বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

খাজানগর
খাজানগর

কুষ্টিয়ার খাজানগর (Khazanogor kushtia) বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রাম। কিন্তু গ্রাম হলেও এর পরিচিতি বিশ্বজোড়া। কারণ ওই গ্রামটি গ্রাম নয়, চাল উৎপাদনের বৃহৎ শিল্পনগরী। এই গ্রামটি এখন দেশের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে একাধারে চাল উৎপাদন, উন্নত জাতে রূপান্তর ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে। এ চাল শিল্পনগরী থেকেই সারা দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চাহিদা মেটানো হয়।

পাশাপাশি খাজানগর থেকে প্যাকেটজাত উন্নত চাল রফতানি হয় ৩৮টি দেশে। শুধু খাজানগর-আইলচারা চালশিল্প ঘিরে ছোট-বড় প্রায় ৮০০ রাইসমিল গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি ধান সেদ্ধ-শুকানোসহ নানা প্রক্রিয়ার জন্য চাতালও রয়েছে দুই সহস্রাধিক। সেখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় আট হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়। ২০-২২ হাজার টন চাল মজুদ রাখার মতো শত শত গুদামও গড়ে উঠেছে খাজানগরে। এখানকার সাধারণ বাড়িঘরও উৎপাদন, রক্ষণ, সরবরাহসহ বাণিজ্যিক নানা প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত। সব মিলিয়ে রাত-দিন চলছে ১০ সহস্রাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিকের বিশাল কর্মযজ্ঞ।

সরকারি-বেসরকারি সহায়তা-পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই স্থানীয় অধিবাসীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এখানকার চালকল আর চাতালগুলো। পদ্মার ভাঙনে দিশেহারা চিলমারী, বাজুমারা ও ফিলিপনগর চরাঞ্চলের অধিবাসীরা বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে খাজানগরকেন্দ্রিক চালের ব্যবসা শুরু করেন একসময়। আজ যা প্রসারিত হয়েছে অনেক গুণ, গড়ে উঠেছে বৃহৎ শিল্পনগরী হিসেবে। সুগন্ধা রাইসমিলের স্বত্বাধিকারী ওয়াহিদুজ্জামান অর্ক বলেন, রাজধানী ঢাকায় প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ড মিনিকেট এই খাজানগরেরই সৃষ্টি। এমনকি এখানকার উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের চাল ইতালি ও জার্মানিতে রফতানি হচ্ছে।

কুষ্টিয়ার রশিদ অ্যাগ্রো ফুড, খাজানা মিল, স্বর্ণা অটো রাইসমিলসহ ২০-২২টি চালকল দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ববহ ভূমিকা রাখছে। একেকটি মিলে প্রতিদিন ৭০০ টন এবং ছোট মিলে ৫০ টন পর্যন্ত চাল উৎপাদন হয়। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ইউনিয়নে খাজানগর অবস্থিত। বটতৈল ইউনিয়নে স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা ৩৬ হাজার হলেও শুধু খাজানগর গ্রামেই বাস করেন সাড়ে ১৪ হাজার মানুষ। এ গ্রামের শতকরা ৯০ জনই চালশিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানকার কেউ শ্রমিক, কেউ ব্যবসায়ী কেউবা মিল কিংবা চাতালের মালিক।

লাশ নয় চলে জীবনের জয়গান :
মাত্র এক-দেড় যুগ আগেও যে খাজানগর আর আশপাশ এলাকা চরমপন্থী-উপদ্রুত ছিল, এখানে-সেখানে পড়ে থাকত মানুষের রক্তাক্ত লাশ, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে একই স্থানে এখন জীবনের জয়গান। ঘটেছে চালবিপ্লব। ‘ধান উৎপন্ন করে কৃষক আর চাল উৎপাদন করে খাজানগর’ এমন কথা মানুষের মুখে মুখে। খাজানগর ব্যাপারী অ্যাগ্রোর মালিক তোফাজ্জল হোসেন জানান, চিলমারীর পদ্মার চরে বসতি ছিল তার। ১৯৯২ সালের বন্যায় বাড়িঘর ভেসে গেলে শুধু ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে সপরিবারে ঠাঁই নেন খাজানগরে। প্রথমদিকে ভাড়ায় নেয়া ভ্যানগাড়ি চালিয়ে কোনো রকমে জীবিকার ব্যবস্থা হলেও পরে তিনি রাইসমিলে যোগ দেন শ্রমিক হিসেবে। একসময় ভাগ্য ফেরে। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে শুরু করেন মিল পরিচালনা। এরপর ব্যাংক, এনজিও আর পরিচিতজনদের সহায়তায় নিজেই গড়ে তোলেন অটো রাইসমিল। তোফাজ্জলের মতো ভাগ্য পরিবর্তনের গল্প এখানকার অনেকের। এখানে যারা আজ বৃহৎ ব্যবসায়ী, তাদের প্রায় প্রত্যেকে উঠে এসেছেন শ্রমিক থেকে।

