বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল
কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল

মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হলো বস্ত্র। শীতাতপ ও লজ্জা নিবারণের জন্যই মানুষ গড়ে তোলে বস্ত্রশিল্প। হস্তচাালিত তাঁতবস্ত্র এক সময় এদেশের গণচাহিদা মেটাতো। সে সময়ে গড়ে উঠেছিল বাঙালির সুতি বস্ত্রের শিল্প গৌরব। ঔপনিবেশিক কালে যান্ত্রিক তাঁতশিল্প এসে সেই স্থান জবরদখল করে বসলো। গড়ে উঠলো কল-কারখানা।

১৯০৬ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকালে বিলাতী পণ্য বর্জন উপলক্ষে স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেশীয় পণ্য ব্যবহারের লক্ষ্যে এদেশে ছোট বড় মিল কলকারখানা গড়ে ওঠে, তারই ফলশ্রুতি কুষ্টিয়া মোহনী মিল।

কুষ্টিয়া (তদানীন্তন নদীয়া জেলা) জেলার কুমারখালী থানার এলঙ্গী গ্রামের নবকিশোর চক্রবর্তী কুমারখালী রেশম কুঠিতে চাকুরি করতেন। তাঁর পুত্র কৃষ্ণলাল পুলিশ কর্মচারী হিসেবে রাজশাহীর বোয়ালিয়াতে যখন কর্মরত ছিলেন তখন তাঁর পুত্র মোহিনীমোহন ১৮৫৭ সালে বোয়ালিয়া হাই স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। তাঁর জীবনকাল ১৮৩৯-১৯২২।

বাংলার নীল বিদ্রোহের পর পরই কুষ্টিয়া মহকুমা স্থাপিত হলে মোহিনীমোহন ঐ মহকুমা সদর দপ্তরে কেরানীর চাকুরি গ্রহণ করেন। ১৮৬৫ সালে মোহিনীমোহন যখন সিভিলিয়ান ও দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস (১৮৭৭) নামক বিখ্যাত গ্রন্থের রচয়িতা ডাব্লিউ ডাব্লিউ হান্টার এর অধীন কর্মচারী, তখন তাঁর বুদ্ধিমত্তা দেখে সাহেব তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেটশীপ পরীক্ষা দিতে পরামর্শ দেন। মোহিনীমোহন যথারীতি সে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ১৮৭৪-৭৬ পর্বে ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন। সরকারি চাকুরি শেষে অবসর নিয়ে তিনি ১৯০৮ সালে চক্রবর্তী এন্ড সন্স নামে কুষ্টিয়া বড় রেল স্টেশনের দক্ষিণে একটি কাপড়ের কারখানা স্থাপন করেন। এটি শেয়ার হোল্ডার কোম্পানি হলেও এর কর্তৃত্ব ছিল চক্রবর্তী এন্ড সন্স এজেন্সির হাতে। প্রকাশ থাকে যে, মোহিনী মিল প্রতিষ্ঠার অনেক আগে ১৮৯৫-৯৬ সালে মোহিনী মিলের উত্তরে টেগোর এন্ড কোম্পানি নামে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ছিল, রবীন্দ্রনাথ তার শেয়ার হোল্ডার ছিলেন। ১৯০৫ সালে সেখানে একটি বয়ন বিদ্যালয় খোলা হয়েছিল। ১৯০৮ সালে স্থাপিত মোহিনী মিলের তিনজন শেয়ার হোল্ডার হিসেবে মোহিনীমোহন, জগৎকিশোর চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথের নাম দেখা যায়। ১৯১২ সালে এই কোম্পানিটি কুষ্টিয়া মোহিনী মিলস লিমিটেড-এ পরিণত হয়।

গত শতকের বিশ এর দশকে কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের উদ্বৃত্ত মুনাফার পুঁজিতে মিলটি স্ফীত হয়ে ওঠে, মুনাফা ভিত্তিক শোষণমূলক সমাজের নিয়মে শ্রমিক শোষণের সূত্রপাত ঘটে তখন থেকেই। তিরিশের দশকে উপমহাদেশে বে-আইনী ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের প্রচেষ্টায় মোহিনী মিলের শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া আদায়ের লক্ষে গড়ে ওঠে মোহিনী মিল সুতাকল মজদুর ইউনিয়ন। এর পর পরই মিলের শ্রমিক আন্দোলনের রঙ্গমঞ্চে মুকুটহীন অধিনায়ক, রাজনৈতিক দীক্ষাপ্রাপ্ত শ্রমিকনেতা কমরেড রওশন আলীর আবির্ভাব।

