বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ক্লিক করুন অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালনের একতারা : সাম্য ও সম্প্রীতির প্রতীক
লালনের একতারা : সাম্য ও সম্প্রীতির প্রতীক

একতারা। তারের মধ্যে মনের আকুতি, হৃদয়ের অভিব্যাক্তি। তারের মধ্যে সুর ঝঙ্কারে বিলাপ অনুভূতি। মনের কাকুতিতে সমাজের জঞ্জাল দূর করার চেষ্টা। যা মানবতার এবং নৈতিকতার চেষ্টা হিসেবে সেই আদি সময় হতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন সাধক লালন সাঁই।

বাঙালি বসতির এই ভূখন্ড। যাকে নিজের স্বত্বা ও সংস্কৃতির ধারা দিয়ে চলতে দেয়া হয়নি কখনই। বিদেশি বণিকেরা তাদের শাসন-শোষণ এবং বাণিজ্যকে ধরে রাখতে গিয়ে আইন যেমন বদলেছে বারংবার, আবার ভিন দেশিদের আঁচার আঁচরণে কাছে আমাদের বশ্যতা শিকার করে নিতে হয়েছে বারবার। কালে কালে এমন অবস্থার জন্য শংকর জাতি বাঙালির বহুবিধ সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে নানান সংস্কৃতির আাঁচার ও উপাদান সমুহ।

কেউ এ থেকে তেমন ভাল কিছুকে গ্রহন করতে না পারলেও আমাদের গোঁড়ামী এবং কুসংস্কারের সাথে ভিন্ন সংস্কৃতিকে গুলিয়ে নেয়ার ফলে, সবাই যেন এক জঞ্জালে আবদ্ধ হয়ে গেছে। আমরা এই সমস্যার উত্তরণে যতটানা আমরা মনোযোগী হয়েছিলাম, তার চেয়ে মারামারি এবং হানাহানিতে নিজেদেরকে জড়িয়ে কলুষিত করেছি আমাদের সামাজিক মৌলিকতাকে বহুবার।

যে কারণে আমাদেরকে দমন করে ব্যবসার নামে শাসন ও শোষণ করতে গিয়ে বাঙালি সমাজে জন্ম দেয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার। এ সুযোগটা সহজে করা গেছে এই কারণে যে আমাদের ক্রোমজোমের কৌণিক নির্ভরতা কিন্তু পারস্পারিক সহানুভূতির না হয়ে তা ছিল সব সময় বিরোধী মনে। জাত পাতের ভিড়ে কুসংস্কার থেকে এসেছে গোঁড়ামী। জেঁদ থেকে জন্ম নেয়া রাগ এই জাত পাতের প্রভাব ঐ গতিকে আরো উস্কে দিয়েছে। ফলে কে আপন আর কে পর, তা বিচার না করে ‘নিজের ঘরে পরের বাস’ কে আমন্ত্রণ জানানোর ফলে গতিশীলতা পায় নাই আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সংস্কৃতির ধারা।

অথচ আমাদেরকে পাহাড়াদার বানিয়ে মওকা লুটেছে ঐ লুটেরা ভিনদেশিরা। নিরন্তর এই সমস্যার মোকাবেলা করতে গিয়ে ব্যাক্তি থেকে কোন সাধক, সাধক থেকে মহামানবেরা চেষ্টা করে গেছেন সেই আদিকাল থেকে। যে ধারাবাহিকতায় উপস্থিত ছিলেন গৌতম বুদ্ধ, আউল চাঁদ , নিগমানন্দ সরস্বতীর, কাঙাল হরিনাথ, রাজা রাম মোহন রায় ও মৌণী বাবা, মহাপ্রভুু নিমাই, নানক, কবির এবং তুলসী দাস আর বাউল সম্রাট লালন সাঁই। তেমনি ফিকির চাঁদ, বাউল মত, সহজিয়া, কর্তাভজা, আউল, বলরামভজা, ন্যাড়াভাবক, কিশোরী ভজনী, গোবরাহ, হযরতী, খুশী বিশ্বাস, গৌরবাদী, সাহেব ধনী নাগা, অবধূত, চূড়াধনী, তিলকবাসী এবং বৈষ্ণব মতবাদ তাদেরই সমভাবেরই নির্দেশন।

