কমরেড রওশন আলি পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের জন্ম হয় যারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চাইতে সাধারন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের মঙ্গলের জন্য জীবন উৎসর্গ করে থাকেন। জদিও জগৎ সংসারে এসব মহৎ ব্যক্তিদের সংখ্যা খুবই নগন্য, এসব ক্ষনজন্মা মানুষের আবির্ভাব আমদের সমাজে খুবি দুর্লভ।
যে সমাজের মানুষ ক্রমেই আত্তসুখী হয়ে উঠছে, ব্যক্তি সার্থের কাছে সামগ্রিক সার্থ যেখানে মুল্যহীন, টাকা দিয়ে যে সমাজে মানব মুল্যবোধ কলংকিত হচ্ছে, অর্থের বিনিময়ে আদর্শ, নীতি ভুলুন্ঠিত সেখানে অন্যের জন্য ভাববার সময় কোথায় ? তবুও কিছু কিছু মানুষ আজও রয়েছেন, যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন মানব কল্যানে। এমনি এক আত্তভোলা, নিঃসার্থ রাজনীতিক হচ্ছেন কমরেড শেখ রওশন আলী। জীবন সংগ্রামের এক জলন্ত উদহারন, কিংবদন্তীর নায়ক। যার সমগ্র জীবনটাই ছিলো মানুষের জন্য, শ্রমিক, পেশাজীবি, নিষ্পোষিত মানবগোষ্ঠীর সার্থে।
পারিবারিক ইতিহাসঃ
কুষ্টিয়া শহরের এক মুসলিম পরিবারে শেখ রওশন আলির জন্ম। বাবা শেখ এলাহী বক্স, মা মিতিজান নেছা বিবি। শেখ এলাহী বক্সের দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী মতিজান নেছা বিবি এবং দ্বিতীয় স্ত্রী মজিরন নেছা বিবি। বাবা ছিলেন একজন অতি ক্ষুদ্র মাংশ ব্যবসায়ী। বলা যায় একটি অশিক্ষিত ‘কসাই’ পরিবারে শেখ রওশন আলির জন্ম। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে রওশন আলি। দ্বিতীয় ছেলে শেখ আব্দুল গনি [টুনা মিয়া] এবং সবার ছোট মেয়ে [নাম জানা যায়নি]। সে ৬-৭ বছর বয়সে মারা যায়। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে একমাত্র মেয়ে আছিয়া খাতুন।
শেখ রওশন আলির জন্ম ১৯০৫ সালের ১৮ই জুলাই। অভাব অনটনের মধ্যে ছোটবেলা থেকে তিনি বড় হতে থাকেন। পাচঁ বছর বয়সে স্থানীয় খ্রীষ্টান মিশিনারী প্রাইমারী [সিএমএস] স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সামর্থ্য না থাকার কারনে দ্বিতীয় শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করে তাকে এ পর্ব বাদ দিতে হয়। পরিবারের অসচ্ছলতার কারনে মাত্র ১০/১১ বছর বয়সে একটি রুটি তৈরির কারখানায় সহযোগী শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দেন। বাবা শেখ এলাহী বক্স প্রথম জীবনে মাংশ বিক্রেতা ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে কোন রকমে সংসার চালাতেন। ১৯৪৩ সালে তিনি মারা যান।
কিশোর রওশন আলি রুটি তৈরির কারখানায় কাজের পাশাপাশি ঘরে বসে লেখাপড়া করতে থাকেন। অবসর সময় পাড়ার ছেলেদের নিয়ে নিজে খেলার দল গঠন করেন। এক পর্যায়ে দলনেতা হয়ে যান। এ সময় তিনি তার সহকর্মীদের নিয়ে সার্কাস দল তৈরী করেন। ১৯৩২ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি মোহিনী মিলের তাঁত বিভাগে চাকুরী পান। ১৯৩৪ সালে শহরের পার্শবর্তী মোল্লাতেঘরিয়া গ্রামের জনৈক সদু ফকিরের ১২ বছর বয়সী ছোট মেয়ে গোলাপী নেছা বিবির সাথে তার বিয়ে হয়। তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ছিলো তার সংসার। সবার বড় মেয়ে রিজিয়া খাতুন। তারপরের ছেলে ছয় মাস বয়সেই মারা যায়। ১৯৪০ সালের ২রা ডিসেম্বর জমজ ছেলে নানু ও চনু জন্মগ্রহন করে।
দুই বছর বয়সে নানু মারা যায়। বড় মেয়ের বিয়ে হয় শহরের আড়ুয়াপাড়ার কাজী গোলাম কিবরিয়ার সাথে। এদের সংসারে তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। সন্তানরা হলো কাজী তরিকুল ইসলাম ঝন্টু, কোহিনুর বেগম, শাহিদা খাতুন কবি, কাজী কবির, কাজী পলাশ ও ছবি। রওশন আলির একমাত্র পুত্র শেখ নওশের আলি চানু। মোল্লাতেঘরিয়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর প্রথমা কন্যা শাহানারা খাতুনের সাথে তার বিয়ে হয়। দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে শেখ আফরোজা সুলতানা দোলা। দাদু রওশন আলি আদর করে বড় নাতনীর এই নাম রেখেছিলেন। সম্প্রতি হঠাৎ তার প্রিয় নাতনী মাত্র ২৩ বছর বয়সে ১ পুত্র সন্তান রেখে মারা গেছেন। মেজো মেয়ে শেখ তানিয়া সুলতানা ও সবার ছোট শেখ মোঃ আব্দুল নুর।
১৯৪২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে রওশন আলির স্ত্রী গোলাপী নেছা বিবি একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এসময় তিনি কারাগারে বন্দী। তার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর জেলে পৌছালেও তার সহকর্মীরা প্রথমে তাকে জানাতে চায়নি। কিন্তু তিনি অনুমানে বুঝে নিয়েছিলেন এই মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর। কথা প্রসঙ্গে রওশন আলি সহকর্মীদের বলেছিলেন, দেশের মানুষের কথা ভাবতে গেলে নিজের সমস্যার কথা ভুলে যেতে হয়। দেশের সার্থের কথা চিন্তা করে তিনি কত সহজভাবে তার প্রিয়তমা, জীবন সংসারের একমাত্র সাথী স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ মেনে নিয়েছিলেন। তার এই আত্তত্যাগে সহকর্মীরা বিস্মিত ও অভিভুত হয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালে তার সংসারে আরেক বিপর্যয় নেমে আসে। মাত্র ১৩ দিনের ব্যবধানে ছেলে, মা ও বাবা মারা যান। প্রথমে তার জমজ ছেলে চুনু মাত্র ২ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এর ৪ দিন পর মা মতিজান নেছা বিবি এবং ৯ দিন পর বাবা শেখ এলাহী বক্স প্যানিসাস ম্যালেরিয়ায় মারা যান। শ্রমিক ইউনিয়নে সক্রিয় সংগঠক থাকার অপরাধে ১৯৩৯ সালে মোহিনী মিল থেকে রওশন আলির চাকুরী চলে যায়। এমনিতেই অভাবের সংসার, তার উপর চাকুরী চলে যাওয়ায় চরম সমস্যায় পড়েন তিনি। তখন ছোট ভাই টুনার সাথে একটি ছোট খাবার হোটেল করে কোন রকমে সংসার চালাতে থাকেন।