দরবেশ লালমিয়া সাঁই, ০৬ চৈত্র ১৩০৯ বঙ্গাব্দ, ২০ মার্চ ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দ, রোজঃ শুক্রবার, প্রথম প্রহরের ব্রহ্মমুহূর্তে ধরাধামে আগমন করেন। তার পিতাঃ জনাব নতুবুল্লাহ্ সরকার, মাতাঃ মোছা: তুষ্ট বেগম। দরবেশ লালমিয়া সাঁইজি লালটকটকে আর সৌম্যকান্তি চেহারার অধিকারী ছিলেন বলে তার দাদা-দাদী নাম রাখেন "লালমিয়া"। মা বাবা এবং পরিবারের লোকজন তাকে আদর করে "লালু" বলে ডাকতেন।
পারিবারিক আর ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী, ৭ বছর বয়সে লালমিয়া ওরফে লালুকে খাতনা করানো হলো। লালমিয়া সাঁইজি'র বাবাও একজন মারেফতের ফকির ছিলেন। তাই ছেলের খাতনা উপলক্ষে বাড়িতে বাউলগান ও সাধুসংগের আয়োজন করলেন। রাতব্যাপি গান বাজনা হলো, পরদিন সকালে সাধু-সন্ত, বাউল-ফকিরেরা বিদায় নিলেন। তাদের পিছু পিছু ছোট্ট লালুও বাড়ি ছাড়লেন। বাউল ফকিররাও বুঝতে পারেননি যে লালু তাদের সাথে এসেছে। এদিকে বাড়ির লোকেরা লালুকে খুজে না পেয়ে কান্নাকাটি করলেন। আর সব জায়গায় খোজ নিলেন। তখনকার দিনে, এত গাড়ি ছিলনা বলে বাউল-ফকিরদেরও গন্তব্যে পৌছাতে রাত হয়ে গেল। কোন একজন টের পেল যে; ছোট্ট লালুও তাদের সাথে চলে এসেছে। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে, তাই সকালে তারা লালুকে বাড়িতে ফেরত দিতে গেলেন। লালুকে ফিরে পেয়ে বাবা মা সহ পরিবারের লোকজন আনন্দে আত্মাহারা হয়ে পড়লেন। বলে রাখা ভালো যে লালুর ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো গানের গলা ছিলো, তাছাড়া বাউলগান এবং বাউলদের প্রতি ছিল গভীর আগ্রহ আর অসীম শ্রদ্ধাবোধ। এদিকে বাউল-ফকির আর গানের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখে বাবা নতুবুল্লাহ সরকার কোন এক বাউল-ফকিরের কাছে ছেলেকে সমর্পন করেন, লালু আবার চলে যান বাউলদের সাথে।
এভাবেই শুরু হয় দরবেশ লালমিয়া সাঁইজি'র বাউল ফকিরি জিবন। দরবেশ লালমিয়া সাঁইজি ১১৩ বছরের জিবনের প্রায় ৮০/৮৫ বছর শুধু লোকগান চর্চা করেছেন। মহাত্মা ফকির লালন সাথে যারা উঠাবসা করেছেন, লালন সাঁইজিকে দেখেছেন এরকম অনেক লালনশিষ্য ও প্রবীণ বাউল-ফকিরদের সাথে "দরবেশ লালমিয়া সাঁই" সঙ্গ করেছেন। সেই সুবাদে তিনি লালন ফকিরের অসংখ্য পদাবলী কন্ঠে এবং স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেন। আদিভাব এবং সুরে লালনগীতি গাওয়াকে তিনি পরমপুণ্যের কাজ মনে করতেন। তিনি পাঞ্জু শাহ, কবি জালালুদ্দিন খাঁ, আহসান আলী খন্দকার, রজ্জব দেওয়ান, হালিম খন্দকার, ভবা পাগলা সহ, অনেক সাধকের সাহচর্য্য লাভ করেছিলেন। এ ছাড়াও জ্ঞানার্জন এর উদ্দেশ্যে ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন সাধুগুরুর আঁখড়া/দরবার, তীর্থস্থান ও ধর্মপীঠ ভ্রমন করেন।বাউল-ফকিরি মতবাদ, সুফিবাদ ও লালনভাবচর্চা প্রচার প্রসারের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, ১৯৮৯ সালে "মুক্তিধাম আখড়াবাড়ি ও দরবার শরিফ" নামে একটি আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত আখড়াবাড়িটি সম্পুর্ণ ধুমপান/মাদকমুক্ত, অরাজনৈতিক, অসামপ্রদায়িক, ও প্রগতিশীল ওয়াকফ্কৃত লালনভাবচর্চা কেন্দ্র। দরবেশ লালমিয়া সাইজি জাতি-ধর্ম, গোত্র, সম্প্রদায় ভেদাভেদ একদম পছন্দ করতেন না। সকল পরিচয় ছাপিয়ে, নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
দরবেশ লালমিয়া সাঁই; ওয়াহেদানিয়াত মোতাবেক, তরিক্বাঃ আল-চিশতিয়া, খান্দানে নিজামীয়া ও লালন ঘরানায় খিলক্বা-খেলাফত প্রাপ্ত একজন সাধু/ফকির ছিলেন। তার গুরুর নামঃ-
"দরবেশ তৈয়ব শাহ্ => দরবেশ ফকিরচাঁন শাহ্ => ফকির আব্দুর রশিদ (আব্দুল) শাহ্ => ফকির পাঁচু সাঁই => মহাত্মা ফকির লালন সাঁই।
দরবেশ লালমিয়া সাঁইজি ১১৩ বছর বয়সে গত ১১ শ্রাবণ ১৪২৩ বঙ্গাব্দ মোতাবেক, ২৬ জুলাই ২০১৬ খ্রীস্টাব্দে অসংখ্য শিষ্য-ভক্ত, আশেকান, মুরীদান ও গুণগ্রাহী রেখে দেহত্যাগ করেন। বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার অন্তর্গত দৌলতপুর গ্রামের কলেজপাড়ায়, "মুক্তিধাম আখড়াবাড়ি ও দরবার শরিফ" প্রাঙ্গণে তার সমাধি (মাজার) রয়েছে।
তথ্য কৃতজ্ঞটাঃ- আনান বাউল