মালেক দেওয়ান
বাংলাদেশের লোকগীতি ও বাউল সঙ্গীতের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দু’টি নাম মালেক দেওয়ান ও খালেক দেওয়ান। এদেশের লোকসঙ্গীতের অন্যতম প্রতিভাধর শিল্পী ও সুর স্রষ্টা দেওয়ান আলেফ চাঁন শাহ ওরফে আলফু দেওয়ানের সুযোগ্য পুত্র দেওয়ান আবদুল মালেক ও দেওয়ান আবদুল খালেক। এই দেওয়ান পরিবারের অনেকেই এখন রেডিও-টিভির নিয়মিত শিল্পী।
রাজধানীর দক্ষিণ প্রান্তে বুড়িগঙ্গার ওপারেই কেরানীগঞ্জের বামনসুর আটি গ্রামে আলফু দেওয়ানের জন্ম। চারণ কবিদের মতো মঞ্চে দাঁড়িয়েই তিনি গান রচনা করতে পারতেন। তিনি অধ্যাত্ম বিষয়ক প্রায় হাজার গান রচনা করে গেছেন। আলফু দেওয়ানের বড় ছেলে দেওয়ান আবদুল মালেক ১৮ বৎসর বয়স থেকে পিতার সাথে সাথে গান শুরু করেন এবং নিজ প্রতিভা গুণে অচিরেই আধ্যাত্মিক গানে পটু হয়ে উঠেন। পরে ছোট ছেলে খালেক দেওয়ানও সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তারা দু’ভাই মিলে লোকগীতি, পালাগান, আধ্যাত্মিক, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, ভাটিয়ালী, ভাউয়াইয়া প্রভৃতি গান গাইতে শুরু করেন।
পিতার মত তারাও মঞ্চে দাঁড়িয়েই গান রচনা ও নতুন সুর সংযোজন করে সাথে সাথে গেয়ে যেতে থাকেন। এ রকম বহু নতুন ধারার লোকসঙ্গীত প্রবর্তন করেন যা এদেশের খুব কম সঙ্গীতশিল্পীই করতে সক্ষম হয়েছেন। বড় ভাই দেওয়ান আবদুল মালেক বৃটিশ আমলে প্রথমে ঢাকা রেডিওতে গান করেন। পরে বড় ভাইয়ের সহায়তায় ও তার কাছে শিক্ষা লাভ করে ছোট ভাই আবুদল খালেকও রেডিওতে গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। দু’ভাই মিলে ও শিষ্যদের নিয়ে তারা বহুবার রেডিওতে গান গেয়েছেন।
১৯৭৫ সালে তাদের বেশ কয়েকটি গানের রেকর্ড করা হয়। এদেশের গ্রামে-গঞ্জে কিংবা হাটে-বাজারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই কেবল নয়, নগরীর সুধী সমাজেও তাদের গান আদৃত হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে। দেওয়ান আবদুল মালেক ও দেওয়ান আবদুল খালেক প্রায় তিন হাজারেরও অধিক গান রচনা করেছেন। “দেওয়ান গীতিকা” নামে তাদের গানের বইও প্রকাশিত হয়েছে। ড. মনিরুজ্জামানের “ঢাকার লোককাহিনী” নামক গ্রন্থে দেওয়ান ভ্রাতৃদ্বয়ের অবদানের কথা কিছুটা লেখা রয়েছে।
পালা গানের সম্রাট আবদুল মালেক ও খালেক দেওয়ান আজ আর নেই। কিন্তু দেশের লাখ লাখ মানুষের হৃদয়ে লালিত হচ্ছে তাদের গৌরবময় স্মৃতি। আজও দেশের আনাচে-কানাচে বেজে উঠে মরমী এই শিল্পীদের সুরেলা কন্ঠ। ঐতিহ্যবাহী এই দেওয়ান পরিবারের সদস্য খবির দেওয়ান, মাখন দেওয়ান, আরিফ দেওয়ান, কমল দেওয়ান, স্বপন দেওয়ান, কানন দেওয়ান, আজাদ দেওয়ান, শাকির দেওয়ান, কাঞ্চন দেওয়ান, উত্তম দেওয়ান, সজল দেওয়ান, সাবের উদ্দিন দেওয়ান, মুক্তি দেওয়ান, সুজন দেওয়ান, আকরাম দেওয়ানসহ অন্যান্য সদস্যের মাধ্যমে সগৌরবে পালাগান ও বাউল সঙ্গীতের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে।
-
তোমরা আমায় কী বুঝাইবা আমি পুইড়া হইছি কয়লা
ও আমি বুঝি গো বন্ধুয়ার পিরিতে কত জ্বালা
তোমরা আমায় কী বুঝাইবা আমি পুইড়া হইছি কয়লা
তোমরা আমার কী বুঝাইবা আমার অন্তর পুইড়া কয়লা
ও আমি জানি গো বন্ধুয়ার পিরিতে কত জ্বালা
ও আমি বুঝি গো বন্ধুয়ার পিরিতে কত জ্বালা।। -
বাউল
বাউল (Baul) একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত। এই মতের সৃষ্টি হয়েছে বাংলার মাটিতে। বাউলকূল শিরোমণি লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে বাউল মত পরিচতি লাভ করে। বাউল গান যেমন জীবন দর্শনে সম্পৃক্ত তেমনি সুর সমৃদ্ধ। বাউলদের সাদামাটা কৃচ্ছসাধনার জীবন আর একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষনা করে।