বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

কুমারখালী থানা কুষ্টিয়ার ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধে এ থানার রয়েছে গৌরবজনক  ভুমিকা
কুমারখালী থানা কুষ্টিয়ার ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধে এ থানার রয়েছে গৌরবজনক ভুমিকা

কুষ্টিয়া জেলার প্রাচীনতম কুমারখালী থানার বর্তমান আয়তন ৩২৮.৯৪ বর্গকিলোমিটার। এর পশ্চিমে কুষ্টিয়া সদর থানা, পুর্বে খোকসা থানা, দক্ষিনে ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানা এবং উত্তরে পদ্মা নদী ও পাবনা জেলা।

গড়াই নদী থানার পশ্চিমে কুষ্টিয়া সদর থেকে কুমারখালীতে প্রবেশ করে একেবারে মধ্য দিয়ে পুর্বে খোকশা তে প্রবেশ করেছে। ফলে থানাটি উত্তর ও দক্ষিন এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। গড়াইয়ের উত্তরাঞ্চলে রয়েছে ৫টি ইউনিয়ন - সাদকী, নন্দলালপুর, কয়া, জগন্নাথপুর, এবং শিলাইদহ।

আর যদুবয়রা, চাপড়া, বাগুলাট, পান্টি ও চাদপুর এই ৫টি ইউনিয়ন রয়েছে দক্ষিনে। পদ্মার ভাঙ্গনের ফলে থানার উত্তরে পাবনার মুল ভুখন্ডের সাথে রয়েছে থানার এক বিরাট অংশ, যা চর সাদীপুর ইউনিয়ন নামে নতুন একটি ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছে। এছাড়া গড়াই তীরে উত্তরে বাংলাদেশের পুরাতন পৌরসভা গুলোর অন্যতম কুমারখালী পৌরসভা ১৮৬৯ । মুক্তিযুদ্ধে এ থানার রয়েছে গৌরবব্জনক ভুমিকা।

পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন আন্দোলনে কুমারখালী
১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারন নির্বাচনে মুসলিমলীগের প্রার্থী শাহ আজিজুর রহমানের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করেন যুক্তফ্রন্টের ন্যাপ নেতা সৈয়দ আলতাফ হোসেন। বিজয় নিশ্চিত করতে মাওলানা ভাসানী নির্বাচনী জনসভা করেন কুমারখালী জে,এন হাইস্কুল মাঠে এবং পান্টিতে। সৈয়দ আলতাফ হোসেন বিপুল ভোটে নির্বাচনে বিজয়ী হন। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ নিয়ে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি কুমারখালীতে গঠিত হয় ১৯৫৭ সালে। সম্পাদক আফাজউদ্দিন। তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় প্রতিটি ইউনিয়নেও কমিটি গঠিত হয়।

১৯৫৮ সালে সামরিক সরকার ক্ষমাতায় বসার কারনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিলেও ছাত্ররা এ সময় বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬২ সালে মৌলিক গনতন্রীল দের ভোটে এম,এস আলী [নন্দলালপুর] প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নর্বাচিত হন। কুমারখালী ছাত্র সমাজ ১৯৬২ সালে সামরিক বিধিনিষেধের প্রথম প্রতিবাদ করে এবং শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। এ সময় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে আন্দোলনের পুরোধা নুর আলম জিকু [দুর্গাপুর, কুমারখালী] তারই নেতৃত্বে কুমারখালীতে এম এ বারী, মজিবুর রহমান, আবু হানিফ, তোফায়েল তোফাজ্জেল হোসেন, আ,স,ম ওয়াহেদ পান্না, কাজী আক্তার, রেজাউল করিম হান্নান, প্রমুখ ছাত্র মিছিল, মিটিং সহ রিপোর্ট বাতিলের দাবীর কর্মসুচী পালন করে।

