১৫ কার্ত্তিক ১২৯৭/ ৩১ অক্টোবর ১৮৯০
লালন ফকীরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকী নাই। শুধু এ অঞ্চলে কেন, পূর্বে চট্রগ্রাম, উত্তরে রংপুর, দক্ষিণে যশোর এবং পশ্চিমে অনেকদূর পযন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহু সংখ্যক লোক এই লালন ফকীরের শিষ্য। শুনিতে পাই ইহার শিষ্য দশ হাজারের উপর। ইহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি।
কুষ্টিয়ার অনতিদূরে কালীগঙ্গার ধারে ছেউড়িয়া গ্রামে ইহার একটি সুন্দর আখড়া আছে। আখড়ায় ১৫/১৬ জনের অধিক শিষ্য নাই। শিষ্যদিগের মধ্যে শিতল ও ভোলাই নামক দুইজনকে ইনি ঔরসজাত পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেন। অন্যান্য শিষ্যগণকে তিনি কম ভালোবাসিতেন না। শিষ্যদিগের মধ্যে তাহাঁর ভালবাসার কোন বিশেষ তারতম্য থাকা সহজে প্রতীয়মান হইত না। আখড়ায় ইনি সস্ত্রীক বাস করিতেন। সম্প্রদায়ের ধর্ম মতানুসারে ইহার কোন সন্তান-সন্ততি হয় নাই। শিষ্যগনের মধ্যেও অনেকের স্ত্রী আছে, কিন্তু সন্তান হয় নাই। এই আচার্য ব্যাপার শুধু এই মহাত্নার শিষ্যগনের মধ্যে নহে বাউল-সম্প্রদায়ের অধিকাংশ স্থানে এই ব্যাপার লক্ষিত হয়।
সম্প্রতি সাধুসেবা বলিয়া এই মতের এই নতুন সম্প্রদায় সৃষ্ট হইয়াছে। সাধুসেবা ও বাউলের দলে যে কলঙ্ক দেখিতে পাই, লালনের সম্প্রদায়ে সে প্রকার কিছু নাই। আমরা বিশ্বস্তসুত্রে জানিয়াছি সাধু সেবায় অনেক দুষ্ট লোক যোগ দিয়া কেবল স্ত্রীলোকদিগের সহিত কুৎসিত কাজে লিপ্ত হয় এবং তাহাই তাহাদের উদ্দেশ্য বলিয়া বোধ হয়। মতে মূলে তাহাঁর সহিত ঐক্য থাকিলে এ সম্প্রদায়ের তাদৃশ ব্যভিচার নাই। পরদার ইহাদের পক্ষে মহাপাপ। তবে প্রত্যেক সৎনিয়মের ন্যায় ইহারও অপব্যবহার থাকা অসম্ভব নহে। বাউল, সাধুসেবা ও লালনের মতে এবং বৈঞ্জব সম্প্রদায়ের কোন শ্রেণীতে যে একটি শুহ্য ব্যাপার চলিয়া আসিতেছে লালনের দলে তাহাই প্রচলিত থাকায় ইহাদের মধ্যে সন্তান জননের পথ এককালে রুদ্ধ। “শান্ত-রতি” শব্দের বৈঞ্জবশাস্ত্রে যে উৎকৃষ্ট ভাব বুঝায়, ইহারা তাহা না বুঝিয়া অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইন্দ্রিয় সেবায় রত থাকে। এই জঘন্য ব্যাপারে এ দেশ ছারেখারে যাইতেছে, তৎসম্নধে পাঠকবর্গকে বেশী কিছু জানাইতে স্পৃহা নাই।
