বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

ব্যাটল অব কুষ্টিয়াঃ বা কুষ্টিয়া প্রতিরোধ
ব্যাটল অব কুষ্টিয়াঃ বা কুষ্টিয়া প্রতিরোধ

‘মূলত সাহস আসে ঘৃণা থেকেই’। মাথায় নানা কিছু ঘুরছে। ভারী অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত একটি সু-প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ার সাহস কীভাবে পেয়েছিল এ বাংলার গ্রামের অতি সাধারণ সহজ-সরল মানুষজন? আর ঘুরেফিরে প্রায় একই উত্তর দেন মুক্তিযোদ্ধারাই- ‘সাহস আসে নাকি ঘৃণা থেকে’ই!

”যে অসীম সাহস আসে ঘৃণা থেকে। যে বৈষম্য আর শোষণ আমাদের ওপর চলছিলো দীর্ঘকাল ধরে, তাঁর কারণেই এই ঘৃণা।”

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের একদল সদস্য মেজর শোয়েবের নেতৃত্বে গভীর রাতে কুষ্টিয়া শহরে অবস্থান নেয়। এ দলে সেনা সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ জন।

পাকিস্তানি সেনাদের আসার খবর পেয়েই লোকজন পালাতে থাকে দিকবিদক। তখন ইপিআরের ৪ নম্বর উইংয়ের দপ্তর ছিল বৃহত্তর কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গা মহকুমায়। আর এর অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। সহকারী ছিলেন বাঙালি ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরী (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল) এবং পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন মো. সাদেক। কোম্পানি কমান্ডারদের সবাই বাঙালি। উইংয়ের অধীনে পাঁচটি কোম্পানি ও একটি সাপোর্ট প্লাটুন ছিল। তাদের কাছে হালকা ট্যাংকবিধ্বংসী কামান, ৩ ইঞ্চি মর্টার, মেশিনগান, এলএমজি, রাইফেল এবং গোলাবারুদ ছিল। আর ছিল চীনের তৈরি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, তবে আসল জিনিস গুলিই ছিল না তাঁদের নিকট।

২৫ মার্চ রাতে আবু ওসমান তাঁর স্ত্রী-কন্যাসহ কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউসে ছিলেন। ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যান চুয়াডাঙ্গায়। সেখানে পৌঁছে আযম চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্রোহ করেন। পরে সভা করেন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে। তাতে চুয়াড়াঙ্গার ডা. আসহাবুল হক জোয়ারদারসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা, নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ডাক আর দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যই সুসজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার দীপ্ত কঠিন শপথ নেন। উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে আসহাবুল হককে বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান এবং আবু ওসমানকে সামরিক বাহিনীর প্রধান করা হয়।

কুষ্টিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্তের পর ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শুধুমাত্র ঢাল, সড়কি, বল্লম, তির-ধনুক নিয়েই যুদ্ধে যোগ দিতে প্রস্তুত হয়। স্থানীয় আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশকেও ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্থানীয় টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পোড়াদহের খোলা প্রান্তরে ‘ফিল্ড এক্সচেঞ্জ’ও বসানো হয়। রণাঙ্গনে আহত প্রতিরোধযোদ্ধাদের সু-চিকিৎসার জন্যও গঠন করা হয় মেডিকেল টিম। চুয়াডাঙ্গার টাউন হলে খোলা হয় মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। আরেকটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয় মতিরাম আগরওয়ালার বাড়ির নিচতলায়। প্রতিরোধযোদ্ধারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে কুষ্টিয়ায় আক্রমণ করেন। একটি দল সুবেদার আবদুল মতিন পাটোয়ারির নেতৃত্বে পুলিশ লাইনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের মজমপুরে একটি বাড়ির তিনতলা থেকে পুলিশ লাইনের পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। কিছুক্ষণ পর মেহেরপুর থেকে প্রায় এক কোম্পানি আনসার ও মুজাহিদও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। অন্য দল আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। তৃতীয় দল নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানের (বীর বিক্রম, পরে অন্য যুদ্ধে শহীদ) নেতৃত্বে মোহিনী মিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেস টিমের ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণ শুরু হয় ৩০ মার্চ ভোর চারটার দিকে। প্রতিরোধযোদ্ধাদের গোলাগুলি ও সমবেত লোকদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পাকিস্তানি সেনারা দিশাহারা আর চরম ভীত হয়ে পড়ে।

এ অবস্থায় জীবিত পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইন ও ওয়্যারলেস স্টেশন ছেড়ে জিলা স্কুলে একত্র হওয়ার চেষ্টা করে। পালানোর পথেও বহু সেনা নিহত হয়। দুপুরের মধ্যে জিলা স্কুল ছাড়া পাকিস্তানিদের সব অবস্থানই কুষ্টিয়া অঞ্চলের প্রতিরোধযোদ্ধাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ৩১ মার্চ ভোরে প্রতিরোধযোদ্ধারা আবার জিলা স্কুল আক্রমণ করলেও পাকিস্তানিদের ভারী অস্ত্রের ক্রমাগত গোলাবর্ষণে মাথা উঁচু করে সামনের দিকে এগোতেই পারেননি। সারা দিনের যুদ্ধ শেষে প্রায় অর্ধশত পাকিস্তানি সেনা তখনো জীবিত ছিল। তারা রাতের অন্ধকারে দুটি জিপ ও দুটি ‘ডজ’ গাড়িতে করে ঝিনাইদহের পথে পালিয়ে যায়। অত্যন্ত চতুর এ প্রতিরোধযোদ্ধাদের আরেকটি দল আগে থেকেই শহরতলীর চৌড়হাস এলাকা ও ঝিনাইদহের শৈলকুপায় একটি সেতুর কাছে অ্যামবুশ করে বসে ছিল। তারা সেতুটি ধ্বংস করে চালাকি করে বাঁশের চাটাইয়ে আলকাতরা মাখিয়ে শূন্য স্থানটিকে পিচঢালা পথের মতোই করে রাখে। তীব্র গতিতে যশোরের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনাদের দুটি গাড়ি সেতুর একেবারে নিচে পড়ে যায়।

প্রতিরোধযোদ্ধারা আগেই প্রস্তুত ছিলেন। মেজর শোয়েবসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। বাকিরা আহত হয়ে গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে এবং বেশির ভাগই নিহত হয়। জীবিত কয়েকজনকে আহত অবস্থায় চুয়াডাঙ্গায় পাঠানো হয়।

আর এটি ফিল্মি কোনো কল্পকাহিনী নয়, তৎকালীন মুজিবনগর সরকরের অস্থায়ী রাজধানী ও স্বাধীনতার সূর্যদয়ের জেলা কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রকৃত ও অনন্য সাধারণ ঐতিহাসিক ইতিহাস।

বছর কয়েক আগে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি নিয়ে তৈরি ফিল্মটির নামই হলো-“ব্যাটল অব কুষ্টিয়াঃ বা কুষ্টিয়া প্রতিরোধ”

লেখকঃ মুন্সী তরিকুল ইসলাম - বিশিষ্ট গণমাধ্যম ও উন্নয়নকর্মী।

Add comment

কুষ্টিয়া সম্পর্কিত তথ্য

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.