বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াস্থ লালন শাহের মাজারের হালচাল
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াস্থ লালন শাহের মাজারের হালচাল

স্বার্থান্বেসী মহলের ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকার, সত্যান্বেষণ এবং একটি পর্যালোচনা

কুষ্টিয়া শহর সংলগ্ন কুমারখালী থানাধীন ছেঁউড়িয়া গ্রামের বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের মাজার বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান। জাতি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে মানুষ ও মানবতার জয়গান গেয়ে গেছেন মরমী সাধক ফকির লালন শাহ। তাইতো লালন গান বিশ্ব জুড়ে মানবতাবাদের অমোঘ বাণী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং লালন ফকিরের স্মৃতিবিজড়িত ছেঁউড়িয়ার লালন মাজার আজ সমগ্র বিশ্বে সুপরিচিত একটি ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। আর লালন অনুসারী ও বাউল সম্প্রদায়ের কাছে এটি তো রীতিমতো তীর্থস্থান হিসেবে পরিগণিত।

বছরের প্রধানতম দুইটি লালন অনুষ্ঠান দোল পূর্ণিমার 'লালন স্মরণোৎসব' এবং ১লা কার্তিকের 'লালন তিরোধান দিবস' এর তিনদিনব্যাপী জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং বহির্বিশ্ব থেকে লাখ লাখ লালন অনুরাগী, ভক্ত, বাউল, সাধু, গুরু এবং দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মাজার প্রাঙ্গণ আর এতদসংশ্লিষ্ট সমগ্র এলাকা। এছাড়াও বছরের প্রায় প্রতিটি দিনই এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের 'শিক্ষা সফর', বিভিন্ন আনন্দ ভ্রমণ এবং দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। আর এ সবকিছু মিলিয়েই অজোপাড়াগাঁ ছেঁউড়িয়ার লালন মাজার কেবলমাত্র 'শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী' খ্যাত কুষ্টিয়া জেলা নয় বরং সমগ্র বাংলাদেশের এমনকি অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী বাঙালী জাতিস্বত্ত্বার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে।

আবহমান কাল থেকেই লালন ঘরানার সাধু-গুরু-ভক্তদের ধ্যানমগ্নতা, যৌন অবদমন একটি সঙ্গীতচর্চার একটি অনুসঙ্গ হিসেবে তামাক বা গাঁজা সেবনের (সাধুদের ভাষায় সিদ্ধি) প্রচলন রয়েছে। লালন মাজারকে ঘিরে তথা বাউল সংস্কৃতির সাথেই ওতপ্রোতভাবে সিদ্ধিসেবনের বিষয়টি জড়িত এবং এটি সর্বজনবিদিত। তামাক বা গাঁজা যেহেতু মাদকদ্রব্যের অন্তর্গত তাই এটির খোলামেলা যথেচ্ছ ব্যবহার এবং ব্যবসার বিরুদ্ধে সবসময়ই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারী এবং নিয়ন্ত্রণ থাকে। যদিও বছরের দুইটি লালন অনুষ্ঠানের সময়কালে অলিখিতভাবে প্রশাসন লালন মাজার সংলগ্ন মাঠ এবং তদসংলগ্ন এলাকাসমূহে লালন ভক্তদের তামাক সেবনের উপর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করেন। বহু বছর ধরে এমনটিই হয়ে আসছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, লালনের মাজারের মূল অংশ যেহেতু সমাধিস্থল তাই সেটি সবসময়ের জন্যই পুরোপুরি ধূমপানমুক্ত এলাকা।

সম্প্রতি বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করা গেছে, লালন মাজার সংলগ্ন মাঠ ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে 'প্রচারে এলাকাবাসী'র ব্যানারে কতিপয় যুবক মাদক নির্মূলের নামে আগত বাউল, সাধু ও লালন অনুসারীদের অপমান, অপদস্থ, শারিরীক নির্যাতন এবং টাকাপয়সা, মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাতে ব্যাপক তৎপর। তারা এ ব্যাপারে 'মাদকবিরোধী মানব বন্ধন' করেছে এবং মাজার প্রাঙ্গণে "ইয়াবা গাঁজা সহ সকল প্রকার মাদক বেচা কেনা ও সেবন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ" মর্মে ডিজিটাল ব্যানার টাঙিয়েছে। যা দূর দূরান্ত থেকে আগতদের লালন মাজার এলাকা সম্পর্কে প্রথমেই একটা বিরূপ ধারণা দিচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে এটিকে বেশ প্রশংসনীয় উদ্যোগ মনে হলেও এর নেপথ্যে স্থানীয় একটি স্বার্থান্বেসী মহলের ঘোলাজলে মৎস্য শিকার টাইপ চক্রান্ত কাজ করছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।