শিষ্যদিগের ও তাহাঁর সম্প্রদায়ের এই মত ধরিয়া লালন ফকীরের বিচার হইতে পারে না। তিনি এ সকল নীচ কায্য হইতে দূরে ছিলেন ও ধর্ম-জীবনে বিলক্ষণ উন্নত ছিলেন বলিয়া বোধ হয়। মিথ্যা জুয়াচুরিকে লালন ফকীর বড়ই ঘৃণা করিতেন। নিজে লেখাপড়া জানিতেন না। কিন্তু তাঁহার রচিত অসংখ্য গান শুনিলে তাহাঁকে পরম পণ্ডিত বলিয়া বোধ হইত। তিনি কোন শাস্ত্রই পড়েন নাই। কিন্তু ধর্মালাপে তাহাঁকে বিলক্ষণ শাস্ত্রবিদ বলিয়া বোধ হইত। বাস্তবিক ধর্মসাধনে তাঁহার অন্তদৃষ্টি খুলিয়া যাওায়ায় ধর্মের সারতত্ত্ব তাঁহার জানিবার অবশিষ্ট ছিল না। লালন নিজে কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না। অথচ সকল ধর্মের লোকেই তাহাঁকে আপন বলিয়া জানিত। মুসলমানদিগের সহিত তাঁহার আহার-ব্যবহার থাকায় অনেকে মুসলমান মনে করিত। বৈঞ্জবধর্মের মত পোষণ করিতে দেখিয়া হিন্দুরা ইহাকে বৈঞ্জব ঠাওরাইত মনে করিতেন। জাতিভেদ মানিতেন না, নিরাকার পরমেশ্বরে বিশ্বাস দেখিয়া ব্রাহ্মদিগের মনে ব্রাহ্মধর্মালম্বি বলিয়া ভ্রম হওয়া আশ্চয্য নহে।
কিন্তু ইহাকে ব্রাহ্ম বলিবার উপায় নাই। ইনি বড় গুরুবাদ পোষণ করিতেন। অধিক কি ইহার শিষ্যগন ইহার উপাসনা ব্যতীত আর কাহারও উপাসনা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিতেন না। সর্বদা “সাঞ” এই কথা তাহাঁদের মুখে শুনিতে পাওয়া যায়। ইনি নামাজ করিতেন না। সুতারাং মুসলমান কি প্রকারে বলা যায় ? তবে জাতিভেদবিহীন অভিনব বৈঞ্জব বলা যাইতে পারে। বৈঞ্জবধর্মের দিকে ইহার অধিক টান। শ্রীকৃষ্ণের অবতার বিশ্বাস করিতেন। কিন্তু সময় সময় যে উচ্চ-সাধনের কথা ইহার মুখে শুনা যাইত, তাহাঁতে তাঁহার মত ও সাধন সন্মন্ধে অনেক সন্দেহ উপস্থিত হইত। যাহা হউক তিনি একজন পরম ধার্মিক ও সাধু ছিলেন, তৎসন্মন্ধে কাহারও মতদ্বৈত নাই। লালন ফকীর নাম শুনিয়াই হয়ত অনেকে মনে করিতে পারেন ইনি বিষয়হীন ফকীর ছিলেন। বস্তুতঃ তাহা নহে; ইনি সংসারী ছিলেন; সামান্য জোতজমা আছে; বাটীঘরও মন্দ নহে। জিনিষপত্রও মধ্যবর্তী গেরেস্থর মত। নগত টাকা প্রায় ২ হাজার বলিয়া মরিয়া যান।
ইহার সম্পত্তির কতক তাঁহার স্ত্রী, কতক ধর্মকন্যা, কতক শীতলকে ও কতক সৎকাজে প্রয়োগের জন্য ইনি একখানি ফরমমাত্র করিয়া গিয়াছেন। ইনি নিজে শেষকালে কিছু উপায় করিতে পারিতেন না। শিষ্যরাই ইহাকে যথেষ্ট সাহায্য করিত। বছর অন্তে শীতকালে একটি ভাঙ্গারা (মহোৎসব) দিতেন। তাহাঁতে সহস্রাধিক শিষ্যগণ ও সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হইয়া সংগীত ও আলোচনা হইত। তাহাঁতে তাঁহার ৫/৬ শত ব্যয় হইত।
ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছুই বলিতেন না। শিষ্যরা হয়ত তাঁহার নিষেধক্রমে না হয় অজ্ঞাতবশতঃ কিছুই বলিতে পারে না। তবে সাধারণে প্রকাশ লালন ফকীর জাতিতে কায়স্থ ছিলেন। কুষ্টিয়ার অধীনে চাপড়া ভৌমিক বংশীয়েরা ইহার জাতি। ইহার কোন আত্মীয় জীবিত নাই। ইনি নাকি তীর্থগমনকালে পথে বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়া সঙ্গীগণ কতৃক পরিত্যক্ত হয়েন। মুমুষু অবস্তায় একটি মুসলমানের দয়া ও আশ্রয়ে জীবনলাভ করিয়া ফকীর হয়েন। ইহার মুখে বসন্তরোগের দাগ বিদ্যমান ছিল।
ইনি ১১৬ বৎসর বয়সে গত ১৭ই অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে মানবলীলা সম্বরণ করিয়াছেন। এই বয়সেও তিনি অশ্বারোহণ করিতে দক্ষ ছিলেন এবং অশ্বারোহণও স্থানে স্থানে যাইতেন। মৃতর প্রায় একমাস পূর্ব হইতে ইহার পেটের ব্যারাম হয় ও হাত পায়ের গ্রন্থি জলস্ফিত হয়। দুধ ভিন্ন পীড়িত অবস্থায় অন্য কিছু খাইতেন না। মাছ খাইতে চাহিতেন। পীড়িতকালেও পরমেশ্বরের নাম পূব্ববৎ সাধন করিতেন; মধ্যে মধ্যে গানে উম্মত্ত হইতেন। ধর্মের আলাপ পাইলে নববলে বলীয়ান হইয়া রোগের যাতনা ভুলিয়া যাইতেন। এই সময়ের রচিত কয়েকটি গান আমাদের নিকটে আছে। অনেক সম্প্রদায়ের লোক ইহার সহিত ধর্ম আলাপ করিয়া তৃপ্ত হইতেন।
মরণের পূর্ব রাত্রি প্রায় সমন্ত সময় গান করিয়া রাত্রি পাঁচটার সময় শিষ্যগণকে বলেন “আমি চলিলাম”। ইহার কিয়ৎকাল পরে শ্বাসরোধ হয়। মৃত্যুকালে কোনো সম্প্রদায়ী মতানুসারে তাঁহার অন্তিমকায্য সম্পন্ন হওয়া তাঁহার অভিপ্রায় ও উপদেশ ছিল না। তজ্জন্য মোল্লা বা পুরোহিত কিছুই লাগে নাই। গঙ্গাজল হরে নাম নামও দরকার (হয়) নাই। হরিনাম কীর্তন হইয়াছিল। তাঁহারই উপদেশ অনুসারে আখড়ায় মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তাঁহার সমাধি হইয়াছিল। শ্রাদ্ধাদি কিছুই হইবে না।
বাউল সম্প্রদায় লইয়া মহোৎসব হইবে, তাঁহার জন্য শিষ্যমন্ডলী অর্থ সংগ্রহ করিতেন। শিষ্যদিগের মধ্যে শীতল, মহরম সা, মানিক সা ও কুধু সা প্রভৃতি কয়েকজন ভাল লোক আছেন। ভরসা করি, ইহাদের দ্বারা তাহাঁদের গৌরব নষ্ট হইবে না, লালন ফকীরের অসংখ্য গান সর্বত্র সর্বদায় গীত হইয়া থাকে। তাহাঁতেই তাঁহার নাম, ধর্ম, মত ও বিশ্বাস সুপ্রচারিত হইবে। তাঁহার রচিত একটি গান নিম্নে উদ্ধত করা গেলঃ-
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন ভাবে জাতের কিরূপ দেখলাম না এই নজরে।।
কেউ মালায় কেউ তছবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়
জাতের চিনহ রয় কার রে।।
যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারীর তবে কি হয় বিঁধান,
বামণ চিনি পৈতা প্রমাণ,
বামণি ছিনি কিসে রে।।
জগৎ বেড়ে জেতের কথা,
লোকে গৌরব করে যথাতথা,
লালন সে জেতের ফাতা
ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে।।