সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, বর্ণাশ্রম প্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আজন্ম প্রতিবাদি এবং যুক্তি-বিচার, জগত জীবন সম্পর্কে সত্যানুসন্ধানী মানবপ্রেমিক, গ্রামীণ জনপদের সহজ মানুষকে জাগরিত করবার পথিকৃত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্।
আমাদের দেশটাকে বলা হয় গানের দেশ। এদেশের জলে, স্থলে আকাশে-বাতাসে সুর মিশে আছে। পলি মাটি দিয়ে গড়া এদেশের মানুষের মনটাও নাকি পলি মাটির মত নরম। সুরের ছোয়ায় সহজেই আপ্লুত হয়। তার রসে ভক্তি রসে সহজে সিক্ত হয়। এই কারনেই যুগে যুগে বহু কবি, শিল্পী তাদের গানে কবিতায় সুরে বাংলার মানুষকে কাঁদিয়েছেন-হাসিয়েছেন।
বাণী ও সুরের মুর্ছনায় মানুষের মনের মনি কোঠায় ঠাই করে নিয়েছেন। এদের অনেকে হারিয়ে গিয়েছেন। আবার কেউ মানুষের মাঝে বেঁচে আছেন। তার পরেও সব কিছু হারায় না। অনেক কিছুই মাথা তুলে দাঁড়ায়, যা নতুন যুগের নতুন মানুষদের নাড়া দেয়। লালন ফকির আর তার গান এমনি এক যুগান্তকারী দিক দর্শন। তিনি জীবদ্দশায় যে গান রচনা করেছিলেন তা দেড়শত বছর পার হয়েছে তবুও তার গান আজও সব বয়সের, সব ধরণের মানুষকে চিন্তা দেয়, আনন্দ দেয়, ভাব-রসে আন্দোলিত, ভক্তি রসে সিক্ত করে। বাউলদের গানে সুফিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টি তত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব ও মনোনতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, পরমাত্মা, রুপ-স্বরুপ তত্ত্ব ইত্যাদি বহু তত্ত্বের কথার মারপেচ ছড়িয়ে আছে।
এসব কথা সাধারণ শ্রোতার বুঝার কথা নয়, তবুও প্রায় দেড় দুইশত বছর আগে লালনের গানে এইসব আছে। কিন্তু তার পরেও কেন লালনের গান আমাদের মননে দোলা দেয় কারন- লালন তার গানে আমাদের কালের উপযোগিতা দিয়েছে। তাইতো লালনের জীবন ও সমাজ জিজ্ঞাসা আজও অতি প্রাসঙ্গিক। সমাজের ভেদাভেদ, গর্ব অহংকার, বর্ণ-বৈষম্য, হীনমন্যতা, অসামাজিক আচরণ লালন মননে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। তাই সেটাই তিনি প্রকাশ করেছেন তার গানে।
লালন সেদিন সমাজের মানব চরিত্রে যে সব ত্রুটি ও অসংগতির দিকে অঙ্গলি দির্নেশ করেছিলেন তা আজও বিদ্যমান। আজকের দিনে সমাজ, মনোস্ক যে কোন মানুষকে লালনের গান আকৃষ্ট করে ও শক্তি দেয়। ধর্মের নামে ভন্ডামির দিকে আঙ্গুল তুলে লালন বলেছেনঃ-
‘‘ভিতরে লালসার থলি,
উপরে জল ঢালাঢালি লালন কং মন মুসল্লী,
আসল তোর হলো না মনি।
আবার বলেছেনঃ-
এসব দেখি কানার হাট বাজার,
বেত বিধির পর শাস্ত্র কানা।
আর এক কানা মন আমার
পন্ডিত কানা অহংকারে সাধূ কানা অম্বিচারে
মোড়ল কানা চুকুল খোরে
আন্দাজি এক খুটি গেড়ে।
চেনে না সীমানা কার।
বুঝায় যায় ধর্ম ব্যবসায়ী এবং সমাজপ্রতিদের কি প্রবল ঘৃনায় তিনি আক্রমন করেছেন তার গানে। প্রত্যক্ষ শ্রেণী শোষণের ইংগিতও তার গানে পাওয়া যায়ঃ-
‘‘রাজেশ্বর রাজা যিনি চোরেরও শিরমনি
নালিশ করিব আমি কোন খানে কার নিকটে
গেলো গেলো ধন মাল আমার
খালি ঘর দেখি জমাই
লালন কয় খাজনার দায়
তাও কবে যায় রাটে।
সমাজের জাত পাতের বিভেদ তাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে আর তাই তিনি প্রবলভাবে আক্রমন করেছেন সেই বিভেদ ভেদকে।
‘‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’’
লালন বলে জাতেদর কিরুপ
দেখলাম না দুই নজরে
জাতি ভেদের বিষয়টিকে নিয়ে বিচার করেছেন বাস্তব জ্ঞান দিয়ে।
‘‘আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা ভেবে বল না’’
তিনি আরো বলেন- লালন শাহ এর চিন্তায় এক অখন্ড বিভেদহীন মানব সমাজের প্রতিচ্ছবি তার হৃদয়ে লালিত ছিল। তার সাধনার কেন্দ্র ছিল মানুষ বাউল সাধকদের ভাষায় হলো মানুষ তত্ত্ব।
মনুষ্যত্বের সাতশত বাণী তুলে ধরে এক কবি বলেছিলেনঃ-
শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই
সেই বাণীর প্রতিধ্বনি তুলে ধরে লালন বলেছেন-
‘‘এই মানুষে আছে রে মন যারে বলে মানুষ রতন’’
কিংবা
মানুষ তত্ব সত্য হয় যার মনে
সে কি অন্যতত্ত্ব মানে’’
