বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

প্রাচীন যুগের কুষ্টিয়ার ইতিহাস
প্রাচীন যুগের কুষ্টিয়ার ইতিহাস

খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে বিখ্যাত ভৌগোলিক টলেমীর মানচিত্রে গঙ্গা-নদীর অববাহিকায় কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ দেখা যায়। এই ক্ষুদ্র দ্বীপাঞ্চলকে কুষ্টিয়া অঞ্চল মনে করা হয়। গঙ্গা অথবা অন্য জলময় স্থানের বুক থেকে জেগে উঠা এই উর্বর দ্বীপাঞ্চলে দক্ষিণবঙ্গ থেকে পুন্ডু, বা পোদ জাতি এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে অন্যান্য জাতির লোকেরা চাষাবাদ কিংবা প্রচুর মৎস্যলাভের আশায় দলে দলে এসে বসতি স্থাপন করেছিল বলে অনুমিত হয়। ভারতকোষগ্রন্থে কুষ্টিয়া অঞ্চল সন্মন্ধে বলা হয়েছেঃ “নদীবিধৌত গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্ছলের পলিগঠিত সমভূমিতে অবস্থিত বলিয়া ইহার মৃত্তিকা অত্যন্ত উর্বর ও কৃষির পক্ষে উপযোগী। সুতারাং কৃষি উপযোগী ভূমি আর অসংখ্য নদী-নালা খাল-বিলে প্রচুর মৎস্য - এই দুটির আকর্ষণেই যে এ অঞ্চলে কৃষিজীবী এবং মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের আগমন ঘটেছিল এ অনুমান যুক্তিসঙ্গত।

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষে এবং চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমভাগে পূর্ববাংলায় সমতট ও পশ্চিমবাংলায় পুস্করণ রাজ্য অথবা পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্তশাসনামলে কুষ্টিয়া অঞ্চলের কোন ইতিহাস জানা যায় না। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দিতেও এ অঞ্চলের ইতিহাস অজ্ঞাত। বাংলাদেশে সমতট বঙ্গ ও গৌড় এই তিনটি রাজ্যের শাসনামলে কুষ্টিয়া অঞ্চল কোন সময়ে সমতট আবার কোন সময়ে গৌড়ের শাসনভুক্ত ছিল। এ তিনটি রাজ্যের সীমা নির্ণয়ে ঐতিহাসিকগণ একমত হতে পারেননি।

রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক য়ূয়ান চুয়াং বাংলাদেশ ভ্রমন করে যে বিবরণ দান করে গেছেন তা থেকে জানা যায় যে তৎকালীন বঙ্গরাজ্য কামরূপ, পুন্ডূবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, সমতট ও তাম্রলিপ্তি এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত ছিল। কুষ্টিয়া অঞ্চল সপ্তম শতাব্দীতে শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল বলে অনুমিত হয়। শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের সীমান্ত থেকে কয়েক মাইল দূরে মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত ছিল। কোন রাজা রাজ্যের সীমান্তে রাজধানী স্থাপন করেন বলে প্রমান পাওয়া যায় না। সমতট রাজ্যটি যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়ায় আবিষ্কৃত শিলালিপি থেকে খ্রিষ্টীয় যষ্ঠ শতাব্দিতে দক্ষিণবঙ্গে মহারাজাধিরাজ গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও নরেন্দ্রাদিত্য সমাচারদের নামে তিনজন রাজার রাজত্ব করার কথা জানা যায়। ধর্মাদিত্যের একটি তাম্রশাসনে জানা যায় যে তাঁর রাজত্বকালে গৌড়ের অংশবিশেষের রাজা ছিলেন স্থানুদত্ত। এই “গৌড়ের অংশবিশেষ” স্থান কুষ্টিয়া অঞ্চল ছিল বলে অনুমিত হয়।

