বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যকীর্তি
মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যকীর্তি

‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম নবজাগরণের পথিকৃৎ’ মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান তৎকালীন নদীয়া জেলার অন্তর্গত কুষ্টিয়া মহকুমা, বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার লাহিনী পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর। পিতা মীর মোয়াজ্জম হোসেন এর আর্থিক অবস্থা সচ্ছল হলেও মীর মশাররফ হোসেন চারিত্রিক শৈথিল্যের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর এগোতে পারেননি।

তবে ব্যক্তিগত উদ্যমে তৎকালে প্রচলিত বঙ্কিম মধুসুদন প্রমুখ সাহিত্যিকের রচনা এবং পুঁথি সাহিত্যের কেচ্ছা-কাহিনী প্রচুর পড়েছিলেন। অভিজাত মুসলিম নাগরিকের আরবি-ফার্সি-উর্দু প্রীতির বিপরীতে লোকায়ত পল্লী বাংলা তাঁর মানসগঠনের রসদ জুগিয়েছিল। এরই ফলে উদার অসাম্প্রদায়িক সমন্বয় ধর্মীধারার সাহিত্য সৃজনের প্রথম সূত্রপাত হয় তাঁরই হাতে। এবং তিনিই প্রথম সার্থক মুসলিম সাহিত্য শিল্পী। ‘সবচেয়ে বড়ো কথা, তাঁর কালের বাঙালি মুসলমানের মতো তিনি স্বদেশ ও মাতৃভাষা সম্পর্কে নির্লিপ্ত কিংবা দ্বিধান্বিত ছিলেন না।’ -[আবুল আহসান চৌধুরী]। ‘নিরক্ষর ও স্বাক্ষর মুসলমানদের মধ্যে জ্ঞান ও রুচির উন্নতি বিধানকল্পে, তৎকালীন মুসলিমমানস যা ভোগ করতে অভ্যস্ত ছিলো সেই পুঁথি সাহিত্যের রূপ-রস ভাষাকে তিনি আধুনিকতায় পরিশোধিত করে প্রচার করেন।’-[মোহাম্মদ হারুন-উর-রশীদ]। বাংলা, আরবি, ফার্সি, হিন্দি ও উর্দু এ পঞ্চভাষার মিশ্রণে কথিত দোভাষী পুঁথির জগত থেকে মুসলিম মানসকে তিনি আধুনিক জীবনবোধে উদ্দীপ্ত করেন। সাহিত্যে অবিমিশ্র বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করে শক্তিমান গদ্য লেখকরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

মধ্যযুগে বিশেষত ষোড়শ-সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য হিন্দু মুসলমানের মিলিত অবদানে পুষ্ট হয়েছিলো।

মীর মশাররফ হোসেন

কিন্তু ১৭৫৭ থেকে ইংরেজ অধিকারের পর হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বেড়েছে। একদিকে নাগরিক অভিজাত মুসলিম শ্রেণী আরবি-ফার্সি-উর্দু চর্চাকেই একমাত্র করণীয় করে তুলেছিলো, অন্যদিকে ইংরেজ সংসর্গ তথা ইংরেজি শিক্ষা বর্জনকেই মুক্তির একমাত্র পথ ভেবে পিছিয়ে পড়েছিল মুসলমান সমাজ। এ অবস্থায় নূতন প্রত্যাশার সম্ভাবনা তরঙ্গায়িত করে তুললেন গ্রামের ছেলে মীর মশাররফ হোসেন। বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানমানসের নবজাগরণের তিনি অগ্রপথিক। তাঁর রত্নবতী (১৮৬৯) আধুনিক মুসলমান সাহিত্যিকের রচিত প্রথম উপন্যাস; তাঁর বসন্ত কুমারী নাটক (১৮৭৩) মুসলমান সাহিত্যিক রচিত প্রথম বাংলা নাটক, বিষাদ সিন্ধু (১৮৮৫, ১৮৮৭, ১৮৯১), বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গদ্য মহাকাব্য, তাঁর সম্পাদিত ‘আজীজন নেহার’ পত্রিকা (১৮৭৪) মুসলমান বাঙালি সম্পাদিত প্রথম সাহিত্য পত্রিকা।’

--- ভূদেব চৌধুরী

সর্বনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী সর্বজনীন মানবিকতা হলো নবজাগরণের তথা আধুনিকতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ‘বাঙালি মুসলমানের হাতে সেই সর্বনিরপেক্ষ মানসিকতার প্রথম স্পর্শ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সঞ্চারিত হয়েছিল মশাররফ হোসেনের রচনায়। বাংলা গদ্যের সাধু রূপটির শিল্পমূর্তি বিদ্যাসাগরের হাতের রচনা। সে ভাষা সংস্কৃত পন্ডিত সমাজে প্রচলিত কথোপকথনের গদ্য কাঠামোর ওপরে প্রতিষ্ঠিত। বঙ্কিমের রচনাতেও সংস্কৃতজ তৎসম শব্দের আতিশয্য পরিপাটী রূপ ধরেছে। কিন্তু মশাররফের বাংলা গদ্য যেরূপ ধরল, তা বাংলার গ্রামাঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ বাঙালির মুখের ভাষার কাঠামোর ওপরে গড়া-তারই পরিমার্জিত লিখারূপ।’ এ ভাষা অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি।’

