বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

খোকসার কালীর ইতিহাস - সৌজন্যে শ্রী রবীন্দ্র নাথ বিশ্বাস
খোকসার কালীর ইতিহাস - সৌজন্যে শ্রী রবীন্দ্র নাথ বিশ্বাস

কোন সুদুর অতীতে খোকসা এবং খোকসার কালী জন্মলাভ করেছিলো এবং একে অপরকে পরিচিত করতে করতে একদিন অভিন্ন হয়ে উঠেছিলো তা আজ নিরুপন করা সম্ভব নয়। তবে এ তথ্যানুসন্ধানে মানব-মনীষা যতদুর এগিয়েছে, তার থেকে খোকসা থানা এবং এই কালী পূজার একটা মোটামুটি ধারনা লাভ করা যেতে পারে। দীর্ঘদিন থেকেই খোকসা ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক থানা। বিবিধ সাংস্কৃতিক প্রবাহ বহুবার এই থানার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। ফলে খোকসা থানা বর্তমানে সভ্যতা ও সাংস্কৃতির চর্চার একটি পীঠস্থান।

খোকসার কালীর এ যাবৎ কোন ইতিহাস পাওয়া যায়নি। কোন গ্রন্থের বা কোন বৃদ্ধের পিত-পিতামহ-শ্রুত ইতিহাসও প্রচলিত নেই। যা আছে তা ইতিহাস নয় – কিংবদন্তী। ইতিহাসের আলো যেখানে অপ্রাপ্য সেখানে কিংবদন্তীর অন্ধকারেই পথ চলতে হয়। দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে খোকসার এবং খোকসার কালীর যে কিংবদন্তী পাওয়া গিয়েছে তা খোকসার পরিচয় অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে।

খোকসার কালী সম্পর্কে যেসব আরো কিংবদন্তী ও লোক বিশ্বাস প্রচলিত আছে, তার থেকে এখানে কিছু আলোচনা করা যাক। খোকসার কালীর বর্তমান পূজারী শ্রী নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ( দুলাল ঠাকুর ) ষোড়শ উর্দ্ধস্তন পুরুষ। রামদেব তর্কালংকার প্রথম এই পূজা আরম্ভ করেন। তিন পুরুষে ১০০ বছর ( বাংলা সাহিত্যের হিসাব অনুসারে ) হিসাবে এই পূজার বয়স প্রায় ৫০০ বছর।

রামদেবরা দুই ভাই। রামদেব তর্কালংকার ও মহাদেব বাচস্পতি। কালক্রমে এরা দুই ভাই-ই নলডাঙ্গা রাজার কালী পূজা করতেন। মহাদেব বাচস্পতি তৃতীয় অধঃতন পুরুষ বানী সিদ্ধান্ত ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত। তৎকালীন কাশীর স্বনামখ্যত বৃদ্ধ পন্ডিত রামধন বাচস্পতির সাথে একবার মাসাধিককাল ধরে বানী সিদ্ধান্তের শাস্ত্র বিষয়ে তর্ক হয়। বাণী সিদ্ধান্ত ছিলেন তখন যুবক। দীর্ঘদিন ধরে তর্ক যুদ্ধে কেউ কাউকে পরাস্ত করতে না পেরে বানী সিদ্ধান্ত উত্তেজিত হয়ে রামধন বাচস্পতিকে ব্যাক্তিগতভাবে ব্যঙ্গোক্তি করেন। ফলে, রামধন বাচস্পতি ক্রোধান্ধ হয়ে অভিসম্পাৎ দেয় যে, বাণী সিদ্ধান্তের বংশে যে পন্ডিত হবে, সেই মারা যাবে। এই অভিসম্পাৎ দারুনভাবে ফলে যায়। বাণী সিদ্ধান্ত কাশী থেকে ফিরতে মহামারী লাগার ন্যায় তার বংশের অধিকাংশ পন্ডিতমন্ডলী মারা যায়।

এই বংশের আরেকজন পন্ডিত অত্যন্ত বিখ্যাত হয়েছিলেন – যিনি চন্ডী দিয়ে মহিষ বধ করেছিলেন। উক্ত পন্ডিতকে একদিন একটি ভীষনাকৃতির ক্ষিপ্ত মহিষ আক্রমন করে। তখন আত্মরক্ষার জন্য ঐ পন্ডিত হাতের চন্ডী গ্রন্থখানা ছুড়ে মারে। আর সাথে সাথে মহিষ বলি হয়ে গেলো। এই ঘটনা লক্ষ্য করেছিলেন নলডাঙ্গার রাজা এবং তিনি এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ব্রাহ্মণ বংশের ১০০ লোক সমন্বিত ৪টি শরীকের জন্য ১৪০০ বিঘা জমি ব্রহ্মোত্তর করে দেন। রাজা উক্ত জমি দেবোত্তর হিসাবে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মন বংশ দেবত্তর হিসাবে জমি গ্রহন করতে রাজী হয়নি – কেননা, দেবোত্তর জমি ভোগ করা যায় কিন্তু বিক্রয় করা যায় না। অতঃপর উক্ত জমি ব্রহ্মোত্তর হিসাবে দেওয়া হয়। ব্রহ্মোত্তর জমিতে ব্রাহ্মণের সর্বোময় ক্ষমতা ন্যস্ত হয়।

