কুষ্টিয়া শহরের অদূরে ছেউড়িয়া একটি ছায়াঘেরা নিবিড় গ্রাম। একপাশে গড়াই অন্যপাশে কালীগঙ্গা দু’টি বহমান নদী। আজ থেকে প্রায় দুইশত সতের বছর আগের একদিন ভোরবেলা ষোল সতের বছরের অচেতন লালন ভাসতে ভাসতে কালীগঙ্গা নদীর তীরে এসে ভিড়ল। ছেউড়িয়া গ্রামের মওলানা মলম কারিকর নামাজি লোক। তাঁর পিতা মুন্সি খায়রুল্লাহ। মুন্সি খায়রুল্লাহর চার পুত্র মলম, আলম, কলম ও তিলম কারিকর।
আলম কারিকর ছাড়া মলমের মতই অপর দুই ভাই কলম ও তিলম নিঃ সন্তান ছিলেন। মলম ছোট বেলাতেই নামায এবং ইসলামী ভাব ধারায় মনযোগী হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি কুষ্টিয়ার একটি প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাই ভর্তি হন এবং সেখান থেকে কুরআনে হাফেজ ও মওলানা পাস করেন।
হাফেজ মলম নিজে সু-শিক্ষিত ছিলেন। বিনয় এবং মার্জিত ব্যাবহারের কারনে সকলে তাঁকে সমান শ্রদ্ধা করতো। তাঁর এই সুনাম ছেউড়িয়া ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আঁশে পাঁশে গ্রামে। মলম বাইশ বয়সে গড়াই নদীর ওপাড়ে কয়া গ্রামের এক তন্তবায়ী ধার্মিক পরিবারের বারো বছরের সু-দরশনা কন্যা মতিজান কে বিবাহ করেন। স্বামীর প্রতি যত্নশীলতা মতি জানের কণ্ঠ ছিল ভারি মিষ্টি। রুচিশীলা এই রমণী সবকিছু গুছিয়ে রাখতেন। মিষ্টি সুরে কোরআন পাঠ করতেন। ভারী সুন্দর তাঁদের ঘরদোর সংসার। এতো কিছুর পরও তাঁদের দুজনের ভিতর ছিল সন্তান হীন এক শূন্যতা। সন্তানের কামনায় পার হয়ে গেল এক যুগেরও বেশী সময়।
সে দিন ভোর বেলা মওলানা মলম ফজরের নামাজ পড়ে কালীগঙ্গা নদীর দিকে হাওয়া খেতে আসলেন, হটাতই দেখতে পেলেন এক অচেনা সংজ্ঞাহীন যুবক অধঃজলমগ্ন অবস্তায় পড়ে আছে, ছেলেটির মুখে ও শরীরে বসন্ত রোগের দাগ বিদ্যমান। তিনি কাছে গিয়ে দেখলেন ছেলেটি বেঁচে আছে, খুব ধীরলয়ে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস। নিঃসন্তান হাফেজ মলমের বুকের ভেতর হু হু করে উঠল, এ কোন অচেনা যুবক নয়; খোদা যেন তাঁর সন্তানকে ভাসিয়ে এনেছেন তাঁর কাছে। মলম তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরলেন এবং তাঁর অপর তিন ভাইকে সাথে নিয়ে আসলেন।
এবার চার ভাইয়ে ধরাধরি করে অচেতন যুবককে নিজের বাড়িতে আনলেন। মলম ও মতিজান দিন রাত পরম যত্নে সেবা করতে লাগলেন। দিনে দিনে অচেনা যুবকটির মুখে জিবনের আলো ফিরে এলো। মতিজান জিজ্ঞাসা করলো – বাবা তোমার নাম কি ?
---- ফকির লালন।