রওশন আলি এই যুদ্ধে ও আগামী পরিকল্পনা নিয়ে নিজ দলের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন। তিনি সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরে যাবার পরামর্শ দেন, কিন্তু তিনি শহরেই থেকে যান। ১৫ দিন শত্রুমুক্ত থাকার পর ১৪ এপ্রিল পাক সেনারা ধবংসযজ্ঞ, হত্যাকান্ড চালাতে চালাতে শহর পুনঃদখল করে। এরই মধ্যে রওশন আলি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিম বাংলায় চলে যান। সেখানে তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বন্ধুদের সাথে অনেক আলাপ আলোচনা হয়। তিনি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে এসে বাংলাদেশ থেকে আসা যুবকদের একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে সশস্ত্র প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতৃত্বে দুটি রিক্রুটিং ক্যাম্প পরিচালিত হতো। প্রথমটি ছিলো কৃষ্ণনগরে, যার পরিচালনায় ছিলেন কমরেড রওশন আলি। আর অপর ক্যাম্পটি ছিলো আনন্দ পল্লীতে। যার পরিচালনায় ছিলেন যুবনেতা সৈয়দ জাহেদ রুমী। কলকাতার পার্ক সার্কাসে প্রায় ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপুর্ন সভা বসতো। রওশন আলি এই সমস্ত সভায় বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধে তার সক্রিয় ভুমিকা চিরদিন এ জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করবে। যুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি দিনরাত বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে বেড়িয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলতেন, যে জাতি একবার হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে তাকে স্তব্ধ করা যায় না। স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র চলতেই থাকবে। এটাই নিয়ম এটাই ইতিহাস। তিনি যুব যোদ্ধাদের সাথে বসে আলাপ আলোচনা করতেন অনুপ্রানিত করতেন, তার বিগত সংগ্রামী জীবনের ঘটনা উল্লেখ করে। কমরেড রওশন আলি ভারতের বিভিন্ন শ্রমিক অঞ্চল ঘুরে ঘুরে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে দীর্ঘদিন আলাপ আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে সি,পি,আই সি,পি,এম সহ বিভিন্ন প্রগতিশীল গনতান্রিক দলের নেতাদের সাথে তার একাধিকবার বৈঠকও হয়েছে। তিনি তাদের দিয়ে কংগ্রেস সরকারকে চাপ দেবার চেষ্টা চালিয়েছেন।
যাহোক, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এলো বাংলার স্বাধীনতা। তিনি কুষ্টিয়ায় ফিরে এলেন এবং যুদ্ধ বিদ্ধস্ত শহর পুনঃগঠনের কাজে কর্মীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। এর পাশাপাশি দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হলে জেলা শাখার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সরকারের দেশ পরিচালনা পদ্ধতির সমর্থন দিলেও তার দলের নেতা কর্মীদের উচ্ছৃংখলতার প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। বাকশাল গঠিত হলে তিনি বাকশাল জেলা কমিটির অন্যতম নেতা নির্বাচিত হন।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু কুষ্টিয়ায় এলেন সরকারী সফরে। তিনি কমরেড রওশন আলির সাথে দেখা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। বাংলার মানুষের নয়নের মনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সার্কিট হাউজে আলাপ করতে এলেন শ্রমিক কৃষক তথা নির্যাতিত শ্রমজীবী মানুষের নয়নের মনি কমরেড রওশন আলি। সব প্রোটোকল ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধু ছুটে গিয়ে তার সাথে আলিঙ্গন করলেন। তারপর দুই নেতা বসলেন আলোচনায়। বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতার সাথে কমরেডকে বললেন, রওশন ভাই, আপনার নাম আমি অনেক শুনেছি, কিন্তু প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হয়নি। আপনার ত্যাগ-তিতিক্ষা, আত্মৎসর্গের কথা জাতি চিরদিন মনে রাখবে। কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনিতো জীবনে কিছুই পাননি – বলেন, কি চান আপনি। মৃদু হাসলেন কমরেড। তারপর বিনয়ীভাবে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, শ্রমিক, কৃষক, শ্রমজীবী মানুষের জন্য কিছু করুন। তবেই আমার সব পাওয়া হবে। তারপর বাকশাল গঠন নিয়ে দুই নেতা দীর্ঘসময় আলোচনা করেন।
১৯৭২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী সোভিয়েত ট্রেড ইউনিয়নের আমন্ত্রনে কমরেড রওশন আলি সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। এই প্রতিনিধি দলের মোট সদস্য ছিলেন ছয় জন। রুশ বিমানে করে বোম্বে ও তেহরান হয়ে রাতে মস্কো গিয়ে পৌছান। মস্কো বিমান বন্দরে নেতাদের অভ্যর্থনা জানান সেই দেশের শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হোটেল স্ফুটনিতে। বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা মস্কোতে অল ইউনিয়ন সেন্ট্রাল কাউন্সিল ট্রেড ইউনিয়নের অফিসে নেতাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। তারা একটি ঘড়ির কারখানা, বাকুতে পৃথিবীর বৃহত্তর তেল শোধিনাগার