--- ভূদেব চৌধুরী

রত্নবতীর পর ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯১) এবং ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯) নামে তাঁর আরও দু’খানি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ‘দুটি রচনাই আত্মজীবনীমূলক; বস্তুত মশাররফের উপন্যাস ও নাটক, উভয় রকমের মৌলিক রচনাই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার রস-অভিব্যক্তি। বাংলার গ্রামীণ মুসলমান সমাজের দারিদ্র্য, তাদের অসহায় সরলতা এবং সেই সুযোগে স্বার্থগৃধ্নু অমানুষদের মর্মান্তিক উৎপীড়নের আর্থিক, সামাজিক এমনকি ধর্মীয় জীবনের অবিকল নক্সা এঁকেছেন শিল্পী। দুচোখ ভরে যা দেখেছেন, তারও সহৃদয় শিল্পমূর্তি রচনা করেছেন। উদাসীন পথিক এবং গাজী মিয়া আসলে তিনি নিজেই। এইসব গল্পে নূতন জীবনের চলচ্চিত্র যেমন দেখি-তেমনি মগ্ন হতে হয় গ্রামীণ জীবনের অকৃত্রিম মেটে স্বাদগন্ধে।

--- ভূদেব চৌধুরী

ভাবে ভাষায় ‘বিষাদসিন্ধু’ তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ স্বাক্ষরবহ। এর তিনটি পর্ব যথাক্রমে মহরমপর্ব ১৮৮৫ সালে, উদ্ধারপর্ব ১৮৮৭ সালে, এজিদবধ পর্ব ১৮৯১ সালে প্রকাশিত। দামেস্ক অধিপতি এজিদ কর্তৃক ইমাম হাসান, ও ইমাম হোসেনের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড গ্রন্থটির মূল বিষয়বস্তু হলেও তা রূপায়িত হয়েছে এজিদের জয়নাব-রূপমুগ্ধতার মানবিক আবেগের আধারে। সমালোচকের ভাষায় বলতে হয় এটি ইতিহাস, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের বিবিধ সংমিশ্রণে রোমান্টিক আবেগে ঋদ্ধ একটি সংকর সৃষ্টি। মৌলিক রচনা না হলেও বিষাদসিন্ধু সর্বজনীন সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ। ‘বিষাদসিন্ধু কেবল বিষাদেরই সিন্ধু নয়; সর্বজনীন অনুভূতিতে শ্বাশত সত্যের প্রকাশে এবং মহিমময় বিষয় গৌরবে প্রাচীনতর সম্পদের স্বাদগন্ধসহ বাংলা সাহিত্যে এক ক্লাসিক স্থাপত্যের মতই ভাস্বর হয়ে রয়েছে এবং এর ভাষার ঊর্মি মুখর তরঙ্গোচ্ছ্বাসের মধ্যেই মীর সাহেবের সাহিত্যিক প্রতিভা ও যথাযথ বিকশিত হয়ে উঠেছে।

--- মু. আবদুল হাই

বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত গ্রন্থে ড. অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় মন্তব্য করছেন : ‘মীর মশাররফ হচ্ছেন প্রথম মুসলমান সাহিত্যিক যিনি আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে ক্লাসিক বাংলা গদ্য আয়ও করেছিলেন এবং অনেকগুলো উৎকৃষ্ট গ্রন্থ লিখে শুধু মুসলমান সমাজে নয় হিন্দু সমাজেও বিশেষ গৌরব লাভ করেছিলেন। তাঁর বিষাদ সিন্ধু কারবালার শোচনীয় ঘটনা অবলম্বনে রচিত ট্রাজিক ও এপিকধর্মী গদ্য উপন্যাস।..... এই গ্রন্থই তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। চরিত্র সৃষ্টি, রোমান্সের ঠাকুরনি এবং মহাকাব্যোচিত বিশালতা ও ট্রাজিক বেদনার এমন মর্মন্তুদ পরিচয় বোধ হয় বঙ্কিম চন্দ্রকে বাদ দিলে আর কোনো বাঙালি ঔপন্যাসিকের রচনায় পাওয়া যাবে না। একালের বাংলাদেশের সমালোচকগণ যাই বলুন, মীর সাহেব হচ্ছেন হিন্দু ও মুসলমান শ্বাশত সমাজের যথার্থ সংযোগসূত্র।’

বিষয় বৈচিত্র্যের দিক থেকেও মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্য কীর্তি উল্লেখযোগ্য। উপন্যাস-উপাখ্যান-নকশা-নাটক-প্রহসন-পদ্য-কবিতা-সঙ্গীত, প্রবন্ধ, জীবনী, আত্মজীবনী, সংবাদ বিবরণী, ছাত্র পাঠ্য পুস্তক ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটির মতো গ্রন্থ তিনি পঁয়তাল্লিশ বছরের সময়সীমার মধ্যে লিখেছিলেন। এদিক থেকে তিনি একজন সব্যসাচী লেখক।

সমকালে মীর মশাররফ হোসেন নন্দিত ও নিন্দিত দুটোই হয়েছিলেন। তবে বাংলা ভাষায় তাঁর পারঙ্গমতাকে হিন্দু লেখকগণ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এই বলে; তাঁর মতো বাংলা অনেক হিন্দু লেখক শিখতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করবেন। কীর্তিমান এই সব্যসাচী লেখক মীর মশাররফ হোসেনের জীবনাবসান হয় ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.