ কেয়ামত বলে সবায়, কেউ করে না তারিখ নির্ণয়,
হিসাব হবে রে কি হচ্ছে সদায়, কোন কথায় মন রাখি রাজী।।

মলে জান ইল্লীন-সিজ্জীনে রয়, যতদিন রোজ হিসাব না হয়?
কেউ বলে জান ফিরে জন্মায়, তবে ইল্লিন-সিজ্জীন কোথায় আজি?
এ’রাফ বিধান শুনিতে পাই, এক গোরো মানুষের মৌত নাই
সে আমার কোন ভাইরে ভাই, বলছে লালন কারে পুছি?

এই গানটাকে মৌলানা-মৌলভীদের কারসাজীতে কোরআনের একই লিখনের বিভিন্ন মানে বা অর্থের সৃষ্টি হয়ে নানা অনর্থের সৃষ্টি করেছে, আবার ঐ কোরান পড়েই কেউ বা ‘দহ রিয়া’ হয়ে পড়েছে, অর্থ্যাৎ জড় পৃথিবীটাকেই বা আল্লার বিধান সৃষ্টিকেই, আল্লা বলে মনে করে; আর কাজীর প্রদত্ত ফতোয়া বা সিদ্ধান্ত মানে না। লালন বলেন, সবার মুখে শুনি রোজ কেয়ামত এসে পড়লো বলে, আখেরী জামানা এসে পড়েছে, অথচ কেউ তারিখ নির্ণয় করে না, হিসাব করে একটা নির্দিষ্ট অভিমত দেয়না-এমন হলে কোনটা বিশ্বাস করি? একজনের কাছে শুনি, মৃত্যু এলে প্রাণটা ইল্লীন-সিজ্জীন নামক দুইটি মোকামে রক্ষিত হয়-রোজ কেয়ামতের বিচারের অপেক্ষায়। আবার কেউ বলেছেন মরা প্রাণটাই আবার জ্যান্ত হয়, তাহলে ইল্লিন-সিজ্জীন কোখায় গেল! আবার শুনি বেহেশত ও দোজখের মধ্যবর্তী কোনও একটি উচ্চস্থানে এক বৃহৎ-অপেক্ষা-গৃহ আছে, তার নাম এ’রাফ; এদের নাকি, কর্মগুনে বেহেশত ও দোজখে যাওয়ার প্রায় সমান সম্ভাবনা, তাই এদের বিচার খানিকক্ষণ মুলতবি আছে-খানিক পরেই এদেরকে যথাস্থানে প্রেরণ করবেন। কাউকে বেহেশতে আবার কাউকে দোজখে। এ’রাফের লোকেরা নাকি বেহেশতের দিকে তাকিয়ে উঁচু থেকে চেনা লোক দেখতে পেলে তাদেরকে ডেকে ডেকে সালাম করে সন্তোষ প্রকাশ করবেন, যাতে আল্লাহ পাক বেহেশতীদের উসিলায় একটু সদয় হয়ে বেহেশতে আশ্রয় দেন। মৌলভী-মওলানারা এ’রাফ সম্বন্ধেই অন্ততঃ আরও দুই প্রকার গল্প ফেদেছেন। যাহোক এসব শুনে লালন বলেন, এতসব বিভ্রান্তিকর কথা শুনে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো হয়-জানিনা এই গোত্রের বা দলে আমারই তো অমর ভাইয়েরা আছে, তবে এসব কথা কাকে শুধাই? বস্তুত কোরান শরীফের শব্দ ও ভাবরাশিকে বিকৃতি করে এক জগাখিঁচুড়ির সৃষ্টি করা হয়েছে-তাই তিনি এইসব আলেমকে বিশ্বাস করতে ইতঃস্তত করছেন।

বিদ্বজনের গবেষণার ফলে জানা যায়-লালন শাহ’র জন্ম হয় হিন্দুর ঘরে ইংরেজী ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দে আর মৃত্যু হয় ১৮৯০ সালের ১৭ ই অক্টোবর, শুক্রবারে। তাঁর আদি বাসস্থান চাপড়ার জোড়া-গ্রাম ভাঁড়ালায়। এঁর পিতার নাম মাধবকর, নানার নাম ভস্মদাস, মায়ের কাছে পদ্মাবতী আর এঁর নিজের নাম ছিল লালন কর। তিনি ভাঁড়ারায় যে পাড়ায় বাস করতেন সে পাড়াটির নাম ছিল দাসপাড়া (এখনও সেই একই নাম আছে)। পরে লালন ঘটনাক্রমে মুসলমান গৃহে আশ্রয় ও স্নেহপ্রীতি পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনের ৭ ভাগের মধ্যে ৬ ভ্গাই সেই মুসলিম সমাজের মধ্যে বসবাস করে গেছেন। জীবনের শৈশব ও কৈশরকালে ১৭/১৮ বৎসরকাল যাবত হিন্দু সমাজের ধ্যান-ধারণা, আচার-ব্যাবহার, কিংবদন্তি, পৌরনিক কাহিনী ইত্যাদির আওতাতেই ছিলেন। সুতরাং হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় সম্বন্ধেই সঙ্গীত রচনা করা তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