১৭ই সেপ্টেম্বর সারাদেশের মতো কুমারখালীতে সফল হরতাল পালিত হয়। কুমারখালীতে তখনও কলেজ না হওয়ায় ছাত্ররা পাশ করে কুষ্টিয়া কলেজে ভর্তি হতো। তাই কুষ্টিয়ার যাবতীয় সিদ্ধান্ত কুমারখালীতেও পালিত হতে থাকে। ১৯৬৩ সালের ৮ই মে কুষ্টিয়াতে ১৪৪ ধারা জারি করে আন্দোলনের সাথে জড়িত নেতাকর্মী ছাত্রদের ব্যাপক ধড়পাকড় শুরু হয়। এতে অনেকেই কুমারখালীতে চলে এসে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পায়। মাত্র ১১ জন ছাত্র নিয়ে ১৯৬৫ সালে কুমারখালী থানায় প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম থেকেই এর ছাত্ররা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে।

কুমারখালীতে আওয়ামীলীগের ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি সত্বেও মুসলিম লীগের শক্তিশালী সংগঠক ছিলো। তা সত্তেও ষাট এর দশকে সরকার বিরোধী আন্দোলন চলে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফাকে কেন্দ্র করে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে গোলাম কিবরিয়া, নুর আলম জিকু, আঃ মজিদ, আঃ আজিজ খান প্রমুখ আওয়ামী নেতৃবৃন্দ থানার কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ ৬ দফার ক্ষেত্রে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

এ সময় আওয়ামী নেতাকর্মীরা বিভিন্ন লিফলেট ও পুস্তিকার মাধ্যমে ৬ দফাকে ব্যাখ্যা করতে থাকেন এবং প্রধান মুসলিম লীগের মাওলানা তোফাজ্জেল হোসেন ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর [জনেন বোস] মতো লোকেরা আওয়ামী লীগে যোগদান করে ও আনন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফা দাবী উথাপন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ছাত্রলীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এম,এ বারী কুমারখালী ছাত্র আন্দোলনের সাথে নিয়োমিতো যোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিতেন। কুমারখালীতে রেজাউল করিম হান্নানকে আহবায়ক করে এবং আ,স,ম ওয়াহেদ পান্না, নন্দদুলাল বিশ্বাস, মঞ্জু সাত্তার, গনি, টুনু, বারী খান প্রমুখ সদস্যদের মাধ্যমে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

মেয়েদের মধ্যে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুফিয়া বেগম, রওসন আরা নীলা, ঝর্না, রুবি প্রমুখ। এ সময় মুসলিম লীগের সমর্থক ইসলামী ছাত্র সংঘের ছাত্ররা ছাত্রদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। ১৯৬৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী কুষ্টিয়াতে মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালানোয় আব্দুর রাজ্জাক নিহত হন এবং কুষ্টিয়া কলেজের ছাত্র কুমারখালীর সত্য ঘোষ সহ গুলিবিদ্ধ হন বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতা। এছাড়াও ব্যাপক সংখক আহত হয়।

এ ঘটনা আন্দোলনকে বেগবান করে এবং কুমারখালীতে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে কুমারখালীতে এবং মন্টু ডাক্তারের নেতৃত্বে শিলাইদহ, বরুন মাষ্টার মহেন্দ্রপুরে, নন্দলালপুরে আইয়ুব চেয়ারম্যান, সদকীতে ওয়াজ চেয়ারম্যান, যদুবয়রাতে আজাহার বিশ্বাস, আবেদ মাষ্টার, পান্টিতে আব্দুল জলিল মোল্লা, মাওলানা তোফাজ্জেল হোসেন, আঃ রাজ্জাক মিয়া, চাদপুরে আব্দুল চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে থানার সর্বত্র আন্দোলন চলতে থাকে। এভাবে ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের সহ সর্বস্তরের জনগনের যুগপৎ আন্দোলন এক দুর্বার গন আন্দোলনের সৃষ্টি করে। যা গনঅভ্যুথানে রুপ নেয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে কুমারখালী খোকসা নির্বাচনী এলাকাতে আওয়ামীলীগ প্রার্থী হন গোলাম কিবরিয়া আর তার প্রতিদ্বন্দি মুসলীম লীগের আফিল উদ্দীন। ও সময় মুসলিম লীগে জনগনের অনুপস্থিতি ও অসহযোগিতায় থানার প্রতিটি যায়গাতে জনসভা করতে ব্যর্থ হয় এবং নির্বাচনের আগেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নির্বাচনে ১৭ ডিসেম্বর গোলাম কিবরিয়া বিপুল ভোটের ব্যাবধানে আফিল উদ্দীন কে পরাজিত করেন। অবশ্য আগেই ৭ই ডিসেম্বর ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম সাদ আহমেদকে [দালাল আইনে অভিযুক্ত] পরাজিত করে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