মাদকদ্রব্যের ভয়াল বিস্তার আমাদের দেশের একটি সামাজিক ব্যাধি এবং সমাজের সকল স্তরে মাদকের ব্যবসা বা ব্যবহার অবশ্য প্রতিরোধযোগ্য। শুধু কুষ্টিয়ার লালনের মাজার কেন সমাজ, শহর, গ্রাম তথা গোটা দেশ থেকেই সর্বপ্রকার মাদকের ভয়াল থাবা প্রতিরোধে সচেতন নাগরিক মাত্রই অকুণ্ঠ সমর্থন জানাবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, লালনের মাজার এলাকায় হঠাৎ করে এহেন অতি উৎসাহী মুষ্টিমেয় যুবকের 'মাদকবিরোধী তৎপরতা' এবং নির্মূলের নামে অভ্যাগতদের হয়রানী, নির্যাতন ও লুট সত্যিকার অর্থে মাদক নির্মূলের চেয়ে বরং মাদকের ব্যাপারে উল্টো তরুণ সম্প্রদায়কে উস্কে দিচ্ছে না তো! একই সাথে এহেন কর্মকান্ডে ঐতিহ্যবাহী লালন মাজারের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন করা হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। শুধু তাই নয় এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে সকল যুবক এই তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত তাদের অধিকাংশ নিজেরাই মাদক সেবন এবং কয়েকজন মাদক ব্যবসার সাথেও সরাসরি জড়িত। এমনকি এও জানা গেছে, এই গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতা ব্যক্তিবর্গ দীর্ঘদিন ধরে চলা লালন মাজার কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায়ী বিশেষ করে গাঁজা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত সিগারেট কোম্পানী 'আব্দুল্লাহ' এর একটি বিজ্ঞাপনের উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। একটি বিজ্ঞাপনে এমন বলা হয়েছিল যে, "No smoking; not even Abdullah"! এখানে আসলে ধূমপান থেকে বিরত থাকার জন্য আহবান জানানোর চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার কৌশল হিসেবে ধূমপায়ীদের 'আব্দুল্লাহ' ব্র্যান্ডের প্রতি আকৃষ্ট করানোর নীরব প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। তদরূপ লালন মাজার সংলগ্ন এলাকায় ডিজিটাল ব্যানার টাঙিয়ে 'মাদকবিরোধী আহবান' পক্ষান্তরে মাদকের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশেষত যুবসম্প্রদায়কে উস্কানি দেয়ার সামিল বলে সুশীল সমাজের অনেক মত দিয়েছেন। অর্থাৎ লালন মাজার সংলগ্ন এলাকা যে ইয়াবা গাঁজার মত মাদকদ্রব্যে সয়লাব উক্ত ব্যানারে যেন সে কথাই বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন সদা সক্রিয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে লালনের মাজার এলাকা তো আরো শক্ত অবস্থানে রয়েছে। উক্ত এলাকাসমূহে কুষ্টিয়া সদর থানা, কুমারখালী থানা, মিলপাড়া ফাঁড়ি, বাঁধবাজার পুলিশ ক্যাম্প নিয়মিত নজরদারী করে থাকে। পাশাপাশি Rab এর টহল দল এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিজস্ব বাহিনীর তৎপরতা তো রয়েছেই।

এখন প্রশ্ন হলো এতকিছুর পরও এলাকার মুষ্টিমেয় যুব সম্প্রদায়কে কেন হঠাৎ করে মাদক নির্মূলের ধূয়া তুলে অতি আগ্রহী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হলো? এবং সেই ভূমিকা প্রয়োগ করতে যেয়ে বাছবিচার ছাড়া আগত বাউল, লালন অনুসারী বা দর্শনার্থীদের লাঞ্ছিত এবং মওকা মতো তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, টাকাপয়সা ছিনতাইয়ের মতন ভায়োলেন্সের পথ বেছে নিতে হলো? তবে কি কুষ্টিয়ার চৌকস আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার প্রতি এই মুষ্টিমেয় যুবকশ্রেণী এবং তাদের মদদদাতারা অনাস্থার বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছেন!

এখানে আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত না করলেই নয়, সেটি হলো লালন দর্শন বেশীমাত্রায় অসাম্প্রদায়িক এবং জাত-পাত-কূল নির্বিশেষে সকল মানুষের বিশেষ করে সহজ মানুষ বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমমর্যাদায় বিশ্বাস করে। যে কারণে লালন অনুসারীরা বরাবরই ধর্মীয় গোঁড়া শ্রেণীর দ্বারা নিগৃহীত এবং বিতর্কিত। আজ থেকে প্রায় দেড়শ' দুইশ' বছর আগেও স্বয়ং লালন সাঁইজী তৎকালীন মুসলমান ও হিন্দু উভয় কট্টরপন্থীদের বিষোদগার ও রোষানলে পড়েছেন এবং তাদের দ্বারা বারংবার আক্রান্ত হয়েছেন। হালে বছর কয়েক আগে কুষ্টিয়ার পার্শ্ববর্তী পাংশা এলাকায় ধর্মীয় মৌলবাদীরা বেশ কয়েকজন লালন অনুসারীকে লাঞ্ছিত করে এবং তাদের লম্বা চুল কর্তন করে। এ ঘটনা গোটা দেশের প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল এবং তারা দেশব্যাপী আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিলেন।

এখনো এই বিশ্বায়নের যুগেও ধর্মীয় গোঁড়াবাদীরা সুযোগ পেলেই লালন দর্শনের প্রতি বিষোদগার ছুঁড়ে দেন এবং এসকল গোষ্ঠীর কাছে লালনের মাজার এখনো অচ্ছুৎ স্থান। তাই এরকম বাস্তবতায় লালনের মাজারকেন্দ্রিক যে কোন কুৎসা রটানো মানে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আসলে ধর্মীয় মৌলবাদীদের লালন শাহের মাজার সম্পর্কে খেপিয়ে তোলারই নামান্তর!

লালন মাজারকে সকল অনাচার, বিতর্ক আর দূর্নীতিমুক্ত রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিনম্র নিবেদন রইলো।

জয় গুরু। জয় হোক মানবতার। আলেক সাঁই।

তথ্য সুত্রঃ- দৈনিক আন্দোলনের বাজার ১৭ অক্টোবর, ২০১৭।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.