অনেক বছর আগে, যখন বাংলা ছিল ঘন বন, শান্ত নদী, আর সাদা কুয়াশায় মোড়ানো ভোরে ঢেকে থাকা এক বিস্তীর্ণ জনপদ, তখন কুষ্টিয়ার প্রান্তে হিমাবতী নামে এক ছোট্ট রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন দেবদত্ত, আর রানি — গৌরী।
গৌরী ছিলেন স্নিগ্ধ, ধীর, আর মায়াবী। তাঁর সৌন্দর্য নিয়ে রাজ্যে যেমন গর্ব ছিল, তেমনি ছিল তাঁর দয়ার সীমানাহীন নদীর মতো হৃদয়।
☀️ খরার অভিশাপ:
এক বছর দেশে বৃষ্টি নামলো না।
গাছ শুকিয়ে গেল, পুকুর খাল সব মরে গেল। মানুষের চোখে পানি, মাঠে ফাটল, আর আকাশে নিষ্ঠুর সূর্য।
রাজা প্রার্থনা করলেন, যজ্ঞ করলেন, পুরোহিত ডাকলেন — কিছুতেই বর্ষা এলো না।
গৌরী চুপচাপ ধ্যানস্থ হয়ে উঠলেন।
তিনি মনে মনে সংকল্প করলেন —
আমি যদি সত্যি পবিত্র প্রেম আর ত্যাগে জন্ম নিয়ে থাকি, তবে ঈশ্বর আমাকে সাড়া দেবেন। এই দেশের জন্য আমি আমার সর্বস্ব উৎসর্গ করব।
🌙 গৌরীর আত্মোৎসর্গ:
এক গভীর রাত। রাজপ্রাসাদের উত্তর পাশে, যেখানে এখন গড়াই নদীর উৎসস্থান, সেখানে গৌরী চুপিচুপি গেলেন।
চাঁদের আলোয় তিনি দাঁড়ালেন ধূপের মতো, বাতাস স্থির হয়ে গেল।
তিনি হাত জোড় করে বললেন:
"হে ভগবান, আমাকে নিয়ে নাও, কিন্তু এই দেশকে দাও এক স্নেহভরা নদী, যেটা মানুষকে জীবন দেবে, ফসল দেবে, আশ্রয় দেবে।"
চোখ বন্ধ করলেন, এবং ঠিক তখনই —
আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো, বজ্র গর্জন করল, আর মাটি ফেটে জল ছুটে বেরোলো।
🌊 এক নদীর জন্ম:
সেই জায়গা থেকে সৃষ্টি হল এক নতুন নদী — প্রথমে ক্ষীণ, তারপর উন্মাত্ত, সাপের মতো গড়িয়ে যেতে লাগল গ্রামের পর গ্রাম।
মানুষ সকাল বেলা উঠে দেখলো — তাদের চারপাশে নদী।
খরা নেই, ধ্বংস নেই, শুধু জল, আর জল।
📛 নদীর নাম "গড়াই":
লোকেরা প্রথমে ভয় পেলেও পরে বোঝে — এটা গৌরীর দান।
তবে নদীটি কখনো সরাসরি যায় না — বাঁক নেয়, মোচড়ায়, গড়িয়ে গড়িয়ে চলে।
তাই গ্রামের বয়োবৃদ্ধ বলল:
“এই নদী তো গৌরীর মতই নরম আর গড়িয়ে পড়া — ওর নাম হোক গড়াই। গড়িয়ে আসা গৌরীর আশীর্বাদ।”
গৌরী আর কখনো ফিরে আসেননি।
কিন্তু প্রতি বছর বর্ষায়, যখন গড়াই নদী তার বুক ফাটিয়ে বন্যা বইয়ে দেয়, আবার শুকনো মৌসুমে শান্ত হয়ে পড়ে —
তখন মানুষ বলে,
“গৌরী ফিরে আসেন, আবার হারিয়ে যান।”
🎭 এই কাহিনির তাৎপর্য:
- গড়াই নদী এখানে শুধু একটি ভূগোল নয়, বরং এক ত্যাগী নারী হৃদয়ের প্রতীক।
- এটি বাংলার লোকশ্রদ্ধা, নারীশক্তি, এবং প্রকৃতির অন্তর্নিহিত যোগসূত্র বোঝায়।
- এই লোককাহিনিতে উঠে এসেছে নারীশক্তি, প্রেম, প্রকৃতি ও বাঙালির সংস্কৃতির গভীর সংযোগ।
