বাংলা তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমাদের এই প্রয়াস। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যর তথ্য দিতে চাইলে ইমেইল kushtia.contact@gmail.com অথবা ফোন করুনঃ- ০১৯৭৮ ৩৩ ৪২ ৩৩

Select your language

হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) উপমহাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক
হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) উপমহাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক

হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী ছিলেন একাদশ শতাব্দীর একজন সুফি মুসলিম ব্যক্তিত্ব। বলা হয়ে থাকে তিনি প্রথম সুফি যিনি বাংলায় ভ্রমণ ও বসতি স্থাপন করেছিলেন। নেত্রকোণায় ইসলামের প্রসারে তার নাম জড়িত আছে।

বিভিন্ন কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ মানুষ যখন আল্লাহতায়ালাকে ভুলে নানা অনাচারে লিপ্ত ছিলো তখন ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তুরস্কের সেলজুক প্রদেশ থেকে এই উপমহাদেশে আগমন করেন সুফি সাধক হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।

আল্লাহর এই অলি এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু যখন তিনি এক আল্লাহর সত্তাকে মনেপ্রাণে অনুভব করলেন, তখন সমস্ত ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ করে শুধু আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন ও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ঘর-বাড়ি ত্যাগ করেন। কঠোর সাধনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বাধা-বিপত্তি আর পদে পদে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে বন, জঙ্গল, পাহাড়, পর্বত পেরিয়ে তপ্ত রোদে পুড়ে, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মরুভূমি এবং সাগর পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে ৯৯৭ বছর আগে ৪৪৫ হিজরিতে নেত্রকোনার মদনপুরে আগমন করেন এই মহাসাধক।

তার শিক্ষক সৈয়দ শাহ সুরখুল আন্তিয়া এবং দশজন শিষ্যের সাথে ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে (৪৪৫ হিজরীতে) বাংলায় আসেন। এটি ছিল, মুসলিম সেনাপতি বখতিয়ার খলজির আগমনের এক শতাব্দী আগে ও ১৩০৩ সালে শাহ জালালের সিলেট বিজয়ের ২৫০ বছর আগে।

হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী ও তার সঙ্গীরা আধুনিক নেত্রকোণায় বসতি স্থাপন করেন, এখানে তখনো কোন মুসলিম জনসংখ্যা ছিল না এবং এটি গণেশ নামে একজন কোচ রাজা দ্বারা শাসিত হত। ইসলামের বাণী স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছলে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরের খবর সংবাদ রাজার কাছে পৌঁছালে, রুমিকে রাজকীয় আদালতে তলব করা হয়। বলা হয়ে থাকে, যে রুমি তখন দাবি করেন যে ঈশ্বর তাকে আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়েছেন। এটি বলার পর তাঁকে একটি পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। তাকে বিষপান করতে দেওয়া হয়। বলা হয়, বিষ পান করার পরেও তিনি নিরাপদ এবং সুস্থ ছিলেন। এতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সবাই ইসলাম গ্রহণ করে এবং রাজা তাকে মদনপুর ও পার্শ্ববর্তী কিছু গ্রাম নিষ্কর দান করেন।

শাহ সুলতান বলখীর নেতৃত্বে একটি উপদল যমুনা পথে বগুড়ায় ইসলাম প্রচারের জন্য গমন করেন। বগুড়ার সুশাসনকর্তা ছিলেন পালরাজের অধীনস্থ সামন্তরাজ পরশুরাম। শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার সদলবলে রাজা পরশুরামের রাজধানী মহাস্থানগড়ে অবস্থান নেন। সেখান হতে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে পুশুর রামের দরবারে দূত পাঠালেন। পরশুরাম ইসলামের কাফেলারে কথা শুনে ভীষন ক্ষীপ্ত হয়ে দৃতকেবন্দী করে কাফেলায় অতর্কিত আক্রমণ করেন। অতর্কিত আক্রমণে দলনেতা হযরত সৈয়দ শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার (রঃ) হযরত মোঃ ফারুক শাহ্ (রঃ) হযরত শাহ্ মিয়া গাজী (রঃ) হযরত মোঃ কাবিল শাহ্ (রঃ) সহ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন।

বগুড়ায় মুসলমানদের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে শাহ্ সুলতান রুমী সদল বলে বগুড়ার উদেশ্যে যাত্রা করেন। এদিকে মুসলীম বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে রাজা পরশুরাম প্রতিরক্ষা বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। শতেক সংগী নিয়ে হযরত শাহ্ সুলতান (রঃ) পরশুরামের বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করেন। যুদ্ধে মুসলমি বাহিনীর ৭ জন শহীদ হন আর রাজা পরশুরাম সহ শতার্ধিক সৈন্য নিহত হয়। এযুদ্ধে বিজয়ের ফলে বগুড়া মুসলমানদের হাতে আসে। কিছুদিন তিনি সেখানে থাকার পর কিছু সঙ্গী নিয়ে পূর্ব বঙ্গে যাত্রা শুরু করেন। এ সময় টাঙ্গাইলের মধুপুর এবং জামালপুর জেলার দুর্মোট অঞ্চলে কিছুদিন ইসলাম প্রচার শেষে মোমেন শাহ্ ও কামাল শাহ্ নামে সঙ্গীদের সেখানকার দায়িত্ব অর্পন করে, পরে তিনি অপর সঙ্গীসহ ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব তীরে বোকাইনগর পরগনায় অবস্থান নেন। সেখানকার সামন্ত শাসক বোকাই কোচ ইসলামের দাওয়াত কবুল করেন। সেখানে কিছুদিন তিনি ইসলাম প্রচার করে খ্রীষ্টীয় একাদশ শতকের মধ্যভাগে ৪০ জন সঙ্গীসহ সামন্ত রাজ মদন মোহন কোচের পরগনা মদনপুর আগমন করেন।

শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (রঃ) জীবনি গ্রন্থ ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ময়মনসিংহ অঞ্চলের গৌরীপুরের বোকাই নগর এবং নেত্রকোণার মদনপুর পরগনায় সে সময় সামন্ত রাজা ছিলেন বোকাই কোচ ও মদন মোহন কোচ।

হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী মদনরাজার বাড়ি থেকে ৩ কি:মি: পশ্চিমে নামাজ খানায় অবস্থানকালে তাঁর অন্যতম সহচর হযরত রূপশ মল্লিককে দূত হিসেবে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য রাজ দরবারে প্রেরন করেন। সামন্ত রাজ মদন কোচ মুসলীম বাহিনীর আগমনের কথা ও ইতি পূর্বেই মুসলীম বাহিনীর সাময়িক দক্ষতার কথা জেনে গিয়েছিলেন। প্রেরীত দূত যখন তার রাজ দরবারে উপস্থিত হলেন এবং ইসলামের দাওয়াত পৌঁছালেন, তখন তিনি প্রকাশ্যে কিছু না বলে কৌশলে মুসলীম বাহিনীকে ধ্বংশ করার পরিকল্পনা করেন। তিনি তার পারিষদ বর্গকে নিয়ে পরামর্শ করলেন মুসলীম বাহিনীকে দাওয়াত করে এনে খাদ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করবেন। রাজার সৈন্যগণ ইতি মধ্যে মুসলীম বাহিনীর ওপর আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে থাক। রাজা মদনকোচ কিছু সৈন্য সংগে নিয়ে ফকিরের তাবুর কাছে গিয়ে এ স্থান ত্যাগ করে তার রাজ্য সীমার বাইরে চলে যেতে নির্দেশ দেন। রাজার দিকে তাকিয়ে স্থান ত্যাগের আপত্তি জানালে রাজা তা মানতে রাজী হননি। তখন স্বীয় আসনের জায়নামাজ দেখিয়ে এ পরিমাণ জায়গার জন্য অনুরোধ জানান। রাজার উদ্যত আচরনে ফকির স্বীয় জায়নামাজ উর্দ্দে ছুড়ে মারার সংগে সংগে তা তীব্র গতিতে বেড়ে সমস্ত এলাকা আচ্ছাদিত করে ফেলে। এ অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ভয়ে ধর্ম গ্রহণ করার ছলনা করে মুসলীম বাহিনীকে তার বাড়িতে দাওয়াত করেন। হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমির কাফেলা ফজরের নামাজের পূর্বেই রাজবাড়ির সন্নিকটে এসে নামাজ আদায় করেন। রাজা তাদের আগমনে খুশি হয়ে রাজ দরবারে বসতে দিলেন এবং পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে বিষ মিশানো তরল পানিয় মেহমানদের মাঝে পরিবেশন করেন। হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমিধ্যানে রাজার কুট চাল জানতে পেরে সঙ্গীদেরকে পানীয় পানের নিষেধ করেন। তিনি একাই বিষ মিশ্রিত তরল পানীয় পান করেন। কথিত আছে পানীয়ের সঙ্গে ১৪ তোলা বিষ মিশানো ছিল। বিষ মিশ্রিত পানীয় পানের ফলে তাঁর দেহে সামান্য অবসন্নতা দেখা দিলেও ঐশ্যরিক গুনে কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে রাজা ও তাঁর পারিষদ বর্গ মহান অলীর কাছে ক্ষমা চেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার

ধারণা করা হয় শাহ সুলতান রুমী ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে (৪৭৫ হিজরীতে) মৃত্যুবরণ করেন। মদনপুর গ্রামে একটি মাজার নির্মাণ করা হয়। মাজারের পাশে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে।

বাংলার ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮২৯ সালে মাজারের জমি দখল করার চেষ্টা করে। এই মাজার দেখাশুনা করা ব্যক্তিরা এটির বিরোধিতা করেন, তারা ১০৮২ সালের একটি পুরানো ফার্সি নথি দেখান। এতে ব্রিটিশ সরকার দখলের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে এবং নথি ধারক সৈয়দ জালালউদ্দিনকে জমির মালিকানা প্রদান করে।

নেত্রকোণার মদনপুরে সামন্তযুগে প্রচারিত ইসলামের মর্মবানী ভক্তদের জড়ো করতে ডংকা বাজানোর প্রথা চালু করেছিলেন হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমি (রঃ)। সে সময় থেকে চালু ডংকা বাজানোর প্রথা এখনও রয়েছে।

হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমীর নামে অনেক জিনিসের নামকরণ করা হয়েছে:

  1. শাহ সুলতান জামে মসজিদ, মদনপুর
  2. শাহ সুলতান ডিগ্রী কলেজ
  3. শাহ সুলতান উচ্চ বিদ্যালয়, মদনপুর
  4. শাহ সুলতান ডিজিটাল ইনস্টিটিউট
  5. শাহ সুলতান ডায়াগনস্টিক সেন্টার
  6. শাহ সুলতান পরিবহন (বাস সার্ভিস ঢাকা টু কেন্দুয়া )
Add comment

ইতিহাস এর নতুন প্রবন্ধ

সর্বশেষ পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

তথ্য সম্পর্কে খবর

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন এবং আপডেট থাকুন