অসহযোগ আন্দোলনে কুমারখালী -
১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষনার সাথে সাথে সারাদেশের মতো কুমারখালীতেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। ১ মার্চ কুমারখালী যেন মিছিলের শহরে পরিনত হয়। পুর্বে গঠীত “সর্ব দলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” “স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়। আ,স,ম ওয়াহেদ পান্নাকে সমন্বয়কারী এবং রেজাউল করিম হান্নান কে আহবায়ক করে একটি কমিটি ঘোষনা করা হয়। উল্লেখযোগ্যরা হলেন – নন্দগোপাল, পরিমল, মঞ্জু সাত্তার, মোফাজ্জেল, মকবুল, রফিক, ঝন্টু, আলম, টুনু, রুহুল প্রমুখ এবং ছাত্রী সদস্য সুফিয়া বেগম, রওসন আরা, রুবি, ঝর্না প্রমুখ।

সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশীপ আরোপের ফলে ঢাকার সাথে যোগাযোগ কঠিন হয়ে পড়লেও গোলাম কিবরিয়া, নুর আলম জিকু, আঃ আজিজ খান, আঃ মজিদের প্রচেষ্টায় কুষ্টিয়ার সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলনকে সফল ভাবে পরিচালিত করেন। ঢাকার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন কুষ্টিয়াতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে পালিত হয়।

৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ভাষনের পর কুষ্টিয়ার নেতাকর্মী সেচ্ছাসেবক লীগের সাথে কুমারখালীর নুর আলম জিকু সহ আরো অনেকের সহায়তায় মিল পাড়াতে আনসার ও পুলিশের অস্ত্রের সাহায্যে ছাত্রদের এবং রমাবাবুর বাড়িতে ছাত্রীদের অস্ত্র প্রশিক্ষন গোপনে চলতে থাকে।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকা থেকে প্রথম কুষ্টিয়াতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে আসেন এম,এ বারী, শামসুল আলম দুদু, জাহেদ রুমী, মোস্তফা আজাদ, জাহিদ হোসেন জাফর প্রমুখ ছাত্রনেতারা একটি পরিকল্পনা সভা করেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পান্টি ও কুমারখালীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

আয়নুল দর্জি ও মসলেম দর্জি কুমারখালীতে পতাকা তৈরী করেন এবং রেজাউল করিম হান্নান বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্রটি আঁকেন। কুমারখালীর গনমোড়ে সকালে গোলাম কিবরিয়া, আব্দুল মজিদ, আব্দুল আজিজ খান, প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এবং আ,স,ম ওয়াহেদ পান্না, নন্দগোপাল, পরিমল প্রমুখ ছাত্রনেতা সহ জনসমাগমের মধ্যে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক রেজাউল করিম হান্নান বাংলাদেশের পতাকা তোলেন।

অপরদিকে পান্টিতে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা পতাকাটি এম,এ বারী মাওলানা তোফাজ্জেল হোসেন, আব্দুল জলিল মোল্লা, আঃ রাজ্জাক মিয়া, জাহিদ হোসেন জাফর, বাদশা মিয়া প্রমুখের উপস্থিতিতে পান্টি স্কুলের সামনে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলেন।

Add comment

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.