যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ( জন্মঃ ৭ ডিসেম্বর, ১৮৭৯ - মৃত্যুঃ ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫) ১৮৭৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালির গড়াই নদীর তীরে কয়া গ্রামে মাতুল তলায় জন্মলাভ করেন বিপ্লবী বাঘা যতীন (Bagha Jatin)। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী নেতা। তিনি বাঘা যতীন নামেই সকলের কাছে সমধিক পরিচিত।
তাঁর প্রকৃত নাম জ্যোতিন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (Jatindranath Mukherjee)। পিতা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মাতা শরৎশশী। পৈত্রিক বাড়ী ছিল ঝিনাইদহ জেলায়। মাত্র ৫ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হয়। এর পর তার মা তাদের নিয়ে যান তাঁর বাবার বাড়ি কুষ্টিয়ায়। মা ছিলেন স্বভাবকবি। যতীনের বড় মামা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরদের শিলাইদহের জমিদারীর আইনজীবী।
যতীন ছেলেবেলা থেকেই শারিরীক শক্তিতে অন্যতম ছিলেন। গ্রাম হতে দুই কিলোমিটার দূরে রাধারপাড়া মাঠের আখ ক্ষেতে ছুরি দিয়ে বাঘ হত্যা করে নিজেকে রক্ষা করায় তার নাম হয়েছিল বাঘা যতীন। যতীন এবং বাঘ।
ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বাঘা যতীন ছিলেন বাংলার প্রধান বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর দলের প্রধান নেতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে কলকাতায় জার্মান যুবরাজের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করে তিনি জার্মানি থেকে অস্ত্র ও রসদের প্রতিশ্রুতি অর্জন করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মান প্লট তাঁরই মস্তিস্কপ্রসূত।
শিক্ষাজীবন-
কয়া থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কৃষ্ণনগরের অ্যাংলো ভার্নাকুলার হাই স্কুল হতে ১৮৯৮ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে ছাত্রাবস্থায় বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হন। যুগান্তর দলের নেতা হয়ে তিনি দলকে আরও সুসংগঠিত করে বিপ্লবী অনুশীলন দলের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলেন। বিপ্লবের এক পর্যায়ে বাংলায় আসা তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তখন তিনি অবস্থান নেন উড়িষ্যার কাপ্তিগোদায়।
বিপ্লবীজীবন-
কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজের পাশেই বাস করতেন স্বামী বিবেকানন্দ। দেশে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবে স্বামী বিবেকানন্দের আহব্বানে রোগীদের সেবায় নিয়োজিত হন।
কর্মজীবন-
১৮৯৯ সালে মফ:ফরপুরে ব্যারিস্টার কেনেডীর সেক্রেটারী হিসাবে কাজে যোগ দেন। কেনেডী ভারতের বিভিন্ন গবেষনার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কেনেডির উৎসাহে যতীন এলাকার তরুনদের ফুটবল ক্লাব গড়ে তোলেন। কেনেডি দুর্ভাগ্যক্রমে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর ছোড়া বোমায় মারা যান। কেনেডির সুপারিশে বাংলা সরকারের অর্থসচিব হেনরি হুইলারের স্টেনোগ্রাফার হিসাবে নিয়োগ পান।
১৯০৩ সালে শ্রী অরবিন্দের সাথে পরিচিত হয়ে বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯০৬ সালে বারীন ঘোষের সঙ্গে বোমা তৈরীর কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৭ সালের হুইলারের সাথে দার্জিলিংয়ে বদলি হলেন। ১৯০৮ সালে চারজন সামরিক অফিসারের সাথে শিলিগুড়ি স্টেশনে মারপিট হয় যা নিয়ে মামলা হয়। ১৯১০ সালের ২৭ জানুয়ারি হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলায় যতীনকে গ্রেপ্তার করা হল। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঝিনাইদহে ঠিকাদারের ব্যবসা শুরু করেন যশোর ঝিনাইদহ রেলপথ।
যতীন বালেশ্বরে পলায়নে থাকা অবস্থায় সারা দেশে শুরু সন্ধান যতীন জানালেন :
“আর পালানো নয়। যুদ্ধ করে আমরা মরব। তাতেই দেশ জাগবে”
উড়িষ্যার মহাফেজকানার রক্ষিত নথিপত্র উদ্ধার করতে গিয়ে যতীন তার সঙ্গী সহ সশস্ত্র পুলিশের মুখোমুখি হলেন। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সূর্যাস্তের সংগে শেষ হল এই যুদ্ধের। যুদ্ধে আহত যতীন বালেশ্বর সরকারী হাসপাতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন পরেরদিন।
হাসপাতালে রক্তবমির মধ্যে হাসতে হাসতে বলেছিলেন :
“এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পন করে গেলাম দেশমাতার চরণে”
ব্যক্তিগত জীবনে- মৃত্যুর পূর্বে তার মা-এর নির্ধারীত ইন্দুবালা দেবীকে বিয়ে করেন। একে একে অতীন্দ্র, আশালতা, তেজেন্দ্র এবং বীরেন্দ্র ৪ টি সন্তানের পিতা হন তিনি।