পূজারী নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ( দুলাল ঠাকুর ) ১২ বৎসর বয়স থেকে এই পূজা আরম্ভ করেন পূজারীর মা শিখরবাসিনী কালী পূজায় পুত্রকে সম্মতি দেননি। কেননা দুলাল ঠাকুরের এক ভাই অতি অল্পবয়সে মারা যায়। শিখরবাসিনী দেবীর ধারনা পূজায় কোন ত্রুটি হওয়ায় তার পুত্র মারা গেছে। কিন্তু তথাপিও দুলাল ঠাকুরের পিতা ফনী ভট্টাচার্য স্ত্রীকে না জানিয়ে পুত্রকে কালী পূজায় নিযুক্ত করেন। ফনী ভট্টাচার্য সংস্কৃতের আদ্য ও মধ্য পাশ করেন। ফলে তিনি চিন্তা করতেন রামধন বাচস্পতি অভিসম্পাতে তিনি সত্বরই মারা যাবেন। ফনী ভট্টাচার্যের আশংকা যথাযথ হোল। পুত্র দুলাল ঠাকুরের ১৩ বৎসর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন। তার পিতামহের নাম কেশব ভট্টাচার্য এবং প্রপিতামহের নাম চন্দ্রকান্ত ভট্টাচার্য। গৌরীশংকর ভট্টাচার্য বৃদ্ধ পিতামহের নাম এবং অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহের নাম কেবল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য।

যতীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য ( কালুখালী, ফরিদপুর ) কাব্যতীর্থ দুলাল ভট্টাচার্যকে পূর্ণাভিষেক করতঃ দীক্ষা দেন। ধর্মীয় বিশ্বাস যে পূর্নাভিষেক করে দীক্ষা দিলে পূজায় কোন ত্রুটি হলেও মা ক্ষমা করবেন। কেননা দীক্ষা সময়ে দুলাল ঠাকুরের বয়স খুবই কম ছিলো। অতএব মাতৃপূজায় কোন প্রকার ত্রুটি হওয়া অসম্ভব ছিলো না।

স্থায়ী কালী মন্দিরে সংরক্ষিত কালো পাথর সম্পর্কে খোকসার পরিচয় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষনে কালো পাথরটির ভগ্নের সম্পর্কে আলোচনা করা যায়। বর্তমান পূজারীর পিতার আমলে ( ফণী ভট্টাচার্য ) এক ভুমিকম্পে মন্দির ভেঙ্গে গেলে উক্ত কালো পাথর ৭ দিন জঙ্গলে ছিলো। পরে স্বপ্নাদেশে খুজে বের করলে ভগ্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। পাথরখানি এখনো বেদীতে প্রতিষ্ঠিত আছে। যার গঠন অনেকটা চারপায়া বিশিষ্ঠ চৌকির মতন। যার পূর্বদিকের দুটি পা এবং পশ্চিম দিকের উপরস্ত পা ভাঙ্গা। ফলে ইট দিয়ে সমতল অবস্থায় রাখা হয়েছে। যে কাঠের আসনের উপর উক্ত কালো পাথরখানি বসানো আছে সেটা যদুণাথ সিংহ মহাশয় তার কাঠের আড়ৎ থেকে দেন। আর বড় আসনখানি প্রদান করেন ১৩৩২ সালে শৈলকুপা থানার ফাদিলপুরের অমরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য মহাশয়। পূর্বে পূজার যায়গাটি ছিলো বর্তমান পূজা মন্দিরের প্রায় এক ফার্লং দক্ষিন –পশ্চিমে।

বর্তমান পূজারী প্রাচীন পূজা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দেখেছেন। ঐ সময় অস্থায়ী টিনের চালায় দৈনন্দিত পূজা চলতো। তখন বাৎসরিক উৎসবের ( মাঘী আমাবস্যা ) মন্দির ছাওয়া হতো বিচেলি দিয়ে। ১৩৪১ সালে প্রাচীন পূজা মন্দির স্থানান্তরিত করা হয়, কুটিরশ্বর সাহা, ব্রজনাথ সাহা ও যদুনাথ সিংহ মহাশয়ের জমির উপর। উক্ত মন্দির নদীগর্ভে ভেঙ্গে গেলে ১৩৬২ সালে যদুনাথ সিংহ মহাশয়ের জমির উপর বর্তমান মন্দির গড়ে ওঠে। তৎপর যদুনাথ সিংহের তিন পুত্র শ্রী সুধীর কুমার সিংহ ও শ্রী শ্রীপতি কুমার সিংহ উক্ত জমি খোকসার কালীর নামে রেকর্ড করে দেন। রেকর্ডকৃত জমির পরিমান অর্থাৎ মন্দিরসহ মেলার জমির পরিমান এক একর পঞ্চাশ শতক।

