দয়াল বাবা কদম আলী মস্তানের জন্ম বিক্রমপুরের ডহরী নওপাড়া। আস্তানা ছিল মরহুম সাত্তার বেপারী সাহেবের বাড়ি তৎকালীন দিঘলী বাজারের পূর্ব পাশে। এই পাগলের আবির্ভাব বিক্রমপুরের মানুষের জন্য ছিল আশির্বাদের মতো। বিভিন্ন রোগ আর মহামারিতে বিক্রমপুরের মানুষেরা ছিলো দিশেহারা।
ভাল ডাক্তার পাওয়া যায়না, ঔষধ কেনার পয়সা জোটেনা। কলেরা, যক্ষা, বসন্তে ভরে গেছে এলাকা। মানুষ দিশেহারা। কি ভাবে রক্ষা পাবে এ থেকে ? এমন সময় এলেন কদম মস্তান। তাঁর পানি পড়া খেয়ে সবাই সুস্হ্য হয়, সবার মনোবাসনা পূর্ন হয়। এ খবর ছরিয়ে পড়তে লাগলো চারাদিকে। নিঃসন্তানের কোলে সন্তান এলো। সবাই হুমরী খেতে লাগলো কদমের দরবারে।
অন্য দিকে কদম আলী মস্তানের ভক্ত সুমন সিকদার বলেছেনঃ- সেই সময় নদীর ভাঙ্গনও খুব তীব্র ছিলো। মাইলের পর মাইল ঘরবাড়ী, ফসলের জমি এবং মানুষসহ তলিয়ে যেতো পদ্মা নদীর গ্রাসে। গ্রামবাসীর আতঙ্কে দিন কাটতে শুরু হলো, কান্নার রোল পরে গেলো। কদম আলী মস্তান পদ্মা নদীর তীরে বসে চিন্তা মগ্ন হলে গ্রামবাসী বলে তুমি এখান হতে চলে যাও, তানাহলে তুমিও এই গ্রাসে তলিয়ে যেতে পারো। অতঃপর তিনি তাঁর পেটে ছুরি চালিয়ে পেটের ভূরি বের করে পদ্মা নদীর পানি দিয়ে সেই নাড়িভুঁড়ি পরিস্কার করতে লাগলেন। এই কাহিনী দেখে গ্রামবাসী ভয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে দেখা গেলো নদী আর সেই আগের মতো ভয়ঙ্কর রুপে ভাঙ্গে না।
দিঘলী বাজারে একটা ছোট্র দোকান চালাতো মোহন্ত। সারাদিন দোকানদারী করে রাতে সবাই চলে আসতো পাগলের আস্তানায়। গভীর রাত পর্যন্ত চলতো গান বাজনা। নুরালী ঢালীর হারমোনিয়ামের সুনিপুন বাজনা আর শিল্পীদের গানে পাগল ও বেশ মজা পেতেন।
মোহন্ত নামকরন
একদিন গভীর রাতে কদম ঢুকলেন আস্তানায়। দেখলেন, সবাই গভীর ঘুমে রত। কদম ডাকলেন, মোহন্ত ! বাবা মোহন্ত ! কে মোহন্ত ? কোথায় মোহন্ত ?
সবার ঘুম ভেঙে গেল। সবাই পাগলের দিকে তাকিয়ে আছে। পাগলের দৃষ্টি মোহন্তর দিকে। মোহন্তকে ইশারা করে বল্লেন, আপনাকে ডাকছি। একটা গান করেন। মোহন্ত তো হতবাক। কারন তখনো তার সাথে পাগলের সখ্যতা গড়ে উঠেনি। মোহন্ত বল্লেন, আমি তো হারমোনিয়াম বাজাতে পারিনা। পাগল বল্লেন, ঐ কোনায় গিয়া হারমোনিটা লইয়া প্যাঁ পোঁ করেন গা। আল্লায় চাইলে অইয়া যাইবোনে।
পাগলের কথা মত মোহন্ত হারমোনিয়ামের রিডে হাত দিতেই যেন এক শিহরণ অনুভব করলেন। নিজে নিজেই যেন সুর উঠে আসছে। তৎখনাত মোহন্ত হারমোনিয়াম বাজিয়ে কদমকে গান শুনালেন। মোহন্ত বুঝে গেলেন পাগলের কারিশমা। সেই থেকে আমৃত্যু তিনি কদমের সাথেই ছিলেন।
প্রিয় পাঠক, মোহন্তর আসল নাম আব্দুস সাত্তার। মূলত "মোহন্ত" নামটি কদমের দেয়া নাম। জীবদ্দশায় যেমন কদমের সেবা করে কাটিয়েছেন মৃত্যুর পরেও মহামিলনের আকাংখায় ঢাকার কেরানীগন্জের কদমপুরে গুরুর রওজার পাশে সমাহিত হলেন।
দয়াল বাবা কদম আলী মস্তান (রহ:) এর স্মরণে তাঁর ভক্তবৃন্দ এবং শুভানুধ্যায়ীরা প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে একটি গানের জলসাকে উপলক্ষ করে একত্রিত হন। আর এই মিলনমেলার কাব্যিক নামকরণ করা হয় “মহামিলনের মহতি জলসা”।
কদম মস্তানের একান্ত ভক্ত “আমিতো মরেই যাব” খ্যাত মরমী বাউলকবি আব্দুস সাত্তার মোহন্ত শাহ্ বহু বছর আগে এ জলসাটি শুরু করেন। তিনি যেহেতু বাউল জগতের আধ্যাত্মিক ঘরানার মানুষ ছিলেন তাই তিনি সূফী বাউল, কবি সাহিত্যিক, সাধু সন্ন্যাসী সকল শ্রেণির ভাবুক মানুষদের দাওয়াত করতেন। জীবদ্দশায় তাঁর দাওয়াতে সকল শ্রেণির মানুষেরা হাজির হতেন। পরিনত হতো মিলনমেলায়। সন্ধা থেকে কদম মস্তান (রঃ) জীবনী বিষয়ক আলোচনা, দোয়া এবং তোবারক বিতরণ। রাত ১০ টা থেকে শুরু হত বাউল গান। মাঝেমাঝে এমন অবস্থা হতো যে, নামকরা বহু শিল্পী একটির অধিক গান করার সুযোগ পেতনা।
তাঁরা সারারাত মুর্শিদী, মারফতি, দেহতত্ত্ব গান গেয়ে শ্রষ্টার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন। মহামিলনের মহতি জলসা আয়োজন করেন দয়াময় মালিকের,রুহানী, ফায়েজ, বরকতের উদ্দেশ্যে।
২০১৩ সালে আব্দুুস সাত্তার মোহন্ত মারা যাওয়ার পর তার একমাত্র পুত্র গোলাম কিবরিয়া (জেহাদ মোহন্ত) কদমের ভক্তবৃন্দকে সাথে নিয়ে এ জলসাটি করে থাকেন।
দয়াল বাবা কদম আলী মস্তান (রহঃ) বাৎসরিক ওরশ প্রতি বছর ১৭ই মাঘ অনুষ্ঠিত হয়। লৌহজং এ ৭দিন ব্যাপী এ ওরশ বলা হলেও মূলত ১০ দিন পর্যন্ত চলে। প্রতি রাতে এখানে বাউল গান হয়। বাংলাদেশেরর বিখ্যাত বাউল শিল্পীরা গান গেয়ে থাকেন। হাজার হাজার ভক্তবৃন্দরা এখানে সমবেত হন। লৌহজং এর বিশাল এরিয়া বিস্তৃত হয় এই ওরশ।