অষ্টদশ শতাব্দীর পূর্বে যাতায়াত ও যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল স্বল্পগতিসম্পন্ন পশুতে টাকা গাড়ি, মানুষে টাকা পালকি, পাল তোলা নৌকা ইত্যাদি। বাস্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন যানবাহনের সাহায্যে যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত হতে থাকে। আজকের দিনে টেলিফোন, মুঠোফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট যোগাযোগের গতি, আলোর গতির সমানে এনে দিয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সারা পৃথিবী যেন মুঠোর মধ্যে। এতদ্বসত্ত্বেও কোনো দেশেই রেলের গুরুত্ব হ্রাস পায়নি। বরং স্বল্প খরচ, নিরাপদ, আরামদায়ক যাতায়াত হিসেবে জাপান, ভারত, চীন, ইউরোপ, আমেরিকা রেলের গতি বৃ্দ্ধিতে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করে চলছে। পর্যায়ক্রমিক পালের গতি, অশ্বের গতি, ইঞ্জিনের গতি এবং বর্তমান ব্যবহৃত আলোর গতি সভ্যতা বিকাশের ধারাবাহিক পরিমাপক।
এর মধ্যে অষ্টাদশ শতকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যবহার কেবলমাত্র ২ শতকে ৫ হাজার শতকের অর্জিত সম্পদ ও শক্তিকে পশ্চাতে ফেলে দেয়। বিকাশ না ঘটলে ঘটত না শিল্প বিপ্লব। আর শিল্প বিপ্লব না ঘটলে আজকের চাকচিক্যময় দুনিয়া আমরা দেখতে পেতাম না। একসময় রেলই ছিল পৃথিবীর দ্রুততম বাহন। রেলের উদ্ভাবন ও ব্যবহার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে আসছে। ১৭৬৩ সালে জেসম ওয়াট বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিস্কার করেন। এরই সূত্র ধরে ১৮০৪ সালে প্রথম রেলের ইঞ্জিন তৈরি করেন রিচার্ড ট্রিভিসিক। ম্যাথুমুড়ে দাঁতওয়ালা রেললাইনের উপর খাঁজকাটা চাকার রেল ইঞ্জিন চালিয়ে দিলেন ১৮১২ সালে। এরপর স্কটল্যন্ডের জর্জ স্টিফেনস ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে চুড়ান্তভাবে রেলের জন্য স্টিম ইঞ্জিনের উন্নয়ন সাধন করেন এবং ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম রেল পরিবহন উদ্বোধন করা হয়। ১৮৩০ সালে লিভারপুর হতে ম্যানচেস্টার পর্যন্ত ৩৫ মাইল রেলপথ খোলা হলে বিশ্বে প্রথম ভাড়ার বিনিময়ে রেলগাড়ি চালু করা হয়। তার ইঞ্জিনের নাম ছিল রকেট।
ইউরোপে তখন পুনর্জাগরণ। শিল্প বিপ্লবের যুগ। অতিসত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রেল যোগাযোগ শুরু হল। ১৮২৯-এ আমেরিকা, ১৮৩৪-এ আয়ারল্যান্ড, ১৮৩৫-এ জার্মানি, ১৮৩৭-এ রাশিয়া, ১৮৩৯-এ ইটালি, ১৮৪৮-এ স্পেন, ১৮৫৬-এ সুইজারল্যান্ড, ১৮৫৩-এ ভারতবর্ষ, ১৮৫৪-এ আফ্রিকা, ১৮৭২-এ জাপান, ১৮৭৫-এ চীন রেল স্থাপিত হয়। তখন সমগ্র ইউরোপে রেনেসাঁর যুগ। রেলপথ এসে তা তরান্বিত করেছিল।