আনন্দময় কর্মযজ্ঞ :
খাজানগরে মাঝারি শ্রেণীর সাধারণ মিলের সংখ্যা এখন ২৫০টি। অটো কালার শুটার মিল আছে ২৫টি আর বৃহদাকারের ডাইয়ার অটো মিল ১০টি। একেকটি অটো রাইসমিল থেকে প্রতিবার প্রায় আড়াই হাজার মণ চাল উৎপাদন সম্ভব হয়। আধুনিক এসব মিলে দিনমজুর, প্যাকিংম্যান, গুদামকর্মী, সাধারণ লেবার, হেলপার, মেশিন অপারেটর, টেকনিক্যাল ম্যান-মেকার, ইলেকট্রিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ম্যানেজার, সেল্সম্যান, ক্যাশিয়ার, পরিচালক পদে জনবল নিয়োগ হয়ে থাকে। প্রতিটি কারখানায় আট ঘণ্টায় এক শিফট। প্রতি শিফটে ২০-৩০ জন নারী-পুরুষ কাজ করে থাকেন।

চাহিদা অনুযায়ী রাত-দিন তিন শিফটে সচল রাখা হয় মিলগুলো। পুরো খাজানগর এলাকা যেন কর্মযজ্ঞের আনন্দে রাত-দিন ভাসে। শিশু থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই কোনো না কোনো কাজের মধ্য দিয়ে সময় কাটান। সত্তরোর্ধ্ব নূর মোহাম্মদ চোখে কম দেখলেও বড় আকারের সুই আর পাটের সুতলিতে বস্তা মেরামতের কাজ করেন দিনমান। বৃদ্ধা করিমন বেওয়া চাল থেকে বেছে আলাদা করা তুষ-কুঁড়া বস্তায় ভরেন আয়েসি ভঙ্গিতে। ক্লান্তি এলে এখানে-সেখানে শুয়ে-বসে সময় কাটান তারা। আড্ডায় মেতে ওঠেন যখন-তখন। তবে এত আনন্দের মধ্যেও আছে সমস্যা। এখানকার অধিবাসীদের প্রধান সমস্যা ড্রেনেজ। স্থানীয় মিল-মালিকরা ব্যক্তি উদ্যোগে এ সমস্যা কিছুটা নিরসন করেছেন। এ সমস্যা সমাধানে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।

নকল ব্র্যান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত :
খাজানগরের উৎপাদিত চালের সুনাম দেশে-বিদেশে। অথচ এ সুনামকে পুঁজি করে একশ্রেণীর ঠগ-প্রতারক ‘খাজানগরের চাল’ ব্র্যান্ড ব্যবহার করে খারাপ চালের জমজমাট ব্যবসা শুরু করেছে। এসব ব্র্যান্ডের চাল কিনে ঠকছেন ক্রেতারা। সাধারণ থেকে শুরু করে পোলাওয়ের চাল পর্যন্ত বাজারজাত করে চলেছে অসাধু এই ব্যবসায়ী চক্র। সংশ্লিষ্ট মিল-মালিক ও ব্যবসায়ীরা বলেন, রাজধানীর একশ্রেণীর অতি মুনাফালোভী দুষ্টচক্রের যোগসাজশে এখানকার ঠগ-প্রতারকরা ছোট-বড় ব্যাগে নানা নামে, নানা ব্র্যান্ডে সিলমোহরের মাধ্যমে দেদার পচা-গন্ধ নিম্নমানের চাল ছাড়ছে বাজারে।

মানসম্মত চালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রশিদের মিনিকেট, সিরাজের মিনিকেট, দাদা রাইস, জোয়ার্দার রাইস, নাটোর অটো রাইসের চাল। চিনিগুঁড়া, কালিজিরার মতো চালের ক্ষেত্রে এরফান, মোজাম্মেল, সাগর স্পেশাল, রজনীগন্ধা, সোনার চাবি, সাহেব বাবু, আবুল হোসেন, মুঞ্জুর, মিন্টু ও আনোয়ার স্পেশাল ব্র্যান্ডের উন্নতমানের চাল রয়েছে। অথচ একই নামে নকল বাজারজাত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মূল উৎপাদনকারীরা। শুধু ব্র্যান্ডভক্তির এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন রাজধানীর বাবুবাজার, বাদামতলী, ছোটকাটরা, মৌলভীবাজার প্রভৃতি এলাকার কিছু অসাধু পাইকার।

তথ্য সুত্রঃ- দৈনিক ইনকিলাব

Add comment

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.