আর তাই লালনের সিদ্ধান্ত মানুষের সাধনায় আসল সাধনা।
‘‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্টা যার’’
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার।
কিংবা
‘‘ভজ মানুষের চরণ দুটি ‘‘
নিত্য বন্তু পাবে খাটি
মোলে হবে সকল মাটি
তরাই পাউসে ভেদ জেনে’’
আর এই সাধনার মাধ্যমে পাওয়া যাবে খাঁটি মানুষ।
‘‘সহজ মানুষ ভোজে দেখনাকে মন
দিব্য জ্ঞানে পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে।
অনেকের মধ্যে লালনের কন্ঠে উচ্চারিত এই মানবতা বা ঠিক সেগুলার বা এহজাগতিক নয়। স্পিরিচুয়াল মানবতাবাদ। কথাটা তর্ক সাপেক্ষ। তবে মানবতাবাদ সংক্রান্ত বুঝতে হলে ইতিহাসের ঐ বিশেষ সন্ধিকক্ষনে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। সে সময় লালন তার সংগীত সাধনা করেছেন। সিপাহী বিদ্রোহ, বৃটিশদের ক্ষমতা দখল ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্প্রত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা সামাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প পন্যের পোশাক, সব মিলিয়ে তখন বাংলায় তথা ভারতের সমাজে একটা ভাংগনের কাল চলছে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল জমিদারী শোষন ও অত্যচার, জাতিভেদ, বর্ণ প্রথা, বর্ণ হিন্দুর স্বেচ্ছাচারিতা সব মিলে গ্রাম অঞ্চলে এক অরাজক পরিস্থিতি। এই রকম একটি সমাজ বাস্তবার বিপরীতে ঐ সময়টাতেই ঘটেছে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। স্বাধীনতা ও সাধিকার আকাংখার স্ফুরুণ। একদিকে অবক্ষয়ী সামন্ত সমাজ আর অন্য দিকে সামাজ্র্যবাদে অধীনে বিকাশমান পূজিবাদ। এই দুইয়ের দ্বন্দ ও সমন্বয় তখন চলছে।
আর এই সমন্বয়ের মধ্যেই নব জাগরনের ঢেউ উঠেছে যার কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ঐ নব জাগরনের মুল সুর ছিল মানবতাবাদ। এই মানবতাবাদের একদিকে ছিলেন রামমোহন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ যারা ভাববাদী চিন্তার উপর দাঁড়িয়েই মানবতার জয়গান করেছেন। আর এক দিকে ছিলেন বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম ও বেগম রোকেয়ার মত মানুষেরা যারা আপষহীন, যৌবনদিপ্ত, মানবতাবাদের জয়গান করেছেন। ফলে লালনের মানবতাবাদ তা যদি ভাববাদের ভিত্তির উপরেও স্থাপিত হয় তাদেরও প্রগতিশীল চরিত্রপূর্ণ হয় না মোটেই।
কারণ বাউল সম্প্রদায় সমন্বয়বাদী কিন্তু মর্মগতভাবে বিদ্রোহী। লালন সেই বিদ্রোহের শরীক ছিলেন। ধর্মীয় গুড়ামী ধর্ম শাস্ত্রের কঠোর বন্ধন এবং বাড়াবাড়িকে লংঘন করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে লালন সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের সাথী হয়েছিলেন। ভাববাদের বেড়া তাকে আটকে রাখতে পারেনি।
বাউলদের সাধারণ ধর্ম, বৈরাগ্য, সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি। কিন্তু লালন সমাজ বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। তাকে বাস্তব বোধ, মানব দরদ বোধ, নিয়ে এসেছে মানটির মানুষের কাছে। আজ আমরা এমনই এক সময় লালনকে স্মরন করছি যখন আমাদের সমাজ এক ভয়াবহ, নৈতিক, সাংষ্কৃতিক, অবক্ষয়ের কবলে; অন্য দিকে পূজিবাদী শোষনের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে অভাব, দারিদ্র, জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার অনিশ্চয়তা। ভোগবাদী প্রবনতা সমাজকে ভূমিকম্পের মত অস্থির করে তুলেছে। দয়া মায়া, মমতা, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা সমাজ মনোস্কতা, দায়িত্ববোধ কোন কিছুই আর টিকে থাকতে পারছে না।
এমন অবস্থায় লালনের সেই সহজ মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। তাই আজকের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক, সমাজ মনোস্ক মানুষদের সামনে লালন শাহ এর সেই সহজ মানুষের সাধনা আজকের এই অবক্ষয়িত সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ের প্রেরনার উৎস হিসেবে আজও অমর হয়ে আছে।
তথ্যসুত্রঃ- দৈনিক আন্দোলনের বাজার, কুষ্টিয়া।