অষ্টম শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালবংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠাপর্বে বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ ও সামন্ত রাজাদের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের ফলে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। গোপালদের পাল ৭৫০ সালে পাল রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর কুষ্টিয়া অঞ্চল তাঁর রাজ্যভুক্ত হয়। পাল রাজত্বের অবসানকালে (দশম শতাব্দীর শেষাংশ) পর্যন্ত এ অঞ্চল পাল রাজ্যভুক্ত ছিল।

দশম শতাব্দীর শেষে এ একাদশে শতাব্দীর প্রারম্ভে পাল রাজত্বের অবসানপর্বে কয়েকজন সামন্তরাজা বিশেষ শক্তি অর্জন করেছিলেন। এ সময় কুষ্টিয়া অঞ্চল কিছুকালের জন্য বিক্রমপুর-হরিকেলে স্থাপিত চন্দ্রবংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ফরিদপুর জেলার কেদারপুর গ্রামে আবিষ্কৃত ইদিল্পুর প্ট্রলিতে বিক্রমপুর-হরিকেলে চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের “কুমারতালক মণ্ডলে” এবং “সমতট পদ্মাবতী বিষয়ে” একখণ্ড ভূমিদানের কথা জানা যায়। ডঃ নীহাররঞ্জন রায় “কুমারতালক মণ্ডলকে” কুমার নদী তীরবর্তী অঞ্চল বলতে চেয়েছেন। “পদ্মাবর্তীও পদ্মা নদীরুপে পরিচিত” সুতারাং তাঁর এ অনুমান যুক্তিপূর্ণ। কুমার নদ কুষ্টিয়া জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল। কুষ্টিয়া অঞ্চল পরিত্যাগ করলেই তাঁর নাম মধুমতি ছিল। সুতারাং কুষ্টিয়া অঞ্চল বাংলায় সেন রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্বে বিক্রম্পুর-হরিকেলের চন্দ্রবংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হওয়ার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য।

দশম শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ভারতের কর্ণাট থেকে আগত চন্দ্র বংশীয় ক্ষত্রিয় রাজা সামন্ত সেন বাংলায় সেন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় সেন রাজবংশের পায় পৌনে দুইশত বছর শাসনকালে কুষ্টিয়া জেলাঞ্চল তাঁদের শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতকোষে উল্লেখ করা হয়েছে “পূর্বকালে ইহা (কুশ্তিয়া-লেঃ) সেনরাজগণের রাজত্বধীন ছিল”। সেন রাজত্বের সূচনাপর্বে উত্তরবঙ্গে কৈবত্য নেতা দিব্যক কিছুদিনের জন্য যে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কুষ্টিয়া তার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সেনবংশের শেষ নরপতি লক্ষণসেন গৌড় থেকে রাজধানী পরিবর্তন করে নদীয়ায় আসেন। তিনি প্রায় তিরিশ বছর রাজত্ব করেন। লক্ষণসেনের রাজত্বকালে ১২০১ মতান্তরে ১২০৩ সালে বিহার থেকে ঝাড়খন্ডের পথে ইখতিয়ারউদ্দিন মহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী নামক একজন তুর্কি মুসলিম সেনাপতি মাত্র সপ্তদশ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে লক্ষ্মণসেনের রাজধানী নদীয়া দখল করেন। বখতিয়ারের পিছনে সেনাবাহিনী ছিল কিন্তু মাত্র সতের জন অশ্বারোহী তার সঙ্গে দ্রুত আসতে সক্ষম হয়েছিল। বখতিয়ারের নদীয়া দখলের চল্লিশ বছর পর মিনহাজ-উস-সিরাজ রচিত “তবাকাত-ই-নাসিরী” গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে মাত্র অষ্টাদশ অশ্বারোহী সৈন্য নদীয়া নগরীতে প্রবেশ করলে তাঁদেরকে তুর্কি অশ্ববিক্রেতা মনে করে কেহ বাধা দান করেনি। বখতিয়ার ‘রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়েই আক্রমণ করেন। সে সময় ‘রায় লছমণিয়া’ আহারে বসেছিলেন। তিনি মুসলমান আক্রমণের কথা শ্রবণ করে পুত্র-মহিলা, ধন-রত্ন-সম্পদ, দাস-দাসী পরিত্যাগ করে অন্তঃপুরের দ্বার দিয়ে নৌকাপথে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন। বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া বিজয় সন্মন্ধে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় সন্দেহ পোষণ করেছেন কিন্তু আর কোন ঐতিহাসিক তাঁর মত সমর্থন করেননি। এ সন্মন্ধে এবিএম, হাবিবুল্লাহ বলেনঃ For bakhtyar’s occupation of a portion ot the sena kingdom following his raid on Nodia is undisputed fadt. নদীয়ায় লক্ষ্মণসেনের রাজপ্রাসাদ বখতিয়ার মাত্র সতের জন সৈন্য নিয়ে দখল করলেও নদীয়া নগরী তাঁর সেনাবাহিনী দখল করেছিল। লক্ষ্মণসেনের বার্ধক্যজনিত কারণে রাজকার্যে অবহেলা, অমাত্যবর্গ ও রাজমহিষীর নানা ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতি সম্ভবত রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল করে ফেলে যার ফলে তুর্কি আক্রমণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে।