নিম্নের কবিতাটি অবধান করুন :

শহরে ষোলজন বোম্বেটে,
করিয়ে পাগলপারা নিল তারা সব লুটে।।

রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি, চোরেরও সে শিরোমণি,
নালিশ করব আমি কোনখানে, কার নিকটে।।

পাঁচজনা ধনী ছিল, তারা সব ফতুর হলো
কারবারে ভঙ্গ দিল কখন যেন যায় উঠে।।

গেল ধনমান আমার, খালিঘর দেখি জমার,
লালন কয়, খাজনারো দায়, কখন যেন যায় লাটে।।

অর্থ : শহরে (দেহের মধ্যে) ষোলজন দুই অবস্থান করছে-তারা হলো দশ ইন্দ্রিয় (২ চক্ষু, ২ নাসারন্ধ্র, ২ কর্ণ, ১ মুখ, ১ নাভি, ১ মূত্রদ্বার, ১ মলদ্বার), আর ছয় রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য):

দশ ইন্দ্রিয়ের দশজন দ্বারী, কর্ণ গুণ ধরে জোর চালায়
অকূল ভব-সাগর-বারি পার হবে কে আয় রে আয়।। (প্রাচীন সঙ্গীত)

অপর মতে, পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় (হাত,পা, কন্ঠস্বর, জননেন্দ্রিয়, মল নিস্কাশনেন্দ্রিয়), পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, নাসিকা, কর্ণ, জিহবা, ত্বক) এবং ছয়টি রিপু-এই ষোল জন বোম্বেটে। মানুষের দেহের মধ্যে এই ষোলজন কদাচারী গৃহশত্রু রয়েছে।

আর যিনি রাজ-রাজেশ্বর তিনিই বা কম কি? সেই আত্না বা পরমপুরুষ লুকিয়ে থাকেন, দেখা যায় না-অদৃশ্য থেকে মানুষের ক্রিয়াকর্ম দেখে রগড় করেন। আবার দেহের মধ্যেই পাঁচজন ধনী ছিল (বিবেক, জ্ঞান, সংযম, বৈরাগ্য ও ভক্তি)। এর ইন্দ্রিয় ও রিপুর সঙ্গে সংগ্রামে পরাজিত হয়ে তারাও রণে ভঙ্গ দিয়ে এখন গতায়ুপ্রায়। লালন মানুষটি যেন বিব্রত হয়ে পড়েছে, তার মান বজায় রাখা হয়েছে দায়। আবার পরমেশ্বরের কাছে হিসাব-নিকাশের বেলায়ও দেখা যাচ্ছে ব্যায়ের কোঠা ভরতি, আয়ের কোঠা শূণ্য। তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি-জীবন, পালন, স্বাস্থ্য, সম্পদ, পিতামাতা, স্ত্রীধন, বন্ধু-বান্ধব প্রীতি, প্রশংসা ইত্যাদি, তার জন্য কৃতজ্ঞতার খাজনাটাও দেওয়া হয়নি। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এলো, কাজের কাজ একটুও হয়নি, লালনের সব সম্পত্তি লাটে উঠেছে; এখন লালন করবে কি?

এর মধ্যে তো দোষ ধরার মতো কিছু দেখছি না। জীবন রহস্যের সব কথা ঠিকমত বোঝা যায় না; আবার চেষ্টা করলে, অনায়াসেই ভূল বোঝা যায়। জীবনের অনেক গুপ্তরহস্য আমার বুদ্ধির অতীত, অতএব সে সম্বন্ধে বিশেষ করে উচ্চাঙ্গের সাধনভজনের বা ভক্তিযোগের বিষয়ে মন্তব্য প্রকাশ করা আমার পক্ষ্যে ধৃষ্টতা মাত্র। তাই, এখানেই কেচ্ছা খতম করি-আর বিচার দিবসে আমার নিজের এবং ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের সমগ্র মানবসমাজের উপর রাজাধিরাজের সুপ্রসন্ন নজর পড়ুক, সেই আকাঙক্ষা করি।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.