আল্লারদর্গা কথাটি শুনলেই মনের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি জাগে যে, নিশ্চয় আল্লারর্দগায় কোন মাজার বা দরগা আছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আল্লারদর্গাতে এ ধরণের তেমন কোন মাজার বা দরগা নেই। তবে আল্লারদর্গা নাম করণের ইতিহাস রয়েছে চমকপদ ঘটনা। আল্লারদর্গা নামকরণের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে লোক মুখে পাওয়া গেছে, প্রায় আড়াই’শ বছর আগে বৃটিশ শাসন আমলে ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে আসা একটি পরিবার কুষ্টিয়া জেলা দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নে মিরপুর নামক গ্রামে কয়েকটি তালুক নিয়ে বসবাস করতেন। ঐ পরিবারটির কর্তা ছিলেন ছুটি মন্ডল, তাহার ছিল পাঁচটি সন্তান মিলন, আলম, চাঁদ, সুবাদ ও ফতাব মন্ডল।
ঐ ছুটি মন্ডলের পাঁচ সন্তানের মধ্যে আলম মন্ডল ছিলেন খোদাভক্ত দরবেশ প্রকৃতির এবং আধ্যাধিক জগতের মানুষ। ছুটি মন্ডলের ছেলে আলম ঘোলদহ বর্তমান হিসনা নদীর তীরে বর্তমান মসজিদ স্থলে নিরিবিলি পরিবেশে একটি উপাশনালয় গড়ে তুলে ছিলেন। তবে ঘোলদহ নদী থেকে হিসনা নদী নামকরণেও একটি ইতিহাস রয়েছে। ঘোলদহ নদী পদ্মার সাথে সংযুক্ত বলে এ নদীর পানি সব সময় ঘোলা থাকতো বলে নদীটির নাম হয়ত ঘোলদহ বলে পরিচিতি লাভ করেছিল। ১৯৮৫ সালে মরহুম প্রধান মন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোলদহ নদীর নাম পরিবর্তন করে হিসনা নদী নামে ঘোষনা করেন। হিসনা তখন পূর্ণ যৌবনা, অপরূপ ছিল এই নদীটি, হিসনা নদী পদ্মা নদীর শাখা হওয়ার কারণে ছিল ¯্রতম্বিনী, মানুষ সহ মালামাল পরিবহনের জন্য একমাত্র পথ ছিল এই হিসনা নদীটি। সহজে চলার উপায় ছিল নৌকা এবং জল-জাহাজ।
তাইতো ইংরেজরা বেছে নিয়েছিল পদ্মার এই হিসনা নদীটি। এই নদীর কোলে গড়ে উঠে ছিল সোনাইকুন্ডি নামক একটি গ্রামটি। পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সোনাইকুন্ডি গ্রামে হিসনা নদীর তীরে কুঠী নির্মাণ করেন তৎকালীন ইংরেজরা। ঘোলদহ বর্তমান হিসনা নদীর তীরে মসজিদ স্থলে আলম ফকির গড়ে তুলে ছিলেন আরাধনার একটি আশ্রম যা আলম এর দর্গা বলে পরিচিতি লাভ করে। ধীরে ধীরে আলমের দরগার আসে পাশে দোকান পাট বাড়ীঘর বসবাসের যোগ্য এলাকা গড়ে উঠে। তাই এই এলাকার মানুষ এ স্থানের নাম আলমের দর্গা বলেই পরিচয় দিতেন। কয়েক বছরের মধ্যে এলাকার নাম আলমের দর্গা নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। খোদাভক্ত আলম ফকির বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ জগতে আমার বলে কিছু রেখে যাবেন তা কি করে হয় ? মৃত্যুর পর আল্লার কাছে কি জবাব দিবেন, ত্যাগি মহামানব একপর্যায় এলাকাবাসীকে ডেকে বললেন এ জগতে আমার বলে কিছু নেই। তোমরা যে এলাকায় আমার নামে আলমের দর্গা বলে পরিচিত করছে তা হতে পারে না। এ সব সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তালার নামে এলাকার নামকরণ কর। তোমরা এ এলাকার নাম পরিবর্তন করে সকল সৃষ্টির মালিক আল্লাহর নামে করে দাও। এ দরগা ও তারই দয়ার ফসল, এ জন্য এলাকার নাম আল্লারদর্গা হওয়া উচিৎ। ফকিরের কথা মোতাবেক এলাকার নাম আল্লারদর্গা হিসেবে আজও পরিচিতি হয়ে আছে। আল্লাহ ভক্ত আধ্যাধিক জ্ঞানের অধিকারী আলম ফকির জীবনী বিশ্লেশন করে পাওয়া গেছে অনেক অলৌকিক ঘটনা।