ভারত তখন বৃটিশের উপনিবেশ। শাসন ও ব্যবসার যৌক্তিকতায় বৃটিশ সরকার ভারতে রেল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের তৎকালীন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি এ উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের আর এস স্টিফেনসন এন্ড কোম্পানির রেললাইন বসানোর আলোচনা করেন। ১৮৪৪ বড়লাটের দরবারে স্থীর সিদ্ধান্ত হল যে, ভারতে রেল বসবে। এ বিষয়ে কোম্পানির সাথে চুক্তি হল। যথারীতি কাজ শুরু হয় এবং ১৮৪৫ সালের ১৬ এপ্রিল বোম্বের বোরিবন্দর স্টেশন থেকে ১৪ খানা কোচে ২১ মাইল দূরবর্তী স্টেশনে যায় এবং বোরিবন্দর ফিরে আসে। সেদিন সবাই অবাক বিস্ময়ে রেলগাড়িকে দেখেছিল, দেখেছিল দ্রুতগামী বাহন রেলের চালনা। বিজ্ঞান মানুষকে এনে দিয়েছে গতি যা জীবনকে করেছে সহজ আর উন্নয়নকে করেছে দ্রুতগামী। রক্ষণশীল গোঁড়া ধার্মিকেরা বিধান করেছিল যে, রেলগাড়ি চড়া পাপ এবং চড়লে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। বিজ্ঞানের অবদান কেউ কখনো ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি এবং পারা সম্ভব নয়। কারণ উন্নয়নই সভ্যতার অগ্রগতি। আর এর মূলে রয়েছে বিজ্ঞানের মতো সব আবিস্কার ও উদ্ভাবন।
আমাদের বাংলাদেশ সীমানায় রেল স্থাপন পরিকল্পনা শুরু হয় ১৮৫২ সালে ১৮৫২ সালে জে, পি, কেনেডি সুন্দরবন থেকে ঢাকা পর্যন্ত রেল সম্প্রারণের প্রস্তাব করেন। অতঃপর ১৮৫৫ সালে লে. গ্রেট হেড সার্ভে রিপোটে দুটি রুটে রেল লাইন স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবটি কলিকাতা ভায়া যশোর-ফরিদপুর এবং দ্বিতীয় প্রস্তাব কলিকাতা ভায়া-কুষ্টিয়া-গোয়ালন্দ হয়ে ঢাকা। প্রথম প্রস্তাবটি ১৪টি বড় বড় নদী ও অন্যান্য কারণে বাতিল হলে দ্বিতীয় প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। এ প্রস্তাবের বাস্তবায়নে ১৮৫৭ সাল থেকে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলিকাতা-কুষ্টিয়া পর্যন্ত ব্রডগেজ একক লাইন নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৮৫২ সালে রানাঘাট-জগতির মধ্যে প্রথম ট্রাফিক চলাচলের জন্য লাইন খুলে দেওয়া হয়। ১৮৬২ সালে যে রেলপথ শিয়ালদা স্টেশন থেকে জগতি স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে ছিল। এক পর্যায়ে ১৮৭০ সালে গড়াই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি তা গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।
রাজবাড়ি অংশে রেলপথ পাংশা থেকে কালুখালির বর্তমান স্টেশন থেকে দুই কিলোমিটার উত্তর দিয়ে বহর কালুখালি হয়ে ধাওয়াপাড়ার ঘাট বরাবর ছিল। উক্ত রেলপথ বর্তমান রাজবাড়ি শহরের উত্তর দিক দিয়ে পূর্ব পথে জামালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এখনো কোনো কোনো স্থানে তার স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। জামালপুরই ছিল তখন গোয়ালন্দ ঘাট যাকে গ্যাঞ্জেস বন্দর বলা হত। ‘পোড়াদহ হতে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে গোয়ালন্দ পর্যন্ত যখন রেলপথ বিস্তৃত হয় ঐ সময় বহর-কালুখালির ঠিক মধ্যদেশ দিয়া রেললাইন যায়। বহর কালুখালি বর্তমান কালুখালি স্টেশন থেকে ৫ কিমি উত্তরে।
তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ- ইস্পাতের পথ - শফিকুল ইসলাম, আমার স্মৃতিকথা - ত্রৈলোক্যনাথ।