প্রকাশ থাকে যে, মোহিনীমোহনের মাতুলালয় ছিল কুমারখালী থানার মুড়াগাছার রামানন্দ ভৌমিকের পরিবারে, তাঁর মাতার নাম ভগবতী। তাঁদের ছয় পুত্র-কন্যার মধ্যে মোহিনীমোহন অন্যতম। মোহিনীমোহন ও ভবতারিণীর চার পুত্রের মধ্যে প্রথম পুত্র সতীপ্রসন্ন ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য ত্যাজ্যপুত্র হন। দ্বিতীয় পুত্র গিরিজা প্রসন্নের বিবাহ হয় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জগৎকিশোর চৌধুরীর কন্যা লীলাময়ীর সাথে। তাঁদের পাঁচ পুত্রের মধ্যে সবার বড় দেবীপ্রসাদ ওরফে কানু বাবু (১৯০৭-৬৭)। মিলটির উত্তরে দোতলা মোহিনী লজে তিনি বাস করতেন। কানু বাবু তাঁরই পুত্রের পুত্র অর্থাৎ নাতি ছেলে। কানু বাবুর বয়স যখন ১৫ বছর তখন তাঁর এই পিতামহের মৃত্যু হয় (১৯২২), ১৯৪৭-৫০ সালে এই মিলের শরিক কানু বাবুর কাকা এবং ভাইয়েরা তাঁদের অংশ নিয়ে ভারতে চলে যান। ফলে কানু বাবু এই মিলটির একক কর্ণধার হয়ে ওঠেন। কানু বাবু এবং নিরূপমা দেবীর একমাত্র সন্তান সুবীর (দুলাল বাবু) বর্তমানে মৃত, তাঁর একমাত্র পুত্র সুদীপ শোনা যায় দিল্লিতে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ঐ মিলের অন্যতম অবাঙালি অংশীদার চমনলাল ভারতে চলে যান। কানু বাবুকে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গৃহবন্দী করা হয়। মিলের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে সরকারি প্রশাসন। গৃহবন্দী অবস্থায় কানু বাবুর মৃত্যু হয় ১৯৬৭ সালে, কুষ্টিয়া শ্মশানে তাঁর সমাধি আছে।

মোহিনী মিলের শাড়ি, ধুতি ও মার্কিন কাপড় এবং সূতার চাহিদা ছিল উভয় বাংলায়। কয়েকখানা তাঁত নিয়ে যার যাত্রা শুরু তা একটি মাঝারি মানের জনপ্রিয় মিলে পরিণত হয়, কয়েক হাজার কর্মচারীর কর্মসংস্থানের ও ততোধিক মানুষের অন্নসংস্থানের কেন্দ্র এই মিলকে ঘিরে মিল লাইন, বাজার, পোস্ট অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, থিয়েটার হল, শ্রমিক চিকিৎসা, হাসপাতাল, রেশনিং সেবা, মাতৃসদন ইত্যাদি গড়ে ওঠে। কানু বাবু এলাকার অনেক জনহিতকর কাজে অর্থ সাহায্য করতেন। কুষ্টিয়া কলেজ, শ্মশান ও লালন আখড়ায় ছিল তাঁর বিশেষ অবদান। ১৯৬৫ সালে যা ছিল শত্রু সম্পত্তি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার তা জাতীয়করণ করে তাকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে। তারপর থেকে নানান হাত বদলের মধ্য দিয়ে মিলটি দীর্ঘদিন (০১/১১/১৯৮৭ থেকে) অচল হয়ে পড়ে আছে। এককালে যে মিলটি এলাকার জনজীবনে এনেছিল চাঞ্চল্য, তৈরি হয়েছিল শিল্পাঞ্চল, সমাজের সবস্তরের মানুষের কর্মসংস্থানের সে লাভজনক কারবারি প্রতিষ্ঠানটি আজ কালের বোবা সাক্ষী।

[সূত্র: মোহিনীমোহন: মোহনীমোহনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকা, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ক্যালেন্ডার ১৮৫৮-৫৯, ১৩৮ তম বর্ষপূর্তি স্মারকগ্রন্থ: কুষ্টিয়া পৌরসভা, ২০০৭, বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত (খ- তপশীল), জুন ২৬, ২০১২ (অর্পিত সম্পত্তির তালিকা), মিলপাড়া নিবাসী মোহিনী মিলের অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ]

তথ্যসুত্র:
মিলন সরকার
সাহিত্য ও ইতিহাস-গবেষক;
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক,
সিরাজুল হক মুসলিম হাই স্কুল, কুষ্টিয়া।
কৃতজ্ঞতাঃ- শৈবাল আদিত্য

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন