শেখ রওশন আলির ব্যক্তি জীবনের চাইতে তার রাজনৈতিক জীবনটাই মূলত মূখ্য। একজন রাজনীতিক কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌছালে তার ব্যক্তিজীবন ম্লান হয়ে যায় রাজনৈতিক জীবনের কাছে তা তাকে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। তার নিজের জীবনের জন্য কোন অংশই ছিলো না, তার সবটুকুই দেশ, জাতি এবং নির্যাতিত, নিষ্পোষিত, নিপীড়িত, শোষিত জনগোষ্ঠির জন্য নিবেদিত।
১৯৩৩ সাল। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। মোহিনী মিলের শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য বর্ধমান থেকে কমিউনিস্ট নেতা নিত্যানন্দ চৌধুরী এলেন কুষ্টিয়ায়। শহরের পূন্য পাল, ভবেশ ঘোষ, সুধীর সান্যাল, শিবেন রায়, ধীরেন ভট্টাচার্য, অমৃতেন্দু মুখার্জী, সুরেশ রায় প্রমূখ নেতা শ্রমিক সংগঠনে সক্রিয় হতে থাকেন। ত্রিশ দশকের সময় যারা শহরে এসে কাজ করেন তারা হলেন, নিহারেন্দু দত্ত মজুমদার, নেপাল নাগ, নৃপেন সেন প্রমুখ। শেখ রওশন আলি শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে থাকেন এবং ক্রমেই মার্কসবাদ, লেলিনবাদের প্রতি আস্থা দৃঢ় হতে থাকে। এরপরই অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৩৭ সালে তাকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ দেওয়া হয়।
এদিকে ১৯৩৪ সালে রওশন আলির একান্ত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মোহিনী মিল সুতাকল মজদুর ইউনিয়ন’। এই শ্রমিক সংগঠনটি মূলত শ্রমিকদের নির্যাতন থেকে মুক্তি, কাজের নিশ্চয়তা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে। ১৯৩৪ সালের নভেম্বর মাস থেকে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। মালিক পক্ষ প্রতিটি শ্রমিকের থেকে বাধ্যতা মূলক চাঁদা কেটে নিত। এই অন্যায় কাজটি মেনে নিতে পারেনি হাজার হাজার শ্রমিক। তারা ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানায়। শুরু হয় মিছিল, মিটিং, আন্দোলন। মালিক পক্ষ সশস্ত্র হামলা চালালে শ্রমিক নেতা জমির উদ্দিন শহীদ হন এবং সেই সাথে জুলফিকার ও ওমর আলী মারাত্মক আহত হন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন রওশন আলি। তিনি দ্রুত আহতদের সুচিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তারা দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে কুষ্টিয়ায় ফিরে আসেন।
১৯৩৬ সাল হচ্ছে রওশন আলির রাজনৈতিক জীবনে সবচাইতে উজ্জলতম একটি অধ্যায়। বছরের প্রথম দিকেই শুরু হয় আন্দোলন। মালিক পক্ষ রওশন আলিকে প্রধান আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন। পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে এলে শ্রমিকেরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একাধীক দাবী উথাপন করা হয়। মালিক দাবির প্রতি অনমনীয় মনোভাব দেখালে ১৯৩৭ সালে শ্রমিকরা দীর্ঘকালীন ধর্মঘটে যায়। এসব আন্দোলন আরো জোরদার হয় এবং ২ মাস ১০ দিন একটানা ধর্মঘট চলার পর মালিক পক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এইসব আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন রওশন আলি। ১৯৩৮ সালের মার্চ মাস থেকে মোহিনী মিল পূর্নাঙ্গভাবে চালু হয়। এই আন্দোলনের সফলতার খবরাখবর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়। শেখ রওশন আলি হয়ে ওঠেন এক কিংবদন্তীতুল্য শ্রমিক নেতা। চল্লিশ দশকের প্রায় সবটুকু সময় তিনি মজদুর ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্বে পালন করেন। শ্রমিক সংগঠনের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনও গড়ে তোলেন।
১৯৩৯ সালে রওশন আলি ধর্মঘট আন্দোলনের নেতৃত্বে দেবার ‘অপরাধে’ ৮০০ জন শ্রমিকের সাথে চাকুরিচুত্য হন। এরপর তিনি মিল এলাকায় ছোট ভাই শেখ আব্দুল গনির [টুনা মিয়া] সাথে একটা চায়ের দোকান খোলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামায় সারা বিশ্ব কেপে উঠলে সেই প্রভাব এসে পড়ে কুষ্টিয়া শহরসহ শিল্পাঞ্চলে।
৪০ দশক হচ্ছে রওশন আলির রাজনৈতিক জীবন কঠিনতম সময়। জনগনের কাজে সবসময় তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। অনেকদিন তাকে অর্ধাহারে, অনাহারে কাটাতে হয়েছে। এ সময় সারা দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এরই মধ্যে তিনি গ্রেফতার হন। জেলে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী গোলাপী নেছা মারা যান। ১৯৪৩ সালে ১৩ দিনের ব্যবধানে মা ও বাবা মারা যান। কোন মৃত্যুই তার সংগ্রামী জীবনকে থামিয়ে রাখতে পারেননি। সবকিছু প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনে নিয়েছেন। তার কাছে পারিবারিক বিপর্যয় কোন বাধা বলে মনে হয়নি। তিনি অপ্রতিরোধ্য গতিতে শ্রমজীবী মানুষের জন্য আত্মনিয়োগ করেছেন।
১৯৪৩ সালে সমগ্র বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। না খেয়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে থাকে। রওশন আলি মানুষের এই দুঃখ সহ্য করতে পারেননি। তিনি তার কর্মীবাহিনী নিয়ে দারে দারে ভিক্ষা করেছেন। তারপর সেই অর্থ দিয়ে না খাওয়া মানুষের জন্য নোঙ্গরখানা চালিয়েছেন। মহাজন, মজুদদারদের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন।
১৯৪৪ সালের শেষদিক থেকে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে থাকে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠে। ১৯৪৬ সালে বাংলাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে রওশন আলি তার বাহিনী নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। তখন তার নেতৃত্বে একাধীক শান্তি মিছিল মিটিং হয়েছে। ৪৬ এর নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির মনোনিত প্রার্থীকে নিয়ে তিনি গ্রাম গঞ্জে ছুটে বেড়ান। কৃষকদের তে’ভাগা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকলে রওশন আলি একাত্মতা ঘোষনা করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়। বাংলা দুই ভাগ হয়ে পুর্ব বাংলা নতুন পরিচয়ে পুর্ব পাকিস্তান হয়। ১৯৪৭ সালের ৬ই মার্চ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা কংগ্রেসের মাধ্যমে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়।
দায়িত্ব লাভ করেন সাজ্জাদ জহির। ১৯৪৭ সালে পার্টির আঞ্চলিক কমিটি গঠিত হয়। সম্পাদক ছিলেন খোকা রায় এবং অন্যান্য সদস্যরা হলেন, মনি সিংহ, নেপাল নাগ, ফনী গুহ, শেখ রওশন আলি, মুনীর চোধুরী, চিত্তরঞ্জন দাস। তবে ৩০ দশকের মাঝামাঝি সময় কুষ্টিয়া মহকুমা কমিউনিস্ট পার্টি রওশন আলির নেতৃত্বে গড়ে উঠে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পার্টির জেলা কমিটির দায়িত্বেও তিনি ছিলেন। এ দায়িত্ব মৃত্যুর পুর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত তাকে পালন করতে হয়েছে। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি অর্ধশতাধিক বছর দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।