এই পূজার জন্য নলডাঙ্গা রাজা পূজা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে অনেক জমি চাকরান দিয়েছিলেন অর্থাৎ বার্ষিক ভাবে খাজনা না দিয়ে এককালীন নিস্কর জমি ভোগের সুযোগ দিয়েছিলেন। যাদেরকে রাজা জমি চাকরান দিয়েছিলেন তাদের কাজ ও জমির পরিমান এখানে উল্লেখ করা গেলো।

  • (ক) বাৎসরিক উৎসবের কাঠামো তৈরির মিস্ত্রি ভোগ করতেন ১২ বিঘা।
  • (খ) পূজার কাপড় কাচার জন্য ধোপা পেয়েছিলেন ১২ বিঘা।
  • (গ) নিত্যপূজার ফুল, বাৎসরিক উৎসবের সোলার ও ডাকের সাজের জন্য মালাকারকে দেওয়া ছিলো ১২ বিঘা।
  • (ঘ) ফুল, দ্বীপ, ধুপ দেওয়া এবং যাবতীয় ভোগের যোগান দেওয়ার জন্য নাপিতকে দেওয়া ছিলো ১২ বিঘা। যেহেতু নাপিত জলচল তাই তাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো।
  • (ঙ) মাটি তোলা, মাচা দেওয়া ও কাঠামোর গোড়ায় মাটি দেওয়া প্রভৃতি কাজে ভূইমালিকে দেওয়া ছিলো ১২ বিঘা।
  • (চ) বলি, নিত্যপূজার ভোগ যোগান এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য ১২ বিঘা।
  • (ছ) প্রতি শনি ও মঙ্গলবারের ঢাক বাজানোর জন্য ঢাকীকে ১২ বিঘা।
  • (জ) বাৎসরিক পূজা উৎসবে ৭ দিন দীপান্বিতার সময়ে ১০৮ টি প্রদীপ মহড়ার তৈল এবং ভাদ্র মাসের তালবড়ার বাবদ খরচের জন্য ছিলো ১৬ বিঘা।

পূর্বে এই পূজায় নির্ধারিত বলির সংখ্যাও ছিলো অনেক। বাৎসরিক পূজার দিনে সকালের দিকে চন্ডী পাঠ শেষ করে চন্ডীর জন্য একটি পাঠা বলি দেওয়া হতো। বেলা ৪ টার দিকে দেবীকে আসনে প্রতিষ্ঠিতা করা হতো। তৎপর নলডাঙ্গার রাজার পত্তনি নড়াইলের জমিদার রতনবাবুদের পাঁচ শরীকের জন্য পাঁচটি পাঁঠা বলি দেওয়া হতো। তৎপর নলডাঙ্গার রাজা প্রেরিত মহিষ বলি হতো। এরপর খোকসার পার্শবর্তী দুই জমিদার ( পাংশার জমিদার ভৈরব বাবু এবং শিলাইদহের ঠাকুর বাবু ) এর সম্মান স্বরুপ তাদের প্রেরিত জোড়া পাঁঠা বলি দেওয়া হতো। জোড়া পাঁঠা বলি নিয়ে দুই জমিদারের ( ভৈরব বাবু ও ঠাকুর বাবু ) মধ্যে সম্মানের বাড়াবাড়ি নিয়ে দারুন প্রতিযোগিতা হতো।

খোকসা কালী মন্দির
পাঠা বলি - খোকসা কালী মন্দির

উভয়পক্ষই ৪০/৫০ জন লেঠেল সহ একটি করে পাঠা নিয়ে ঢোল বাজাতে বাজাতে কালী বাড়ীর দিকে আসতো। ঢোল বাজানো লেঠেলের বিক্রম দেখে জনসাধারন সন্ত্রস্ত হয়ে দূরে সরে যেত। এইবার দুই জমিদারের দুই পাঁঠা এক কাতলায় গলা সমান উচ্চ রেখে বসানো হতো। এই জমিদারের প্রতিনিধিগন অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য করতো কারো পাঁঠার গলা অন্যটি থেকে নীচুতে আছে কিনা এবং কারো পাঁঠার গলা এতটুকু নীচু হলেই সম্মান হানির ভয়ে এই পক্ষ প্রবল বাধা দিত, সাথে সাথে লেঠেলরা লাঠি ভেজে চিৎকার করে বিক্রম প্রকাশ করতো। যখন উভয় জমিদারের প্রতিনিধিগণ উভয় পাঠার গলা সমানে বসানো হয়েছে বলে রায় দিত, তখন জোড়া পাঁঠা বলি হতো।

Add comment

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
আমরা কুকিজ ব্যবহার করি
আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে কুকিজ ব্যবহার করি। তাদের মধ্যে কিছু সাইট পরিচালনার জন্য অপরিহার্য, অন্যরা আমাদের এই সাইট এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সাহায্য করে (কুকিজ ট্র্যাক করা)। আপনি কুকিজকে অনুমতি দিতে চান কিনা তা আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দয়া করে মনে রাখবেন যে আপনি যদি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেন তবে আপনি সাইটের সমস্ত কার্যকারিতা ব্যবহার করতে পারবেন না।