বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

লালন মানুষকে ভালোবেশে একটি অসাম্প্রদায়ীক সমাজ গড়তে চেয়ে ছিলেন
লালন মানুষকে ভালোবেশে একটি অসাম্প্রদায়ীক সমাজ গড়তে চেয়ে ছিলেন

মানুষ ভজন-সাধন, মানুষকে ভালোবেশে মানবতার নিগুড় প্রেমের ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি অসাম্প্রদায়ীক সাম্যের সমাজ চেয়ে ছিলেন বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ। তিনি অহিংস মানবতার ব্রত নিয়ে দেহতত্ব, ভাবতত্ব, গুরুতত্বসহ অসংখ্য গান সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর এই অমর সৃষ্টি সঙ্গীত কোন ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সকল ধর্মের উর্দ্ধে থেকে মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ মানব মুক্তির জন্য সৃষ্টি করেছিলেন ফকিরী মতবাদ। সাঁইজির ফকিরী মতবাদ জাতহীন মানব দর্শন ও সঙ্গীত দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। তিনি সকল ধর্মের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে সদা সত্য পথে চলতে মানুষকে মানবতাবাদীর পথে ডাক দিয়েছিলেন।

বিশিষ্টজনদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক ধারাবাহিক প্রতিবেদন করছেন সুজন কর্মকার:-

প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থাকার ম.মনির-উজ-জামান জানান, নবাব আলীবর্দীর (১৬৭৬-১৭৫৬) সময়ে ১৭৪১ সাল নাগাদ বর্গি হাঙ্গামায় পশ্চিমবঙ্গের ভাগরথী নদীর তীর পর্যমত্ম জনপদ লুন্ঠন হয়। তখন ওইসব এলাকা থেকে কুমারখালী অঞ্চলে বহু লোকজন এসে বসবাস শুরু করেন। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে লালনের পিতামহ ২৪ পরগনার পানিহাটি থেকে কুমারখালীর চাপড়া-ভাঁড়ারা নামের জোড়া গ্রামে এসে আশ্রয় নেন। ওই গ্রন্থ মতে, বর্তমান কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া-ভাঁড়ারা গ্রামে লালন সাঁইজির জন্ম হয়। তাঁর কৌলিক নাম ললিতনারায়ণ। ডাকনাম লালু। ছেঁউড়িয়া গ্রামের মলম কারিকরের পরামর্শে তিনি ঝিনাইদহের হরিশপুর নিবাসী সাধক সিরাজ সাঁইয়ের কাছে বাউল-ফকির মতে দীক্ষিত হয়ে ‘লালন’ নামটি গ্রহণ করেন। গুরুর মৃত্যু হলে আঠার’শ পঞ্চাশের মাঝামাঝি থেকে ষাটের দশকের গোড়াতে আবার কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামে আসেন তিনি। মলম তাঁকে কিছু জমি দান করলে সেখানেই আখড়াবাড়ি স্থাপন করে বসবাস শুরু করেন লালন শাহ।

আখড়াবাড়ীতে আসা সাঁইজির অনুসারীদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে, মানুষ গুরুর দিক্ষা দিতেই মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে বাউল সম্রাট লালন শাহ’র আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। তীর্থকালে তিনি বসমত্ম রোগে আক্রমত্ম হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। সিরাজ শাহের আশ্রয়ে জীবন ফিরে পায়। মলম শাহ’র দানকৃত জমিতে ১৮২৩ সালে লালন অাঁখড়া গড়ে ওঠে। আঁখড়া স্থাপনের পর থেকে শিষ্যভক্তদের নিয়ে সেখানে থাকতেন। রচনা করে গেছেন অশংখ্য গান । ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর আর বাংলা ১২৯৭ সালের ১ কার্ত্তিক সাঁইজির মৃত্যু হয়। ঘরের মধ্যে তাকে সমাহিত করা হয়।

বিশিষ্ট গবেষক ও বোধদয়ের সভাপতি এ্যাডঃ লালিম হক জানান, লালন সাঁই ১৭৭২ বা তার নিকটবর্তী কালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮১৫ (আনুমানিক) খ্রিস্টাব্দে, জনশ্রুতি কুষ্টিয়া ছেউড়িয়া আখড়া বাড়ি নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে সাধনায় ও গান রচনায় নিয়োজিত হন। তার মৃত্যু হয় ১৮৯০। বলা যায় মোটামোটি সমগ্র উনবিংশ শতাব্দীই (১৮০০-১৮৯০) লালন প্রতিভার ব্যপ্তিকাল। আর এই শতাব্দীরই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে লালন প্রতিভার বিকাশ। লালন ধর্ম ভাবনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের ব্রক্ষতত্ব, অবতারবাদ, বা জন্মামত্মরবাদ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, সে সম্পর্কে প্রমান পাওয়া যায়। ভগবান সম্পর্কে তিনি নির্বিকার ছিলেন। তার রচিত বিভিন্ন বিষয় সম্বলিত গান গুলো গভীর ভাবে অনুধাবন করলে মনে হয়, প্রথমে তিনি সকল ধর্মের সৃষ্টিতত্ব স্বীকার করে, পরে তা থেকে সরে গিয়ে তিনি সাবর্বজনীন মানবতাবাদে প্রত্যয়ী হয়েছিল। বলাই বাহুল্য যে, লালনের গানই হচ্ছে তার ধর্ম ভাবনার আধ্যত্ম চেতনার ভিত্তি এবং দর্শনের প্রতিফলন, এই গান বিশে­ষণের মধ্যে রয়ে গেছে। বাউল-মত ও পথের পূর্ণাঙ্গ দিশা, যার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে লালন সাঁই এবং বাউল ভাবনার আভ্যমত্মরীন সুর। বাউল গীত বিশে­ষণের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত দেখে থাকি। বাউলগান পরিবেশনের দুটি ধারা, এক আখড়া আশ্রিত গান, এখানে গানের ঢং এবং সুর শামত্ম এবং মৃদু তালের।

অপর ধারা জনসমক্ষে মঞ্চে আনুষ্ঠানিক পরিবেশনে, এ গানে চড়া সুরে গীত হয়। এই পরিবেশনায় বাউল শিল্পীর নৃত্য এক সহযেগী অনুষঙ্গী। বাউলগানে সাধারণত দুই প্রকার সুর পরিলক্ষিত হয়। প্রথমে কলি অর্থাৎ অস্থায়ীতে এক সুর অন্য সব কলিতে সে সুর বেশ কিছুটা ভিন্ন। সবশেষে পুনরায় দ্রুত গতিতে দ্বিতীয় কলির অংশ বিশেষ গীত হয়। বাউলগানে বিশেষ করে লালনের গানে, দৈন্যপদে কখনও একটানা সুর লক্ষ্য করা গেলেও, লালনের গান প্রায়ই দ্রুতলয়ের। কিছু কিছু বাউলগান কীর্তন আশ্রিত। বৈষ্ণব প্রভাবের ফলে এমনটি হয়েছে। তবে বাউলগানে সুফি-প্রভাবই প্রবল। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বাউল সুরের পার্থক্য আছে। পশ্বিচবাংলায় সহজিয়া বৈষ্ণব সুরের আধিক্য বাংলাদেশে সুফি গজলের, যার একটি দেশজ রূপ ভাব গান ও শব্দ গান। তবে বাউলের গানে একটা না পাওয়ার বেদনার ছোঁয়া যেন সুরের পরতে পরতে ধ্বনিত হয় বলে এ্যাডঃ লালিম হক জানান।

জানাগেছে, সাঁইজির আখড়া বাড়িতে দোল পূর্ণিমার তিথিতে পাঁচদিন ব্যাপি অনুষ্ঠানসহ বছরে দু’বার অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করা হয়। দোল পূর্ণিমায় তার আর্বিভাব উৎসব আর ১ কার্ত্তিক পালন হয় তার তিরোধান। অনুষ্ঠানে দেশী-বিদেশী পর্যটক ও লালন ভক্তনুরাগীদের আগমন ঘটে। লালন একাডেমী চত্বরে তিল ধারনের ঠাঁই থাকে না। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ তাঁর জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমার তিথিতে স্মরণোৎসব পালন করতেন। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর দোল পূর্ণিমায় পালন করা হয় তার বার্ষিক স্মরণোৎসব। দোল পূর্নিমা উপলক্ষ্যে কালী নদীর তীরে অবস্থিত উন্মক্ত মঞ্চে প্রতিদিন লালন বিষয়ক আলোচনা, লালনগীতি পরিবেশন এবং আখড়া বাড়ির বিশাল এলাকা জুড়ে বসে লালন মেলা।

প্রধান খাদেম ফকির মহম্মদ আলী শাহ জানান, সাঁইজিসহ মোট ৩২ টি সমাধী আছে। এর মধ্যে ১৪টি সাঁইজির নিজহাতে মুরিদ, ১ জন প্রশিষ্য আর বাকি তার অনুসারী। তিনি আরো জানান, মানুষের ভেতর আরেক অচিন মানুষ বাস করে। এই অচিন মানুষের সানিধ্য পেতে হলে মানুষকে ভজন সাধনা করতে হবে। তাই সাঁইজি বলেছেন ‘‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার ভবে সর্বসাধন সিদ্ধি হয় তার’’ আর তাই, সভ্যতার এই যুগে মানুষ মানুষের হিংসা বিদ্বেশ ভূলে সাঁইজির ধর্মদর্শনের চিরাচরিত ‘সত্য বল সুপথে চল..’ বাস্তবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে আমাদের নিয়োজিত রাখতে হবে। যাতে করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ মাথা উচুঁ করে চলতে পারে।

Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন
We use cookies

We use cookies on our website. Some of them are essential for the operation of the site, while others help us to improve this site and the user experience (tracking cookies). You can decide for yourself whether you want to allow cookies or not. Please note that if you reject them, you may not be able to use all the functionalities of the site.