ঐতিহাসিক ও জীবনীকার বসন্ত কুমার পাল বলেছেন, বৈরাগ্য সাধনকারীদের মত লালন ভাব সাধকেরা, গোপী যন্ত্র বাজিয়ে ভিক্ষা বৃত্তি করে বেড়াতেন।বৈষ্ণবীয়দের পদাবলির আদলে মরমী সাধক লালন সাঁই এর বাউল গান আমাদের সমাজে বেশ জনপ্রিয় ছিল। যুগে যুগে মহত্ববানদের আগমন ঘটে পথ সৃষ্টিতে ভাবদর্শনের অনুভবতাকে ছড়িয়ে দিতে। মধ্যযুগে এসেছিলেন মহানুভব শ্রী চৈতন্য এবং আঠার শতকের প্রথম দিকে মহাত্মা লালন সাঁই। চৈতন্য ভাবদর্শে মানুষ পদাবলীর মাধ্যমে গোঁড়ামী এবং কুসংস্কারের যঁতাকল হতে মুক্তি পেতে চেয়েছে। আবার মরমী সাধক লালন সাঁই বাউলদের এক পাটিতে বসে এক তারে বাধা একতারে হৃদয় উচ্চারিত শব্দে কন্ঠ মিলিয়ে মনের ভাবদর্শনে অন্তর আলোর পথ খুজতে বাউল গানের সৃষ্টি করেছিলেন। সমাজের নিত্য নতুন অবক্ষয়কে প্রতিহত করতে মানুষের নিরন্তর যে চেষ্টা তাইহলো ভাববাদী চেষ্টা।

যেখানে ভাবের মূল চাওয়াকে লৌকিকতার আলোকে চিন্তা করে মনের শব্দকে সুরের মায়াজালে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। শ্রী কৃষ্ণ ভবলিলাকে কলি কালের যুগ সন্ধিক্ষণে এসে মানবমুক্তির বার্তা হিসেবে প্রচার করতে লিলা কীর্ত্তণের মাধ্যমে অনুধাবন সংয়োগ ঘটাতে শ্রী চৈতন্য চেষ্টা করে গেছেন। লালনের তারে ছড়ান মায়া মুক্তির পথও সেই একই ধারায় এগিয়েছে। ভাব সাধকেরা অন্তত: একটি বিষয়ে এক কাতারে। তারা জাত পাতের বিচার করতে না করে গেছেন। লালন এই জাতপাতের বিচারকে মানুষের অনৈতিক কাজ হিসেবে বলে গেছেন। তিনি এটাকে এক বাড়াবাড়ি কাজ বলে বলেছেন। লালনের কথায়ঃ-

‘ জাত বিচারী ব্যভিচারী
জাতির গৌরব বাড়াবাড়ি দেখিলাম চেয়ে
লালন বলে হাতে পেলে
জাতি পোড়াতাম আগুণ দিয়ে।’

এই উপমহাদেশে বৃটিশ সৃষ্টিত: ক্যান্সার হিন্দু মুসলিম সংঘাত এবং বিভাজন। যা দেখে লালন ব্যথিত হয়েছেন বারবার। এ বিষয়ে লালনের মতবাদ ছিল সুস্পষ্ট ও কঠোরও বটে। তিনি যে কারণে বললেন,

‘ যবন কাফের ঘরে ঘরে
শুনে আমার নয়ন ঝরে,
লালন বলে মারিস কারে
চিনলিনে মনের ধোঁকায়।’

বিশ্ব কবি লালনের ভাবাদর্শের অকৃত্রিম অনুরাগি ছিলেন। যে কারণে কবি এবং মরমী সাধকের ভাব বয়ানে অনেক মিল খুজে পাওয়া যায়। লালন যখন তার গানে বললেন,

‘আছে দীনদুনিয়ায় আচিন মানুষ একজনা।.. ..
যে দিন সাঁই নৈরাকারে
ভাসালেন একা একেশ্বরে,
সেই অচিন মানুষ তারে
দোসর তৎক্ষণা।’

আবার যদি বিশ্ব কবির কথা বলি। তবে কবিতার এই রাজপুত্র লালনের ভাবসূত্ কে অনুরাগের ছোঁয়াই স্পর্শ করলেন ঠিক এই লিখে,

‘ওরে পথিক, ধর-না চলার গান,
বাজারে একতারা।
এই খুশিতেই মেতে উঠুক প্রাণ-
নাইকো কূল-কিনারা।’

সুতরাং জীবন কাব্যকে লৌকিক মন্ত্রে আবদ্ধ করে, সাধন ও সিদ্ধির মাধ্যমে উপায় খুজতে লালনের একতারা সব সময় মানুষের মনে প্রাচুর্যের স্পর্শ করে গেছে। কালের প্রবাহে তাই ভাব শক্তির বিদ্রোহে এখনও এই একতারা সুরের শক্তিতে উপায়ক বিষয় হিসেবে লালন গানে ভাব এবং ভক্তিকে সংরক্ষণ করে রেখে চলেছে।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.