পরিদর্শন করেন। প্রাগে ওয়ার্ল্ড ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেন। লেনিনগ্রাডে অরোরা যুদ্ধজাহাজ [ ১৯১৭ সালে বিপ্লবীরা প্রথম গুলি ছুড়েছিলো ], শহীদদের কবর, সুমদ্র বন্দর, জাদুঘর ও কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন করেন। ৭ মার্চ থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়নে সপ্তম কংগ্রেসে অংশগ্রহন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হবার পর খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় আসেন। তারপর ৭ ই নভেম্বর সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক শাসন জারি করে জোর করে ক্ষমতা দখল করেন। নিষিদ্ধ করা হয় সব রাজনৈতিক দল। আবারো সেই পাকিস্তানী আমলের আলামত দেখা গেল রাজনৈতিক অঙ্গনে। এরই মধ্যে রওশন আলি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি দুরারোগ্য চর্মরোগে আক্রান্ত হন। বিভিন্ন সময় পুলিশী নির্যাতন, অত্যাধিক পরিশ্রম, অভাব-অনটন ও দীর্ঘ বছর জেলবাসের ফলে তার শরীরে চর্মরোগ দেখা দেয়। অনেক চিকিৎসার পরেও রোগমুক্তি সম্ভব হয়নি। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকার মহিনী মিল বন্ধ করে দেবার চক্রান্ত শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বৃদ্ধ রওশন আলি শ্রমিকদের নিয়ে মাঠে নামেন। শেষ পর্যন্ত বি,এন,পি সরকার মিলটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। হাজার হাজার শ্রমিকের দুরাবস্থার কথা ভেবে অসুস্থ শরীর নিয়ে রওশন আলি মাঠে নামেন। ১৯৮০ সালে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে যান। তবে একটু সুস্থ হলেই তিনি ছুটে যেতেন মিল শ্রমিকদের মাঝে।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরপরই কমরেড রওশন আলিকে গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্যাতিত মানুষের নেতা রওশন আলি প্রথম বারের মতো স্বৈরশাসক জিয়ার আমলেই কারারুদ্ধ হন।
তারপর দীর্ঘসময় কারাবরণের পর তিনি মুক্তি পান। শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী ঐতিহ্যবাহী মোহিনী মিল লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কমরেড রওশন আলির নেতৃত্বে সর্বস্তরের পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘মোহিনী মিল সংগ্রাম পরিষদ’।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ অপর এক সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ ঠিক জেনারেল জিয়াউর রহমানের পথ ধরে ক্ষমতায় বসেন। ’৮০ দশকের প্রথমদিকে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এবং ১৫টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। রওশন আলি উভয় কমিটির নেতৃস্থানীয় অবস্থানে থাকেন। একদিকে কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব আর অন্যদিকে সামরিক শাসক বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব অসুস্থ শরীর নিয়েই চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রওশন আলি আরো অসুস্থ হয়ে যান। তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শ্রমজীবী মানুষের এক কিংবদন্তী নায়ক কমরেড শেখ রওশন আলি ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইংরেজ শাসনামল থেকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত এমন কোন গনতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল সংগ্রাম আন্দোলন ছিলো না যেখানে কমরেড শেখ রওশন আলির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন ছিলো না। তার ত্যাগ, নিষ্ঠা, আর সংগ্রামী জীবন এলাকার মানুষের কাছে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে। শুধু দেশেই নয় ভারত সহ তৎকালীন পৃথিবীতে তার কথা সবার কাছে উচ্চারিত। মার্ক্সীয় তাত্ত্বিকদের কাছে তিনি একটি আদর্শ হয়ে আছেন।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, কমরেড রওশন আলির মূল সংগ্রাম ছিলো কুষ্টিয়া জেলা তথা বাংলাদেশ ও ভারত কেন্দ্রিক। তবে তাকে স্মরনীয় করে রাখার মতো এমন কোন স্মৃতি নিদর্শন আজো হয়নি। শুধু কুষ্টিয়া পৌরসভা তার নামে একটি মার্কেটের নামকরন করেছে। এই সামান্য প্রাপ্তি তার মতো বিশ্বনন্দিত নেতার জন্য যথেষ্ট নয়। যে দলের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠার জন্য যে ব্যাক্তিটি আজীবন সংগ্রাম করেছেন সেই দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিও তাকে ভুল করেও স্মরন করে না। জন্ম কিংবা মৃত্যু দিনটিও পালন করতে যেন ভুলে গেছে আজকের কমরেডরা। সিপিবি কে আজ এই পর্যন্ত আনতে মনি সিংহের পাশাপাশি যে কয়জন নেতা জীবন, যৌবন সবকিছু দলের জন্যে উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে রওশন আলি একজন।
স্মৃতির ইতিহাস ঘাটলে বারংবার যে মহৎ মানব দরদী মানুষটির কথা উজ্জ্বল হয়ে স্মৃতিপটে ভেসে উঠে তাকে কি এত সহজে এ জাতি ভুলে যেতে পারে ? তার স্মৃতি রক্ষার জন্য কুষ্টিয়া বাসীর যা করার ছিলো, দলের যা করনীয় ছিলো আসলে তা কি করা হয়েছে ? এ ব্যর্থতা তার নয়, বলা যায় আমাদের, তার প্রাণপ্রিয় দলের।