লক্ষ্মণসেনের পূর্ববঙ্গে কয়েক বছর রাজত্ব করার পর মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কেশবসেন ও বিশ্বরূপসেন পর্যায়ক্রমে প্রায় তিরিশ বছর রাজত্ব করেন। এঁদের পর এই বংশের পতন হয়। বখতিয়ার নদীয়া দখল করে গৌড়ে গমন করেন। সেখান থেকে তিনি তিব্বত অভিযান করে ব্যর্থ হয়ে কোনমতে প্রাণ নিয়ে ফিরে এলে আলী মর্দান খিলজী নামক তাঁর এক পার্শ্বচর কতৃক ১২০৬ সালে নিহত হন। বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় মুসলিম শাসনের কোন স্থায়িত্ব অর্জন করতে পারেনি তাঁর নদীয়া বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পর মুগীসউদ্দিন য়ুজবুক পুনরায় নদীয়া দখল করেন। বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া বিজয়ের প কুষ্টিয়া অঞ্চল মুসলিম শাসনে এসেছিল। নদীয়ায় বাংলার প্রথম মুসলিম শাসনের যে সূত্রপাত হয় তা প্রায় ছয়শত বছর স্থায় হয়েছিল। বাংলাদেশে মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় বখতিয়ার খিলজীর নদীয়া বিজয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেন রাজত্বকালের বিশেষ কোন স্মৃতিচিহ্ন কুষ্টিয়া অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়নি। মেহেরপুর মহকুমার আমদহের মাঠে এই আমলের একটি মন্দিরের স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়। তবে বর্তমান নদীয়ায় সেন আমলের বেশকিছু স্মৃতিচিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে বলে মোহিত রায় লিখিত “নদীয়ার পুরাতত্ত্ব” (১৯৭৫ সালে প্রকাশিত) গ্রন্থ পাঠে জানা যায়।

তথ্য সংগ্রহ্যঃ-
ভারতকোষ, দ্বিতীয় খন্ড, ১ম সংস্করণ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলিকাতা, ১৩৭৩, পৃষ্ঠাঃ ৩৭৮
বাংলায় ভ্রমণ, ১ম খন্ড, ২য় খন্ড সং, ১৯৪০, পৃষ্ঠাঃ ২
রাখাল দাস বঙ্গোপাধ্যায়ঃ বাংলার ইতিহাস ১ম খন্ড ১৯৭১, পৃষ্ঠাঃ ২৪০
ডঃ নীহার রঞ্জন রায়ঃ বাংলার নদ-নদী, পৃষ্ঠাঃ ২৮

Add comment

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.