আলম ফকিরের দরগা পাশে ঘটে যাওয়া এক মামলার স্বাক্ষী ছিলেন আলম ফকির। স্বাক্ষী দিতে গিয়ে ছিলেন তৎকালিন সময়ে ভারতের কৃষ্ণনগর কোটে। সেখানে স্বাক্ষী দিতে দেরী দেখে তিনি বিচারকের কাছে দেখা করে বলে ছিলেন আমার স্বাক্ষী নিতে হলে দুপুরের আগেই নিতে হবে। বিচারক কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন দুপুরের পর এ জগতে আমি আর থাকবো না। কৌতুহলী বিচারক ফকিরের কথা বিশ্বাস না করে বরং দ্বিগুন কৌতুহলী হয়ে দুপুরের আগে স্বাক্ষী গ্রহণ করার ইচ্ছা থাকলেও ফকিরের কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য দুপুরের পর স্বাক্ষী নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আলম ফকির সত্যি কৃষ্ণনগর কোটের বারান্দায় দুপুর বেলা (প্রাণ ত্যাগ) ইন্তেকাল করেছিলেন। আধ্যাতিক জ্ঞানের অধিকারী সাধক আলমের লাশ কৃষ্ণনগর থেকে এনে গাংনি থানার হাড়াভাঙ্গা মোল্লা পাড়া গ্রামে তার চাচার ভিটায় পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়, এখানে দাফনের ঘটনা এলাকাবাসির মূখে মূখে প্রচলিত আছে। মুরুব্বিরা জানায় গরুর গাড়ীতে করে সাধক আলমের লাশ হাড়া ভাঙ্গা গ্রামে আসার পর আর সামনের দিকে যায়না, জোর করে নিয়ে আসার চেষ্টা করলে লাশের পচা গন্ধে কেহ কাছে থাকতে পারেনা, আবার গ্রামের দিকে গাড়ী ঘোরালে সুমিষ্ট গন্ধ বের হতে থাকে, এ কারনে তৎকালিন সময়ের ইছামতি নদীর উত্তরে তাঁর লাশ দাফন করা হয়েছিল। এখন নদী না থাকলেও এত যুগ পর তার সমাধির চিহ্ন ইছামতির নদীর পাড়ের স্মৃতি বহন করছে গ্রামবাসী, আজও তার কবর খানা সংরক্ষিত আছে। সাধক আলম ফকিরের মৃত্যুর পরও বেশ কিছু আলৌকিক ঘটনার কথা শোনা যায়।
এক ঘোষ আলম ফকিরের কাছে ঘোল খাওয়া বাবদ ৩ টাকা পাওনা ছিল, হঠাৎ ভেড়ামারা উপজেলার হাওয়া খালি নামক স্থানে ফকিরের সাথে ঘোষের সাক্ষাৎ হয়। ঘোষ তার পাওনা টাকার জন্য বললে আলম ফকির জানান তার বাড়ীতে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে কোরআন শরীফের অমুক পাতায় টাকা আছে সে যেন দিয়ে দেয়। ঘোষ জানতো না আলম ফকির মারা গেছেন, আলম ফকিরের কথামত ঘোষ তার বাড়ীতে গিয়ে ফকিরের স্ত্রীর কাছে এ কথা বললে বাড়ীর সবাই অবাক হয়ে যায় এবং ঘোষের কথা যাচাই করার জন্য বাড়ির সবাই কোরআন শরীফের মধ্যে ঠিক ঐ পাতায় টাকা দেখতে পায়। আলম ফকিরের নিষেধ ছিল ঘোষ যেন না বলে তার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে ছিল, বললে ঘোষের ক্ষতি হবে। বাড়ীর লোকজনের চাপের মুখে ঘোষ এক পর্যায়ে বলে দেয় আলম ফকিরের সাথে তার স্বাক্ষাৎ হয়ে ছিল। ফকিরের কথা রক্ষা করতে না পারায় ঐ দিন ঘোষ চরম অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কিছুদিন পর মারা যায়। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে আলম ফকিরের প্রতি চরম বিশ্বাস জন্ম নেয় এবং তার দরগা স্থলে নানা রকম উপকরণ মানত করা শুরু করে।
আলম ফকিরের জীবদ্দশায় বেশ কিছু ঘটনার কথা লোকমুখে শোনাগেছে, তার অনেক গুলি গরু ছিল, কেহ চাষ কাজের জন্য চাইলে জেনে নিতেন কতটুকু জমি চাষ হবে, চাষীর ঠিক ঐ পরিমাণ জমি চাষ হলেই গরু আর হাটত না, আবার গাভী গরুর দুধ কেহ চাইলে কতটুকু দুধ তার দরকার জেনে নিতেন, ঠিক সেই পরিমাণ দুধ দহন হলেই গাভী গরু দুধ দেওয়া বন্ধ হয়ে যেত। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান শাসনামলে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে দরগা স্থলে একটি টিনের ছাউনি দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মসজিদটির নামকরণ করা হয় আল্লারদর্গা জামে মসজিদ এই মসজিদ এবং এলাকাটি আলম ফকিরের দরগার স্মৃতি বহন করে চলেছে। এমনি ভাবে ছোট খাট অনেক অলৌকিক ঘটনা এখানকার মানুষকে বিষ্মত করে তোলে। তাই দুর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছাগল, মোরগ এনে হাজির হয় মানত আছে বলে। তাদের কাছে শোনাগেছে অবাক হওয়ার মত অনেক কথা। তাই এই নামের বরকতে স্থানটির মর্যাদা যুগ যুগ ধরে অম্লান হয়ে আছে। এখনো শোনা যায় অলৌকিক ঘটনার অনেক কথা, তাইতো এখানে মানত করে রোগ মুক্তি পেতে চায় অনেক মানুষ।
খন্দকার মোঃ জালাল উদ্দীন
আল্লারদর্গা,দৌলতপুর,কুষ্টিয়া।
তথ্য সুত্রঃ দ্যা কুষ্টিয়া রিপোর্ট টুয়েন্টি ফোর ডট কম।